ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে গাইতে থাকেন গানের পর গান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ’লে যায়, নজরুলের গান আর থামে না।… কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের উপরে ঘর, রাস্তায় জ’মে যেত জনতা। অনেক বড় বড় গায়ক সে ঘরে এসে গান গেয়েছেন, তবু তাঁদের গান শোনবার জন্য অত লোক দাঁড়িয়ে যেত না। কিন্তু নজরুলের গানের ভিতরে নিশ্চয়ই ছিল কোন বিশেষ আকর্ষণী শক্তি। তিনি তখনও নিয়মিতভাবে গান রচনা করে নিজের সুর দিয়ে গাইতে শুরু করেন নি।’ (যাঁদের দেখেছি, দ্বিতীয় পর্ব)।
মহর্ষির প্রপৌত্র সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০১-৭৪) লাঙ্গল অফিসে নজরুলের পরিচয় দিয়েছেন তাঁর যাত্রী গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে (অভিযান পাবলিশিং হাউস, কলিকাতা, ১৩৫৭) এবং নজরুলের গলার সুর সম্পর্কে লিখেছেন:
‘…নজরুলের সঙ্গে আলাপ জমে গেলো। সে কবিতা পড়লো গান গেয়ে শোনালো। আমিও তাকে গান শোনালাম। কি ভালোই লেগেছিলো নজরুলকে সেই প্রথম আলাপে। সবল শরীর; ঝাঁকড়া চুল, চোখ দুটি যেন পেয়ালা, কখনো পেয়ালা খালি নেই, প্রাণের অরুণ রসে সদাই ভরপুর।… গলার স্বরটি ছিলো খুব ভারী… কিন্তু সেই মোটা গলার সুরে ছিলো যাদু। ঢেউয়ের আঘাতের মতো, ঝড়ের ঝাপটার মতো তার গান আছড়ে পড়তো শ্রোতার বুকে।… প্রাণ ছিল তার ঐ হাসির মতোই প্রবল ও দরাজ।… প্রবল হতে সে ভয় পেত না। রবীন্দ্রনাথের পরে এমন শক্তিশালী কবি আর আসেনি বাংলাদেশে। এমন সহজ গতি, আবেগের আগুন-ভরা কবিতা বাংলা সাহিত্যে বিরল।… ‘লাঙ্গলে’ বের হলো নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি। একদিনের মধ্যে ‘লাঙ্গল’ সব বিক্রি হয়ে গেলো, সেই সংখ্যাটা আমাদের আবার ছাপতে হলো। নজরুলের কবিতাই ছিলো ‘লাঙ্গলে’র প্রধান আকর্ষণ।’ (পৃ. ১০৮, ‘কাজী নজরুল ইসলাম/জীবন ও সৃষ্টি’, রফিকুল ইসলাম)। প্রসঙ্গত বুদ্ধদেব বসু তাঁর ১৯৪৪ সালে রচিত ও কালের পুতুল গ্রন্থে সংকলিত ‘নজরুল ইসলাম’-নামক প্রবন্ধে কাজীর গান গাওয়ার আকর্ষণ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে লেখেন:
‘কথার চেয়ে বেশি তাঁর হাসি, হাসির চেয়ে বেশি তাঁর গান। একটি হার্মোনিয়ম এবং যথেষ্ট পরিমাণে চা এবং পান দিয়ে একবার বসিয়ে দিতে পারলে তাঁকে দিয়ে একটানা পাঁচসাত ঘন্টা গান গাওয়ানো কিছুই নয়। গানে তাঁর আন্না নেই; ঘুমের সময় ছাড়া সবটুকু সময় গাইতে হলেও তিনি প্রস্তুত। কণ্ঠস্বর মধুর নয়, ভাঙা-ভাঙা খাদের গলা, কিন্তু গান গাওয়ায় এমন একটি আনন্দিত উৎসাহ, সমস্ত দেহ-মন-প্রাণের এমন একটি প্রেমের উচ্ছ্বাস ছিলো যে আমরা মুগ্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনেছি। সে-সময়ে গান রচনা করতেও দেখেছি তাঁকে—হার্মোনিয়ম, কাগজ আর কলম নিয়ে বসেছেন, বাজাতে-বাজাতে গেয়েছেন, গাইতে গাইতে লিখেছেন। সুরের নেশায় এসেছে কথা, কথার ঠেলা সুরকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সেবারে ঢাকায় যেসব গান তিনি লিখেছিলেন সেগুলি প্রায় সবই স্বরলিপি সমেত ‘প্রগতি’তে বেরিয়েছিলো।’ (লেখাটি ১৯৬৬ সালে ভারবি প্রকাশিত বুদ্ধদেবের ‘প্রবন্ধ সংকলন’-এও অন্তর্ভুক্ত হয়)।
এক স্মৃতিচারণায় নজরুলের গলা এবং গাওয়ার আকর্ষণ সম্পর্কে অসাধারণ গায়ক ও বিরল সংগীতগুণী দিলীপকুমার রায় বলেন:
‘কত সভায় এবং চ্যারিটি কনসার্টেই না সে আমাদের গানের পরে এই ভাবের নানা গান গাইত ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে ভাঙা গলায়। কিন্তু এমন গাইত যে, ভাঙা গলাকেও ভাঙা মনে হত না আগুন ছুটিয়ে দিত সে। এমন প্রাণোন্মাদী গায়ক কি আর দেখব এ-মনমরা যুগে? সত্যি আমাদের অবাক লাগত ভাবতে ভাঙা গলায়ও কোন জাদুতে কাজী এমন অসম্ভবকে সম্ভব করত দিনের পর দিন—ভাবের ঢলে পাথরের বুকে আলোর ঝর্না বইয়ে।’ (কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিচারণী তর্পণ, দিলীপ কুমার রায়, ধর্মবিজ্ঞান ও শ্রীঅরবিন্দ, বাক্সাহিত্য প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা)।
একই স্মৃতিচারণায় দিলীপ কুমার রায় সংগীতে নজরুলের অবদান প্রসঙ্গে বলেন:
‘ওর নানা কবিতা সুন্দর হলেও ওর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ হয়েছে ওর গানেই বলব। এ কথায় ওর অনুরাগীদের ক্ষুণ্ন হওয়া উচিত নয়। রবীন্দ্রনাথও কি বলেননি যে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান তাঁর গান? কাজীর সম্বন্ধেও ঐ কথা। আর সেইজন্যেই আমার মনের সঙ্গে ওর মনের সুর পুরোপুরি মিলত এসে এই গানেরই অন্দরমহলে, কবিতার রঙমহলে নয়।’
এই সূত্রেই নজরুলের গানের প্রতি সমকালীন সংগীতসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে দিলীপকুমার রায় এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর বেশ মনে ধরেছিল নজরুলের গজলের লঘু রাগসাংগীতিক চাল, যা তাঁর গলায় খেলতোও দারুণ। এই শাস্ত্রীয় সংগীতের রসের বশেই পরে তিনি নজরুলের প্রায় সকল ধরনের গানই গাইতেন। বাংলায় উর্দু গজলের মতো গজল গানের প্রচলন হওয়া ছিল তাঁর খুবই কাম্য একটি বস্তু। নানা প্রসঙ্গে দিলীপ রায় তাঁর এই অভিপ্রায় জ্ঞাপনও করতেন। তাঁর কামনা ছিল শ্রেষ্ঠ ফার্সি কবিদের গজলের মানের বাংলা গজল। কেননা তাঁর মতে উর্দুতে উচ্চমানের কবি নেই (এ এক অপার বিস্ময়েরই ব্যাপার যে শ্রীরায়ের মতো দিল্লি-লখনৌ-ঘোরা একজন রসপণ্ডিত গালিব-মোমিন-জাওক-জাফরের মতো বিশ্বমানের কালজয়ী গজলিয়াদের রসাবধারণে বঞ্চিত ছিলেন)।
যাহোক, নজরুল রচিত গজল এক বিশিষ্ট রূপবন্ধরূপে বাংলা কাব্যসংগীতের আসর মাত করামাত্রই দিলীপকুমার রায় তা নিজের অলংকৃত কণ্ঠে তুলে নিয়ে স্বয়ং এই গানের প্রচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কলকাতার বহু আসরে তিনি এই নবসংগীত যেমন কণ্ঠকার হিসেবে গেয়ে শুনিয়েছেন, তেমনি এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন ভাষ্যকার হিসেবে। নজরুলের গজলের শুদ্ধরূপে প্রচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে স্বরলিপি প্রণয়ন এবং তা পত্রপত্রিকায় মুদ্রণের ব্যাপারেও তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন সংগীতপ্রেমী দিলীপকুমার রায়। বাংলা গজল সম্পর্কে তিনি এতোই উৎসাহী ছিলেন যে নিজেও নজরুলের কয়েকটি গজলের স্বরলিপি প্রস্তুত করেন। তাঁর উদ্যোগেই রবীন্দ্র-পরিকরদের মধ্যেও নজরুলসংগীতের চর্চা প্রবেশ পায়—এমনকী রবীন্দ্রনাথের নিজের গানের রূপকার হিসেবে তাঁর সবচেয়ে পছন্দসই শিল্পী সাহানা দেবীকেও নজরুলের গান গাইতে দেখা যায় (এলো ফুলের মহলে ভোমরা গুনগুনিয়ে, নাচে সুনীল দরিয়া আজি দিল-দরিয়া পূর্ণিমা চাঁদ পেয়ে, মেগাফোন, জেএনজি ৭৬, ১৯৩৩)।
২.
কলকাতা-জীবনের প্রথমবর্ষে নজরুল ছিলেন সৌখিন গায়ক ও গীতিকার। সুর করার জন্য গান রচনা বা রচিত গানের সুর করা তখনও শুরু হয়নি তাঁর। তবে সে-পর্বও আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল অচিরেই এবং সেটা স্বদেশী গানের সূত্রে, যেটাকে তিনি সাম্যবাদী গানে রূপান্তরিত করে গণসংগীতের পথিকৃৎ হবার মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। নজরুল স্বদেশী হাওয়ায় তথা অসহযোগ আন্দোলনে উদ্বেলিত হন কুমিল্লায়—করাচি থেকে ফেরার বছরখানেক পরে, ১৯২১ সালের জুন-জুলাই মাসে। তিনি তাঁর সদ্যরচিত দেশাত্মবোধক গান গাইলেন মিছিলমুখর কুমিল্লা শহরের রাস্তায় রাস্তায় ‘এ কোন্ পাগল ছুটে এল বন্দিনী মা’র আঙ্গিনায়’। এ ছাড়াও সেসময় নজরুল আরও দুটি স্বদেশী গান ‘মরণবরণ’ (এস এস এস ওগো মরণ) এবং ‘বন্দী-বন্দনা’ (আজি রক্ত নিশি-ভোরে) রচনা করে কুমিল্লার টাউনহলে কংগ্রেসের সভায় গেয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক উদ্দীপনার সৃষ্টি করেন, যার অস্তিত্বই ছিল না বাংলার সংগীত-সংস্কৃতিতে এর আগে। একই বছরের নভেম্বর মাসে নজরুল পুনরায় ফিরে আসেন কুমিল্লায়। ২১ নভেম্বরে পালিত দেশব্যাপী হরতালের দিন তিনি মিছিলের পুরোভাগে শহর প্রদক্ষিণ করেন ‘জাগরণী’ গান গেয়ে—‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী’।
ডিসেম্বরে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফিরে নজরুল মাসটির শেষদিকে রচনা করেন স্বাদে গন্ধে বর্ণে ছন্দে বাংলা কবিতা ও গানের ইতিহাসে অদ্যাবধি অনতিক্রান্ত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা (বল বীর—বল উন্নত মম শির!) আর ‘ভাঙার গান’ (কারার ঐ লৌহ-কবাট ভেঙে ফেল্, কর রে লোপাট)। পরের বছর প্রমীলার সঙ্গে হৃদয় বিনিময়ের পর পর ১৯২২ সালের এপ্রিল মাসে ১৩২৯ সনের বাংলা নববর্ষের উৎসবকালে কুমিল্লাতেই রচিত হয় তাঁর আরেক অনতিক্রমণীয় কবিতা ও গান ‘প্রলয়োল্লাস’ (তোরা সব জয়ধ্বনি কর!)। ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন সঙ্গী নবীন কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর স্বদেশে সাম্যবাদকে আহ্বান করে রচেন এই গানটি। সেই মহাবিপ্লবের প্রেরণাতেই কলকাতায় ফিরে আগস্ট মাসে নজরুল স্বাধীনতাকামী অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু বের করেন।
এর আগের মাসেই কবি তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’-শীর্ষক রূপক কবিতাটি মারফত পরাধীনতা নাশনের জন্যে মহিষাসুরমর্দিনীকে আহ্বান করেছিলেন (দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,/ ভূ-ভারত আজ কশাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী!…)। এহেন রাজদ্রোহ মুদ্রণের জন্য ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয় বিপ্লবী কবিকে। ১৯২৩ সালে রাজবন্দী নজরুল হুগলী জেলে রচনা করেন তাঁর অগ্নিঝরানো ‘শিকল-পরার গান’ (এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল।/ এই শিকল প’রেই শিকল তোদের করব রে বিকল॥)। অসহযোগ আন্দোলনের ফসল এসব স্বদেশী গান সংবলিত বিষের বাঁশী ও ভাঙার গান-নামক দুটি গ্রন্থেরই বিজাতীয় সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হওয়া প্রকারান্তরে দেশবাসীর ওপর নজরুলের দেশাত্মবোধক গানের প্রচণ্ড প্রভাব স্বীকৃত হওয়া। এই স্বীকৃতি অন্যভাবে জাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকেও পেয়েছিলেন নজরুল। যেমন ১৯২৫ সালে কংগ্রেসের ফরিদপুর অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সামনে নজরুল তাঁর জনপ্রিয় ‘চরকার গান’ স্বকণ্ঠে গেয়ে তাঁদের প্রাণঢালা প্রশংসা পেয়েছিলেন (ঘোর—ঘোর রে ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর)। ১৯২৬ সালের মে মাসে কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার পটভূমিকায় কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের জন্যে নজরুল রচনা করেন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী তাঁর অবিস্মরণীয় গান ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার!’ (দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার/ লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!)। সম্মেলনে তিনি নিজে গানটি পরিবেশন করেন দিলীপকুমার রায় ও তাঁর সংগীতসম্প্রদায়ের সহযোগিতায়।
এর আগে মার্চ মাসে মাদারিপুরে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবী সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীতরূপে তিনি রচনা করেন ‘ধীবরদের গান’ (আমরা নিচে প’ড়ে রইব না আর/ শোন্ রে ও ভাই জেলে,/ এবার উঠব রে সব ঠেলে!/ ঐ বিশ্বসভায় উঠল সবাই রে,/ ঐ মুটে-মজুর হেলে/ এবার উঠব রে সব ঠেলে ॥)। ছাত্র সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে নজরুল রচনা করেন ‘ছাত্রদলের গান’ (আমরা শক্তি আমরা বল/ আমরা ছাত্রদল/ মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান/ ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।/ আমরা ছাত্রদল ॥)। যুব-সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীতরূপে তিনি মার্চের সুরে রচনা করেন ‘চল্ চল্ চল্’ (ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল,/ নিম্নে উতলা ধরণী-তল,/ অরুণ প্রাতের তরুণ দল/ চল্ রে চল্ রে চল্/ চল্ চল্ চল্ ॥)। ‘টলমল টলমল পদভরে’, ‘অগ্রপথিক হে সেনাদল’ প্রভৃতি গানও নতুন ধারার সমরসংগীতের তাল-লয়ে গ্রথিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে কবি নজরুল এই সব সম্মেলনের, গায়কদের তো বটেই, উদ্যোক্তাদেরও অন্যতম ছিলেন। এই দিকগুলির কারণেও বাংলার বরেণ্য বাগ্গেয়কারদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের স্থান অনন্য এবং অতুলনীয় (সাংগীতিক পরিভাষায় সংস্কৃত বাগ্গেয়কার-শব্দটি যুগপৎ কথাকার ও সুরকারকে বোঝায়)।
একই সময় নজরুল রচনা করেন তাঁর (সর্বহারা গ্রন্থে সংকলিত) সুবিখ্যাত কৃষক-শ্রমিকের গানগুলি। কংগ্রেসের ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’র (কিংবা স্বতন্ত্ররূপে নবগঠিত ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলে’র) কিষাণ সভার জন্য তিনি রচনা করেন ‘কৃষাণের গান’ (ওঠ্ রে চাষী জগদ্বাসী ধর ক’ষে লাঙল।/ আমরা মর্তে আছি—ভাল ক’রেই মর্ব এবার চল্ ॥) নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীতরূপে নজরুল রচনা করেন ‘শ্রমিকের গান’ (ওরে ধ্বংস-পথের যাত্রীদল!/ ধর্ হাতুড়ি, তোল্ কাঁধে শাবল ॥)। এসব গান সম্মেলনে স্বকণ্ঠে গেয়ে সমবেত জনতাকে উদ্বুদ্ধ করে তোলা ছিল সমাজপরিবর্তন-কর্মী হিসেবে কবির পূর্বিতাপ্রাপ্ত কর্মসূচির অন্তর্গত—যার জন্য তিনি রোগশয্যা থেকেও ছুটে আসতেন জনসভায়।
কারণ, রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক সাম্যপ্রতিষ্ঠার চিন্তা ছিল তাঁর একসূত্রে গ্রথিত এবং সৃজনশীল সত্তার পাশাপাশি মননশীল সত্তায় প্রোথিত। শেষোক্ত গান দুটি সম্পর্কে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র, ঠাকুরবাড়ির একমাত্র ‘বিপ্লবী’, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কমিউনিস্ট নেতা, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০১-১৯৭৪) তাঁর যাত্রী গ্রন্থে লিখেছেন: ‘বাংলা সাহিত্যে এই ধরনের গান ছিল না এর আগে, নজরুলই তার পথকার’। (মহর্ষির আরেক প্রপৌত্র সুভগেন্দ্রনাথ ওরফে সুভো ঠাকুর (১৯১২-৮৫) ছিলেন বাড়িটির একমাত্র ‘বিদ্রোহী’, যিনি লিখেছিলেন, ‘পোয়েট ট্যাগোর হন কে তোমার, জোড়াসাঁকোতেই থাক?/ বাবার খুড়ো যে হন শুনিয়াছি, মোর কেহ হয় নাকো’।)।
গণসংগীতের পথিকৃৎ কাজী নজরুল ১৩৩৪ সালের একই তারিখে, পয়লা বৈশাখে, একের পর এক রচনা করেন ‘অন্তর-ন্যাশনাল সংগীত’ (জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত !), ‘জাগর-তূর্য’ (ও রে ও শ্রমিক, সব মহিমার উত্তর-অধিকারী!/ অলিখিত যত গল্প-কাহিনী তোরা যে নায়ক তারি ॥), ‘রক্ত-পতাকার গান’ (ওড়াও ওড়াও লাল নিশান!/ দুলাও মোদের রক্ত-পতাকা/ ভরিয়া বাতাস জুড়িয়া বিমান!/ ওড়াও ওড়াও লাল নিশান ॥)। সামাজিক অন্যায়বিচারের জগদ্দল পাথর ভেঙে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করতে নজরুল এর আগে ১৩৩১ সালে ব্যান্ডের সুরে রচনা করেন ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল।/ মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়, মোরা প্রকৃতির মতো সচ্ছল॥’। পরে ১৩৩৭ সালে রচনা করেন নারী-জাগরণী গান ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা। জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্তটিকা॥’। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ও বহুল উদ্ধৃত সাম্যবাদী কবিতাগুলি সংকলিত হয়েছে তাঁর সাম্যবাদী গ্রন্থে (যেমন সাম্যবাদী, ঈশ্বর, মানুষ, পাপ, চোর-ডাকাত, বারাঙ্গনা, মিথ্যাবাদী, নারী, রাজা-প্রজা, সাম্য ও কুলি-মজুর)।
লক্ষণীয় যে নজরুল ছিলেন, যাকে বলে, প্র্যাক্সিসের মানুষ। মানে নিতান্ত ভার্বালিস্ট বা বচনসর্বস্ব অথবা নিতান্ত অ্যাক্টিভিস্ট বা করণসর্বস্ব ছিলেন না—তিনি ছিলেন অ্যাক্টিভিস্ট-কাম-ভার্বালিস্ট। এজন্যে তাঁর সৃজনে এমন একক এক অথেন্টিসিটি বর্তাতো যা আর কারও রচনায় প্রত্যাশিতও ছিল না। নজরুল সংগ্রামী গান রচনা করতেন পরাধীনতার বিরুদ্ধে মাঠে-বাটে সংগ্রাম করতে করতে (যেমন করতেন আর কেবল মুকুন্দ দাস, তবে তাঁর স্বর নজরুলের কণ্ঠের সঙ্গে তুলনীয় ছিল না), ঘরের কোণে বসে কলম পিষতে পিষতে নয়। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ নজরুলের উদ্দীপনামূলক ও দেশাত্মবোধক গানগুলিকে উচ্চতম মান এবং স্থায়ী মূল্য দান করেছে। তাঁর সভায়-মিছিলে অংশগ্রহণ এবং কারাবরণ ও অনশন পালন—সবই ছিল দেশবন্দনামূলক মহান সৃজনকর্মের সক্রিয় প্রস্তুতিস্বরূপ। এ বিষয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল-তনয় দিলীপকুমার রায়ের বয়ানে সুভাষচন্দ্র বসুর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ১৯২৫ সালের দোসরা মে নেতাজী মান্দালয় থেকে একটি পত্রে লিখেছিলেন—”We do not perhaps realise the magnitude of the debt owed by Kazi Nazrul Islam’s verse to the living experience he had of jails” (পৃ. ১৩১, নজরুল গীতি প্রসঙ্গ, ড. করুণাময় গোস্বামী)। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে জাতির পক্ষ থেকে আয়োজিত নজরুল-সংবর্ধনা সভাতেও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর প্রদত্ত ভাষণে বলেন:
‘তাঁর লেখার প্রভাব অসাধারণ। তাঁর গান পড়ে আমার মত বেরসিক লোকেরও জেলে বসে গান গাইবার ইচ্ছা হত। আমাদের প্রাণ নেই, তাই আমরা এমন প্রাণময় কবিতা লিখতে পারি না। নজরুলকে বিদ্রোহী বলা হয়—এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্ট বুঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব—তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব। আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বেড়াই, বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সংগীত শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, কিন্তু নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মত প্রাণ মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না। কবি নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা শুধু তাঁর নিজের স্বপ্ন নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩২)।
সংবর্ধনা-সভাটির সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেন:
‘রবীন্দ্রনাথের আওতায় নজরুলের প্রতিভা পরিপুষ্ট হয় নাই, তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁহাকে কবি বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন।’ উপসংহারে আচার্য রায় আরো বলেন, ‘আমরা আগামী সংগ্রামে কবি নজরুলের সংগীত কণ্ঠে ধারণ করিয়া শ্রীমান সুভাষের মতো তরুণ নেতাদের অনুসরণ করিব। নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতিমানুষে পরিণত হইবে।’
৩.
তবে স্মরণ রাখতে হবে যে দেশাত্মবোধক গান রচনার এই কালটি ছিল নজরুলের গভীরভাবে সংগীতজগতে প্রবেশ করার পূর্বকাল। এ পর্বের গানগুলির সুর ছিল সহজসরল ও উদ্দীপনাময়, বাণীও ছিল সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকারের—যে-সমূলবদলের সংগ্রামী সৈনিকরূপে তিনি তখন সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ। সত্যিকার অর্থে সংগীতক্ষেত্রে অবতরণ তাঁর এর পরে—১৯২৬ সাল থেকে, যার শুরু গজলপর্ব দিয়ে। ১৯২৬-১৯২৮-এর কৃষ্ণনগরের জীবনে নজরুল শোষণমুক্তি ও সাম্যপ্রতিষ্ঠা অভিলাষী নতুন ধারার সাম্যবাদী গান রচনার সমসময়েই শুরু করেন নতুন ছন্দের নতুন বর্ণের নতুন স্বাদের নতুন আবেগের প্রেমের গান রচনা। গজল-নামে অভিষিক্ত রক্তমাংসের এই নতুন প্রেমের বন্যা চোখের পলকে প্লাবিত করে দিল প্রেমের গানের ক্ষমতাসীন মহারাজ রবীন্দ্রনাথের রাজধানী শহর-কলকাতাকেই।
লখ্নৌ প্রবাসী উর্দু-দাঁ অতুলপ্রসাদ সেন নজরুলের আগে কয়েকটি গজল রচনা করেছিলেন (যেমন ‘কে গো তুমি বিরহিণী, আমারে সম্ভাষিলে/ এ পোড়া পরান তরে এত ভালবাসিলে’, ‘রাতারাতি করল কে রে ভরা বাগান ফাঁকা/ রাঙা পায়ের চিহ্ন শুধু আঙিনাতে আঁকা’)। দু একটি গজল তাঁর ভালোও হয়েছে (যেমন ‘বলো গো সজনী, কেমনে ভুলিব তোমায়?/ যতন যাতনা বাড়ায়’, ‘কত গান তো হল গাওয়া/ আর মিছে কেন গাওয়াও?/ যদি দেখা নাহি দিবে/ তবে মিছে কেন চাওয়াও?’ তবে তাঁর শ্রেষ্ঠতম গজল ‘জল বলে চল মোর সাথে চল/ কখনো তোর আঁখিজল হবে না বিফল’ এখানে উল্লেখ্য নয় যেহেতু এটির সৃষ্টি নজরুলের ‘এত জল ও-কাজল-চোখে পাষাণী আন্লে বল কে।/ টলমল জল্-মোতির মালা দুলিছে ঝালর-পালকে’-গজলটির প্রেরণায় (বলেছেন দিলীপকুমার রায়)। এখানে বিশেষভাবে বলার কথাটি হল অতুলপ্রসাদ গজলের তরঙ্গই সৃষ্টি করতে পারেননি, ধারা রচনা করা তো পরের কথা।
নজরুল শুধু ১৩৩৩ থেকে ১৩৩৫—এ দুটি বছরেই অতুলের মোট গজলের চেয়ে অনেক বেশি গজল সৃষ্টি করে গজলের জলোচ্ছ্বাস বইয়ে দিয়েছেন বাংলা গানের জগতে। ১৩৩৩ সালে ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল’ দিয়ে শুরু করে তিনি একের পর এক লিখে গিয়েছেন ‘আসে বসন্ত ফুলবনে’, ‘বসিয়া বিজনে কেন একা মনে’, ‘আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায়’, ‘দুরন্ত বায়ু বহে পুরবঁইয়া’, ‘মৃদুল বায়ে বকুল ছায়ে’, ‘করুণ কেন অরুণ আঁখি’, ‘এত জল ও কাজল চোখে’, ‘কেন কাঁদে পরাণ’, ‘চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না’, ‘কে বিদেশী বন-উদাসী’, ‘নিশি ভোর হল জাগিয়া পরান পিয়া’ ইত্যাদি একসে-এক মনোহরণ গজল। ১৩৩৫ সালেও সমানে চলল তাঁর গজলবর্ষণ। যেমন ‘এ বাসি বাসরে আসিলে কে গো ছলিতে’, ‘নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখি-জল’, ‘কেন আন ফুল-ডোর আজি বিদায়-বেলা’, ‘কেমনে রাখি আঁখি-বারি চাপিয়া’ ইত্যাদি। এসব গজল প্রকাশিত হত প্রায়শ স্বরলিপিসহ (যার বেশ কিছু কবিকৃতও) শীর্ষস্থানীয় সকল পত্রিকায় (যেমন কল্লোল, কালিকলম, প্রগতি, বঙ্গবাণী, নওরোজ, সওগাতে)।
নজরুলের গজল-সংকলনরূপে বিখ্যাত ‘বুলবুল’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে [পরপর প্রকাশিত ‘চোখের চাতক’ও গজল-খ্যাত]। তবে এ সময় তাঁর গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার ফলে রকমারি গানের চাহিদা গজলকে পেছনে ঠেলে দেয়। তবু এরই মধ্যে নজরুল গজলকে বাংলাগানের আসরে সম্মানিত একটি স্থায়ী আসন অর্জন করে দিতে পেরেছেন। পেরেছেন এ কারণে যে এর প্রস্তুতি তাঁর সম্পূর্ণ হয়েছিল অনেক আগেই, করাচি-বাসকালে—ফার্সি কাব্যপাঠ, বিশেষত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গজলিয়া পারশ্যের হাফিজের গজল পাঠ ও আবৃত্তি শোনা ও শেখার মাধ্যমে (সে-আবৃত্তি বাংলা কবিতা আবৃত্তির মতো নয়, সুরেলা আবৃত্তি—যাকে তাঁরা বলেন ‘তারান্নুম’-যুক্ত পাঠ)।
গজলের পথ বেয়েই নজরুল সংগীতের উপত্যকায় পৌঁছান। পৌঁছেই গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগদান তাঁর সাহিত্যরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাঁকে সংগীতনগরের নাগরিক করেই রেখে দেয়। সেখানেই নজরুল বহু সংগীতগুণীর সৃজনশীল সান্নিধ্য এবং তৎপ্রসূত শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের মওকা পান। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন ঠুংরির ভাণ্ডারি জমিরুদ্দীন খাঁ, ঠুংরি-মুখড়ার খনি মঞ্জু সাহেব, মাস্তান গামা, ওস্তাদ কাদের বখশ, দবীর খাঁ, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী প্রমুখ। সংগীতে পুষ্টিলাভ করার মানসে নজরুল রাগসংগীতের বিখ্যাত স্বাস্থ্যনিবাসেও যেতেন—যেমন খলিফা বদল খাঁ বা আফতাবে মওসিকী ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের সকাশে। তবে এঁদের জোগানের পরিমাণ তেমন বেশি ছিল না। বেশি ছিল নজরুলের বিধিদত্ত প্রতিভাপুষ্ট স্বশিক্ষা, ঠুংরি সম্রাট মৌজুদ্দীনের মতো। সেজন্য কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলার সংগীত জগতের শ্রেষ্ঠতম ‘আতায়ী’ উস্তাদ বললেও অত্যুক্তি হয় না।
৪.
বস্তুতপক্ষে নজরুলের রাগসংগীতপ্রীতি জন্মগত বলেই সেই সংগীতে কৃতি তাঁর বিধিদত্ত। তাঁর প্রকাশিত প্রথম গানটিও ছিল বসন্ত-সোহিনী রাগে ও দাদরা তালে রচিত (বাজাও প্রভু বাজাও ঘন বাজাও)। সম্ভবত তাই রাগসংগীতের ভুবনে এ-আগন্তুকের কাছে বাংলা গান যা পেয়েছে—রাগসংগীতের ঐতিহ্যে লালিত বাকি চার প্রধানের কাছে সম্মিলিতভাবেও তা পায়নি। স্মর্তব্য যে নজরুল ছাড়া সকলেই জন্মেছিলেন ঐতিহ্যবাহী সংগীতচর্চাকারী পরিবারে।
রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরবাড়ি ছিল অন্যতম দেশখ্যাত সংগীতকেন্দ্র, যেখানে বিখ্যাত শাস্ত্রীয় কলাবতগণ থাকতেন এবং পরিবারের নতুন প্রজন্মকে তাদের শিশুকাল থেকেই গান শেখাতেন। বিষ্ণু চক্রবর্তী, যদুনাথ ভট্টাচার্য, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর মতো স্বনামধন্য ধ্রুপদিয়াদের আবাল্য সান্নিধ্যে গড়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের সংগীতসত্তা। দ্বিজেন্দ্রলালের সংগীতজীবনের গোড়াপত্তন হয় টপ-খেয়ালিয়া ও গীতিরচয়িতা পিতা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের তালিমে।
অতুলপ্রসাদ সেন গায়ক পিতার মৃত্যুর পর প্রতিপালিত হন গায়ক ও গীতিরচয়িতা মাতামহের আশ্রয়ে। কর্মজীবনের সূত্রে লখনৌ শহরে সুর ও বাণীর আবহাওয়াতেই ছিল তাঁর বসবাস। তাই আজীবন সংগীত রচনা করেন তিনি শাস্ত্রীয়সংগীতের স্বভূমিতে, রাগসংগীতিক পরিবেশে বসে। পাবনার সংগীতজ্ঞ কবির পুত্র রজনীকান্ত সেনের শৈশব-কৈশোরও সংগীতসমৃদ্ধ এবং আইনজীবী হিসেবে রাজশাহীর জীবনও ছিল তাঁর উচ্চমানের সাংগীতিক পরিমণ্ডলে।
প্রতিপক্ষে একমাত্র কাজী নজরুল ইসলামই জন্মেছিলেন দরিদ্রগৃহে এবং শিশুশ্রমিকের জীবনটিও কেটেছে তাঁর কঠোর সংগ্রামে আর কঠিন সঙ্কটে। অথচ ঐতিহ্য ব্যতিরেকেই এই স্বভাবশিল্পী সৃষ্টি করে গেছেন বাংলার সংগীত জগতে রাগসংগীতের কালজয়ী ধারাটি এবং পুষ্টও করে গেছেন প্রভূত পরিমাণে।
বাণীর বিচারে যে-শ্রেণীতেই জমা পড়ুক, সুরের বিন্যাসে রাগসাংগীতিক চারিত্র্য নজরুলের, কেবল গজলকেই নয়, সকল শ্রেণীর গানকেই শনাক্তযোগ্যভাবে ‘নজরুলিয়া’রূপ দিয়েছে। তবে এক কথায় বলতে গেলে ‘রাগপ্রধান গান’-নামক বিশেষ শ্রেণিটিই তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাগসাংগীতিক অবদান। এই গান হিন্দুস্তানী সংগীতরীতির প্রতিকৃতি কিংবা প্রতিধ্বনি নয়—এ এক রাগাশ্রয়ী সংগীতরীতিই বটে, তবে খাঁটি বাঙালি। এ-গানকে ‘শুদ্ধবাদী’ও বলা যায় এ-অর্থে যে এতে থাকে কেবল মৌলিক রাগরূপ ও রাগভাবসহ রাগাঙ্গীণ অলঙ্কৃতি—থাকে না সুরপ্রস্তারের বহুলতা, নানান ফাঁদের তানকর্তবের কৃত্রিমতা, দুরূহতার কার্দানি, জটিলতার প্রদর্শনী প্রভৃতি। সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনার এই সংগীত-সংরূপটির জন্ম হয় উনিশ শো ত্রিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে—স্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম এবং নামদাতা তাঁর সহযোগী কৃতী রাগসংগীতশিল্পী ও তাত্ত্বিক সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বাংলা একাডেমীর নজরুল রচনাবলী দশম খণ্ডে পূর্ণরূপে প্রকাশিতব্য নজরুলের ‘সুর ও শ্রুতি’-শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রবন্ধটি সম্বন্ধে শ্রীকল্পতরু সেনগুপ্ত তাঁর নজরুল-গীতি অন্বেষা নামক গ্রন্থে বলেছেন:
‘এই রচনাটি অপ্রকাশিত। একটি বাঁধাই খাতায় কাজী নজরুল ইসলামের নিজের হাতের লেখায় পাওয়া গেছে। খাতায় তিনি এত দ্রুত লিখেছেন যে, কোথাও কোথাও পাঠোদ্ধারের অসুবিধা হয়েছে। রাগ-রাগিণী ও শ্রুতির চার্টগুলি তাঁর নিজের হাতে তৈরি। এই চার্টগুলি দেখে, অনুমান করা যায় শাস্ত্রীয় সংগীতের তুলনামূলক বিচারে তিনি কিরূপ আগ্রহী ছিলেন এবং কিরূপ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সংগীত-শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন। একই খাতায় তিনি আরো কয়েকটি রাগের প্রকৃতি ও পরিচয় বর্ণনা করেছেন। খাতা-দৃষ্টে অনুমান হয় ১৯৩৫-৩৬ সালে তিনি এই লেখা আরম্ভ করেছিলেন।’
প্রবন্ধটি লিখিত হয়েছে প্রখ্যাত সংগীত ব্যক্তিত্ব লখনৌর রাজা নবাব আলী রচিত এবং উনিশ শত বিশের দশকে প্রকাশিত মারিফুন্নাগমাত-নামক রাগসংগীত বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থটির প্রথম খণ্ডের অনুসরণে। খণ্ডটির অধ্যায় ছিল তিনটি—স্বরাধ্যায়, রাগ অধ্যায় ও তাল অধ্যায়। স্বরাধ্যায়ে ছিল শাস্ত্রীয় সংগীতের সাধারণ উপপত্তিক বিষয়গুলি। রাগ অধ্যায়ে ছিল ১৫৩টি রাগের বিবরণ, স্বরবিস্তার ও একটি করে লক্ষণগীত। এতে করে অনেকগুলি রাগ সাধারণ্যের নাগালে চলে এল, যেগুলি ইতিপূর্বে বিভিন্ন ওস্তাদদের কুক্ষিগত ছিল। কবির সৃষ্টিধারায় এই গ্রন্থের প্রভাব অনুভব করা যায় ত্রিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে।
মারিফুন্নাগমাতে কবি দেড়শতাধিক রাগের লক্ষণগীতি হাতে পেলেন। অর্থাৎ রাগ পরিচয় ও স্বরবিস্তার ছাড়াও প্রত্যেক রাগের একটি করে গানের মডেল স্বরলিপিসহ হাতের কাছে পাওয়া গেল। এই মডেলগুলির কাঠামো বজায় রেখে কবি অনুরূপ বন্দিশে অনায়াসেই গান বাঁধতে পারতেন (রবীন্দ্রনাথ যেমন বেঁধেছেন তাঁর বহু ভাঙা-গান)। স্বরগুলো তো ছকে সাজানোই ছিল, তার নিচে পছন্দমতো বাংলা কথা বসিয়ে দিলে (রবীন্দ্রনাথ যেমন বসিয়ে দিয়েছেন, যথা ‘হৃদয়নন্দনবনে নিভৃত এ নিকেতনে’) খুব সহজে বহুসংখ্যক রাগভিত্তিক নজরুল-গীতির জন্ম হতো। কবি কিন্তু তা করেননি। কবি রাগভিত্তিক গান বেঁধেছেন রাগের ধ্যানমূর্তি মানসপটে প্রতিষ্ঠা করে নিয়ে। লক্ষণগীতির স্বরলিপিতে রাগ কূপের জলের মতো অকিঞ্চিৎকর হয়ে থাকে। রাগের মোহিনীমূর্তি আবির্ভূত হয় উপযুক্ত গুণীর কণ্ঠে অথবা যন্ত্রে। রাগ তখন রঙে রসে বৈভবে কলস্বিনী নদীর মতো অনুভবের জোয়ারে শ্রবণতট রসপ্লাবিত করে। রসের সেই মূর্তি কবি নিয়ত সন্ধান করেছেন উপযুক্ত গুণীজনের কাছে কখনো শিক্ষার্থী হয়ে, কখনো ফরমাশ করে, কখনো বা উৎকর্ণ শ্রোতার আসনে বসে। পুঁথির বিধান কবিকে রাগের ব্যাকরণ দিয়েছে, রাগের রসমাধুর্য দিয়েছেন শিল্পীজন। (‘নজরুল ও মারিফুন্নাগমাত’, অমলকুমার মিত্র, নজরুল একাডেমী পত্রিকা, ১৩৯৪, ঢাকা)।
কট্টর উর্দু ভাষায় লিখিত শাস্ত্রীয় সংগীতের জটিল বিষয়াদি অনুধাবন করে বস্তুসার স্বচ্ছ বঙ্গভাষায় স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল অভিব্যক্তিতে সংগীতসমাজে পরিবেশন—ভাষা ও সংগীতের ক্ষেত্রে নজরুলের সহজাত প্রতিভার একটি বিস্ময়কর দৃষ্টান্তই বটে।
৫.
ভক্তিসংগীতের দুটি ধারাতে নজরুলের কৃতি তুলনারহিত—হিন্দুধর্মসংগীতর আবহমান ধারা আর মুসলিমধর্মসংগীতের নতুন ধারা। হিন্দু ভক্তিসংগীতে তাঁর রচনার অসংখ্যতা ও বিষয়ের অজস্রতা এককথায় বিহ্বলকর। ঈশ্বরবন্দনামূলক গান যেমন—অন্তরে তুমি আছ চিরদিন, খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিশ্বব্যাপিয়া আছ তুমি জেনে, মন বলে তুমি আছ ভগবান, যুগ যুগ ধরি লোকে লোকে প্রভৃতি। শ্যামাসংগীত যেমন—শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা, মহাকালের কোলে এসে, শ্মশানকালীর রূপ দেখে যা, আমার মা আছে রে সকল নামে, ওমা বক্ষে ধরেন শিব যে চরণ, কে তোরে কি বলেছে মা, বল রে জবা বল, সংসারেরই দোলনাতে মা প্রভৃতি।
দুর্গাসংগীত যেমন—জয় দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, এস আনন্দিতা ত্রিলোকবন্দিতা, মৃন্ময়ী রূপ তোর পূজি শ্রীদুর্গা, ভবাণী শিবাণী দশপ্রহরণধারিণী, কে জানে মা তব মায়া মহামায়া রূপিণী ইত্যাদি। আগমনী গান বা উমাসংগীত যেমন—ওরে আলয়ে আজ মহালয়া, আমার উমা কই গিরিরাজ, তুই পাষাণগিরির মেয়ে হলি, বর্ষা গেল আশ্বিন এল উমা এল কই, মা হবি না মেয়ে হবি দে মা উমা বলে, কে সাজালে আমার মাকে বিসর্জনের বিদায় সাজে, ইত্যাদি। শিবসংগীত যেমন—গরজে গম্ভীর গগনে কম্বু নাচিছে সুন্দর নাচে স্বয়ম্ভু, সৃজনছন্দে আনন্দে, জাগো অরুণ ভৈরব, প্রভৃতি।
কৃষ্ণসংগীত যেমন (নারায়ণরূপী কৃষ্ণ) জাগো শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী, হে প্রবল প্রতাপ দর্পহারী, তিমিরবিদারী অলখবিহারী কৃষ্ণমুরারী আগত ঐ, প্রভৃতি। (গোপীবল্লভরূপী কৃষ্ণ) একি অপরূপ রূপের কুমার, আমি কেন হেরিলাম নবঘনশ্যাম, সখি যায়নি তো শ্যাম মথুরায়, ব্রজগোপী খেলে হোরী, ইত্যাদি। ব্রজলীলা যেমন (কীর্তন) মুরালীধ্বনি শুনি ব্রজনারী, রাখ রাখ রাঙা পায় হে শ্যমরায়, শ্যামসুন্দর গিরিধারী, দোলে বনতমালের ঝুলনাতে কিশোরী কিশোর, সখি আমিই না হয় মান করেছিনু, মন মোর ছুটে যায় দ্বাপর যুগে প্রভৃতি। (ভজন) চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, প্রভু রাখ এ মিনতি, তোমার আমার এই বিরহ সইব কত আর, হে চিরসুন্দর বিশ্বচরাচর, হে মহামৌনী তব প্রশান্ত গম্ভীর বাণী শোনাবে কবে প্রভৃতি।
হিন্দুধর্মসংগীত বিভাগে নজরুলের গানে রচনার পরিমাণগত বিপুলতা, বিষয়বৈচিত্র্যের ব্যাপকতা ও সুরৈশ্বর্যের উৎকৃষ্টতা তথা কাব্যসংগীতের সামগ্রিক উৎকর্ষের মাধ্যমে যুগপৎ আবহমান বাংলার হিন্দুপ্রভাব পুনরুজ্জীবিত হয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথের হাতে শীর্ষস্পর্শী ব্রাহ্মপ্রভাব তিরোহিত হয়েছে। এর একটা সাধারণ প্রমাণ এই যে বাংলা ভাষায় জনপ্রিয়তম দুর্গাসংগীতটি নজরুলসংগীত যথা ‘কে জানে মা তব মায়া মহামায়ারূপিণী’। আরেকটা বিশেষ প্রমাণ এই যে গাজন-গম্ভীরা ইত্যাদি লোকসংগীতের উপজীব্য শিবের গীতকে ধ্রুপদ-খেয়াল অঙ্গপ্রধান কাব্যসংগীতে উন্নীত করেছেন কাজী নজরুল ইসলামই এবং বাংলার স্বল্পসংখ্যক শিবসংগীতের শ্রেষ্ঠতমটিও তাঁরই, যথা—গরজে গম্ভীর গগনে কম্বু।
শ্যামাসংগীতে নজরুলের অবদান সম্পর্কে ডক্টর করুণাময় গোস্বামী লেখেন, ‘বলতে কি শ্যামাসংগীত রচয়িতারূপে রামপ্রসাদ সেন বা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য সাংগীতিক নান্দনিকতায় যে স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, নজরুল তদপেক্ষা উচ্চস্তরে পৌঁছেছিলেন। কেননা, কবি ও সুরস্রষ্টারূপে তিনি পূর্ববতী সংগীতরচয়িতাদের চেয়ে মহৎ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। সে পরিচয় তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে রেখেছেন তাঁর গানে।’ (পৃ. ২৫৩, নজরুলগীতি প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী ১৯৯৬)। তিনি আরও বলেন, ‘হিন্দুধর্মসংগীত পর্যায়ে কাজী নজরুল ইসলামের রচনা একদিকে যেমন বিপুল অপরদিকে তেমনি বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্যের ব্যাপকতা এমনি বিস্ময়কর যে স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। অপর কোন বাঙালি কবির রচনাকর্মে হিন্দুধর্ম-সম্পৃক্ত বিষয়ের এমন বহুমুখী রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করা যায়নি। বর্তমান শতকের ত্রিশের দশকের পরবর্তীকালে গেয় জনপ্রিয় হিন্দুধর্ম সংগীতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই নজরুলের রচনা (প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৩)।’
এই বিপুলতার উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে হরফ প্রকাশনীর অখণ্ড নজরুলগীতির ষষ্ঠ সংস্করণে এই শ্রেণিতে সংকলিত ৫৪২টি গানের সঙ্গে আরো অনেক গানই যুক্ত হচ্ছে নানাসূত্রে নিত্যপ্রাপ্ত নজরুলগীতির অশেষ ভাণ্ডার থেকে। আর বৈচিত্র্যের দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে নজরুলের বেশুমার ভক্তিগীতিতে বন্দিত হয়েছেন কেবল শক্তিদেবী কালী নয়, বরং নানা রূপের নানা কালী—শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, নিত্যকালী, মহাকালী। তেমনি দুর্গাও গীত হয়েছেন চণ্ডী, কৌষিকী, শাকম্ভরী, সতী প্রভৃতি রূপে। শাক্ত ও বৈষ্ণবীয় দেবীকাহিনীর হেন অনুষঙ্গ নেই যা নজরুলের গানে আসেনি। পৌরাণিক বিষয়াবলীর এমন জম্পেশ সমাবেশ অন্য কোন সংগীতকারের রচনায় ঘটেনি।
৬.
নজরুল প্রবর্তিত ইসলামী গানের ধারাটিকে এখানে আমি বলব মুসলিমধর্মসংগীত যেহেতু এটি হিন্দুধর্মসংগীতের পরিপূরকরূপে বাংলার ভক্তিগীতির ধারাটিকে অভূতপূর্ব এক পরিপূর্ণতা দান করেছে। দুই শতের মতো গান দিয়ে মাত্র কয়েক বছরে তিনি বাংলা শীলিত সংগীতের ঐতিহ্যে ইসলামী ভক্তিসংগীতের ধারাটি সংযোজন করেন। সুদীর্ঘ কালের পরম্পরাগত চর্চার ফলে ভক্তিসংগীতের অন্যান্য শাখা যথা ব্রহ্মসংগীত, শ্যামাসংগীত, উমাসংগীত প্রভৃতি যে-উচ্চতায় উঠেছে—ইসলামী গানকে লোকসংগীতের পর্যায় থেকে রাগসংগীতের লেবাস পরিয়ে নজরুল এক হাতেই সেখানে উন্নীত করে দিয়ে ইসলামের নতুন এক সাংগীতিক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
লোকসংগীত প্রভাবিত ইসলামী গানের উদাহরণ হচ্ছে—ওরে ও দরিয়ার মাঝি, পুবান হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া, এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি প্রভৃতি। রাগসংগীতের সুররঞ্জিত ইসলামী গানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে—মোহররমের চাঁদ এল ঐ, ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে, সাহারাতে ফুটল রে ফুল, খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে, বক্ষে আমার কাবার ছবি, যাবি কে মদীনায়, ইসলামের ঐ সওদা লয়ে প্রভৃতি। আল্লা-রসুলের প্রশস্তি, ধর্মীয় বিধান, ইসলামের ইতিহাস, এবাদত, বন্দেগী, মাযার, মসজিদ ইত্যাদি বিষয় অবলম্বন করে নজরুলের মুসলিমধর্মসংগীতমালা গ্রথিত। হামদ বা আল্লার জয়গানের উদাহরণ—তুমি অনেক দিলে খোদা দিলে অশেষ নিয়ামত, তুমি আশা পুরাও খোদা সবাই যখন নিরাশ করে, তোমারি মহিমা সব বিশ্বপালক করতার, রোজ হাশরে আল্লা আমার করো না বিচার ইত্যাদি।
এর মধ্যে মোনাজাতরূপে উল্লেখিত গানগুলির সুরবাণীর আবেদন সর্বজনীন এবং সর্বকালীন, যেমন ‘খোদা এই গরীবের শোনো শোনো মোনাজাত’, ‘শোনো শোনো ইয়া ইলাহী আমারি মোনাজাত’ ইত্যাদি। আবির্ভাব ও তিরোভাবসহ নবীমহিমা বিষয়ক নাত-শ্রেণির সংগীতে ইসলামী গানের শীর্ষে আরোহণ করে নজরুল তাঁর সাংগীতিক উচ্চতার প্রতিনিধিত্বকারী ইসলামী গান উপহার দেন—যেমন মোহাম্মদ নাম যতই জপি, ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ, এ কোন মধুর শরাব দিলে ইত্যাদি। রমজান এবং ঈদ ছাড়াও নজরুল অবিস্মরণীয় যত গান রচনা করেন কাবা ও হজ্ব বিষয়ে যেমন দুখের সাহারা পার হয়ে আমি চলেছি কাবার পানে, পূবান হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া প্রভৃতি।
মসজিদ-আজান-নামাজ বিষয়ে—যেমন বাজল কি রে ভোরের শানাই, মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ, আঁধার মনের মিনারে মোর হে মুয়াজ্জিন দাও আজান প্রভৃতি। মোহররম বিষয়ে যেমন—মোহররমের চাঁদ এল ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়, ওগো মা ফাতেমা ছুটে আয়, ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে প্রভৃতি। ফাতেমা, আরব, মক্কা, মদীনা বিষয়ে যেমন—খাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননী বিশ্বদুলালী নবীনন্দিনী, দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটির হতে, সুদূর মক্কা মদীনার পথে আমি রাহি মুসাফির, ভেসে যায় হৃদয় আমার মদীনা পানে ইত্যাদি। মোট কথা বাংলা কাব্যসংগীতের দীর্ঘকালের লালিত ধারায় রাতারাতি একই মানের ইসলামী গানের যোজনা কাজী নজরুল ইসলামের এক অবিশ্বাস্য কীর্তি। তার ওপর রেকর্ড রিলিজমাত্রই এ-গানের বিস্ফোরক জনাদৃতির সূত্রে বিস্ময়কর বিপণন সাফল্য এক অকল্পনীয় ইতিহাসেরই সৃষ্টি করেছে।
নজরুলের নতুন সুরের এই মধুর সুরধুনী, ধর্ম কর্তৃক নিরুৎসাহিত মুসলমানদের এতোই সংগীতমনস্ক করে তোলে যে মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত বঙ্গদেশে ইসলামী গানই হয়ে ওঠে রেকর্ড কোম্পানির বেস্টসেলার সিরিজ। ফলে নজরুলসৃষ্ট এই নবধারার গান রেকর্ড করার জন্য এত শিল্পীর প্রয়োজন পড়ে যে, ক্রেতার কথা ভেবে বহু হিন্দু গায়ক-গায়িকাকে মুসলিম নাম ধারণ করতে হয় রেকর্ডের লেবেলে। এই প্রক্রিয়ায় রেকর্ডের লেবেলে ধীরেন দাস হয়ে যান ‘গনি মিঞা’ (তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ ক্ষমা করো হজরত, তোমারি প্রকাশ মহান এ নিখিল দুনিয়া জাহান, ঈদের খুশির তুফানে আজ ভাসলো দো-জাহান, মেষ চারণে যায় নবীকিশোর রাখাল বেশে, মারহাবা সৈয়দ মক্কী মদনী আল-আরবী, ফুরিয়ে এলো রমজানের এই মোবারক মাস, এসেছি তব দ্বারে ভক্তিশূন্য প্রাণে)।
ঊষারাণী হয়ে যান ‘রওশন আরা বেগম’ (আমার ধ্যানের ছবি আমার হজরত, নতুন চাঁদের তকবীর শোন কয় ডেকে ঐ মুয়াজ্জিন, হেরেমের বন্দিনী কাঁদিয়া ডাকে তুমি শুনিতে কি পাও, হে প্রিয় নবী রসূল আমার, তোমারি নূরের রওশনী মাখা নিখিল ভুবন, নিশিদিন জপে খোদা দুনিয়া জাহান)। সীতা দেবী হয়ে যান ‘দুলি বিবি’ (আমি বাণিজ্যেতে যাব এবার মদীনা শহর, ওগো মুরশীদ পীর বলো রসুল কোথায় থাকে)। হরিমতী দেবী হয়ে যান ‘সাকিনা বেগম’ (আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ, কেন তুমি কাঁদাও মোরে হে মদিনাওয়ালা, এলো এলো শবে বরাত তোরা জ্বাল রে বাতি, ভক্তিভরে পড় রে তোরা কলমা শাহাদাত, চীন আরব হিন্দুস্থান নিখিল ধরাধাম, নামাজ-রোজা হজ্জ-জাকাতের পসারিনী আমি, প্রিয় মোহ্রে নবুয়তধারী হে হজরত তরিতে উম্মতে এলে ধরায়, মসজিদে ঐ শোন রে আজান,)। গিরীণ চক্রবর্ত্তী হয়ে যান ‘সোনা মিয়া’ (ঈমান বাইন্ধা রাখ রে, মন রে মায়া জগতের মূল মায়া)। গিরীণবাবুই আবার আরেক গানের জন্য হয়ে যান গোলাম হায়দার এন্ড পার্টি (আল্লার নাম জপিও ভাই, ইয়া আল্লা তুমি রক্ষা কর)। তিনিই আরেক গানের জন্য হন সুজন মাঝি (আকাশের আর্শীতে ভাই পইরাছে মোর মনের ছায়া)। চিত্ত রায়কে হতে হয়েছে দেলওয়ার হোসেন (ক্ষমাসুন্দর আল্লা, মোদের ভয় দেখিও না আর, আল্লা রসূল তরু আর ফুল প্রেমিক হৃদয় জানে)।
এক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি বিড়ম্বিত হতে হয়েছিল মুনশী মহম্মদ কাসেমকে। খদ্দেরের রুচিসম্মত হওয়ার জন্য মহম্মদ কাসেম মল্লিককে অতুল-নজরুল প্রমুখের গান গাওয়ার জন্য প্রথমে হতে হয়েছিল কে. মল্লিক (‘ডাকে কোয়েলা বারে বারে’, ‘কেন কাঁদে পরাণ’, ‘কেন দিলে এ কাঁটা’ এবং হিন্দি জাতীয় গান গাওয়ার জন্য শঙ্কর মিশ্র (অম্বরে মেঘে মৃদঙ্গ বাজে জলদ তালে, দোলে প্রাণের কোলে প্রভুর নামের মেলা, ও কে মুঠি মুঠি আবির কাননে ছড়ায়)। পরে আবার ইসলামী গান গাওয়ার জন্য তাঁকে হতে হল ‘মনু মিয়া’ (ও রে ও মদীনা বলতে পারিস কোন সে পথে তোর, দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটির হতে, আমিনা দুলাল নাচে হালিমার কোলে, তোমার নামের এ কি নেশা হে প্রিয় হজরত)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ইসলামী গান গাননি বলে তালাত মাহমুদ কেবল হিন্দু-নামেই নজরুলগীতি গেয়েছেন—তপনকুমার।
৭.
১৯৩৩ থেকে শুরু হয় নজরুলের আধুনিক ও লোকসংগীত ধারার সংগীতসৃষ্টির পর্ব। বিগত শতকের ত্রিশের দশকে প্রবর্তিত আধুনিক বাংলা গানের যে-মেলডি কিংবা সুরলহরী আজকের প্রজন্মকেও মাতায় বলে হালের গানের বাজারটি ‘রিমেকিঙে’র বাজার হয়ে দাঁড়ায়—সুরমূর্ছনা প্লাস শব্দগ্রন্থনার সে-মডেলটির প্রতিষ্ঠাতা কাজী নজরুল ইসলাম। জনসাধারণের মনমাতানো সুর ও শব্দের এই সহজ সরল সাংগীতিক বিন্যাসটি তিনি সৃষ্টি করেন প্রধানত গ্রামোফোন-বেতার ও সবাক সিনেমার ত্রিমুখী চাহিদার দ্রুতবর্ধিষ্ণু তাগিদে। বাংলাগানের ভুবনে চাহিদা কিংবা বাজারের ব্যাপারটি ১৯০৪ সালে এদেশে আসা গ্রামোফোন কোম্পানির নতুন সংযোজন। ১৯২৭ সালে যুক্ত হওয়া বেতারবাহিত গণসম্প্রচার মাধ্যমের দিবারাত্রির ক্ষুধা এবং ১৯৩১ সালে সবাক হওয়া চলচ্চিত্র মারফত বর্ধিত সংগীততৃষ্ণা নিবারণের কারণেও বহুগুণ বেড়েছে এই চাহিদা। এই তিনটি নতুন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলার মহৎ সংগীতকারদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ছিলেন কেবল নজরুলই।
[এ-কারণেই কি বাংলা গানের অন্যান্য শাখার বিখ্যাত শিল্পীদের রেকর্ডেও আমরা নজরুলসংগীত শুনতে পাই? যেমন সাহানা দেবীর রেকর্ডের কথা আগেই বলা হয়েছে। কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে কলম্বিয়ার রেকর্ডে: চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, কোথা তুই খুঁজিস ভগবান, মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর, আমি দ্বার খুলে আর রাখবো না পালিয়ে যাবো গো। ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে কলম্বিয়ার রেকর্ডে: না মিটিতে মনোসাধ যেয়ো না হে শ্যামচাঁদ, বৃথা প্রবোধ দিস নে ললিতে। পান্নালাল ভট্টাচার্যের কণ্ঠে কলম্বিয়ার রেকর্ডে: আর লুকাবি কোথায় মা কালী, আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়। তালাত মাহমুদের কণ্ঠে এচএমভি’র রেকর্ডে: নিশি ভোর হল জাগিয়া পরাণ পিয়া, আসলো যখন ফুলের ফাগুন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে এচএমভি’র রেকর্ডে: হে বিধাতা দুঃখ শোক মাঝে তোমারি পরশ রাজে প্রভৃতি।]
সারকথা, ত্রিশের দশকের সূচনায় সৃষ্ট সবিশেষ সাংগীতিক পরিস্থিতির নিজস্ব উত্তাপে গ্রামোফোন কোম্পানির সদ্য নিয়োজিত গীতিকার-সুরকার-প্রশিক্ষক কাজী নজরুল শব্দ ও সুরের যে-সুরমূর্ছনা বা সুতান সৃষ্টি করলেন তার নাম নিজেই কোথাও লিখলেন ‘মডার্ণ’ কোথাও লিখলেন ‘আধুনিক’ (আমার জানামতে পঞ্চপ্রধানের আর কেউ তাঁদের কোনো শ্রেণীর গানকে এই অভিধায় অভিহিত করেননি)। এই শিরোনামের মাধ্যমে নজরুল যেন বোঝাতে চাইলেন, এ গান কোনো নির্দিষ্ট সুর-শব্দ কিংবা রূপবন্ধের কাছে দায়বদ্ধ নয়, এ গান সাংগীতিক বিন্যাসে মুক্ত রীতির, এ গান জনচিত্ত অভিমুখী, এ গানের উৎসার হৃদয় থেকে, অভিসারও হৃদয়ের দিকে। সংগীতরচয়িতা হিসাবে বস্তুত এই সমস্ত গুণই নজরুলের বৈশিষ্ট্য।
গানে তিনি সর্বদা উপস্থিত শ্রোতাকেই সম্বোধন করেন। জনচিত্তমুখিতাই নজরুলসৃষ্ট নব্যআধুনিকতার মূলকথা। সংগীতে এত কালের অন্তর্মুখিতার বদলে নজরুল-আনীত বহির্মুখিতা তাঁর গানের তাৎক্ষণিক জনাদৃতি এবং শ্রোতৃসমাজের কাছ থেকে উচ্ছ্বসিত সাড়া পাওয়ার একটা বড়ো কারণ। তাৎক্ষণিক সে-জনাদৃতি কালজয়ী হয়ে সমানে বিদ্যমান আছে অদ্যাবধি। নজরুল প্রবর্তিত সেই আধুনিক বাংলা গান তাই আজ বোদ্ধা মহলে ‘ধ্রুপদী আধুনিক’ বলে অভিহিত। হরফ প্রকাশনীর ‘অখণ্ড নজরুল গীতি’র ষষ্ঠ সংস্করণে নজরুলের আধুনিক গান সংকলিত হয়েছে ৭৮১টি। তবে চলমান আহরণের প্রক্রিয়ায় সংখ্যাটা বিপুলতর হবার কথা এবং হয়ে চলেছেও।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বাংলা গান নজরুলের আবির্ভাব পর্যন্ত ছিল মোটামুটি সর্বজ্ঞশাসিত অর্থাৎ কথাকার, সুরকার ও রূপকার একই ব্যক্তি—যেমন রামপ্রসাদ, রামনিধি, রবীন্দ্রনাথ। প্রতিপক্ষে নজরুল তাঁর গানকে বিশেষজ্ঞদের দক্ষতা মারফত সমৃদ্ধতম হয়ে ওঠার পথ করে দিলেন। যেমন কথাকার নজরুল গানের দাবির বিচারে গানবিশেষকে সুরারোপ করতে দিলেন কমলদাশগুপ্তকে কিংবা শৈলেশ দত্তগুপ্তকে এবং গাইতে দিলেন উস্তাদ জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীকে কিংবা অভিনেত্রী-গায়িকা কাননবালাকে। তবে স্মর্তব্য যে সংগীতের সামগ্রিক রূপবন্ধটির ‘নজরুলিয়া’ বৈশিষ্ট্যগুলি সংরক্ষিত থাকতো যেহেতু আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞগণ সকলেই ছিলেন—উদ্যাপিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী বাংলার অন্যতম প্রধান কাব্যসংগীতকার, কাজী নজরুল ইসলামের পরম ভক্ত পরিকর।
নজরুল প্রযোজিত—বিশেষজ্ঞ গীতিকার বিশেষজ্ঞ সুরকার ও বিশেষজ্ঞ রূপকার—এই তিন রত্নের সম্মিলিত অবদানে আধুনিক বাংলা গান উৎপাদিত হচ্ছে আজও। তবে মান থাকছে না ম্যাসপ্রোডাকশনের কারণে, যেজন্যে সৃজিত না-বলে উৎপাদিত হচ্ছে বলতে হল। এদেশে যথা-অর্থে আধুনিক গানের প্রথম মিউজিক কম্পোজার ও প্রডিউসার কাজী নজরুল ইসলাম। কথাটা বলেছেন সংগীতগুণী সুকুমার রায়। দিলীপকুমার রায়ও ঠিকই বলেছিলেন যে এর আগে মিউজিক কম্পোজিশনের কোনো কনসেপ্টই ছিল না আমাদের। তাই বলতে হয় সাবেক কালের শেষ প্রধান প্রতিনিধি যেমন নজরুল, আধুনিক কালের প্রথম প্রধান প্রতিনিধিও তিনিই।
নজরুলের কালজয়ী আধুনিক গানের কিছু উদাহরণ: অরুণ রাঙা গোলাপ কলি, আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়, আমার ভুবন কান পেতে রয় প্রিয়তম তব লাগিয়া, আমায় নহে গো ভালবাস শুধু ভালবাস মোর গান, আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, আমি পূরব দেশের পুরনারী, আমি যার নূপুরের ছন্দ, কথা কও কও কথা থাকিও না চুপ করে, সবার কথা কইলে কবি, কেন মন বনে মালতী বল্লরী দোলে, গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়, গানগুলি মোর আহত পাখির সম, চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়, জানি জানি প্রিয় এ জীবনে মিটিবে না সাধ, তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, তুমি হাতখানি যবে রাখ মোর হাতের পরে, নাই চিনিলে আমায় তুমি রইব আধেক চেনা, বলেছিলে তুমি তীর্থে আসিবে আমার তনুর তীরে, বঁধু তোমার আমার এই যে বিরহ এক জনমের নহে, বিদায় সন্ধ্যা আসিল ঐ, মনে পড়ে আজ সে কোন্ জনমে বিদায় সন্ধ্যা বেলা, মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম, যবে তুলসীতলায় প্রিয় সন্ধ্যাবেলায়, যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, সাঁঝের পাখীরা ফিরিল কুলায় প্রভৃতি।
৮.
নজরুলসংগীত শব্দটা শুনেই অনুষঙ্গবাদীরা, লোকসংগীতের অঙ্গনটি টপকে, রাগসংগীতের ভাবানুষঙ্গে চলে যান এবং ভুলে বসেন যে লোকসুরই রাগসুরের মূলাধার। সেদিক থেকে আজন্ম রাগসংগীতপ্রেমী নজরুলের লোকসুরের সঙ্গে ছিল নাড়ির সম্পর্ক। সে-কারণে লোকসুরভিত্তিক বাংলা গানে তাঁর অবদান ছিল মৌলিক এবং উচ্চতম মানের। নজরুলের পূর্বে কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে অতুলপ্রসাদ সেন পর্যন্ত লোকসংগীতের কেবল বাউল সুরাঙ্গ অবলম্বনে গান রচিত হয়।
কিন্তু নজরুলের রচনায় বাউল ছাড়াও ঝুমুর, ঝাপান, সারিসহ ভাটিয়ালী-ভাওয়াইয়া ইত্যাদি নানান সুরভঙ্গি এসে মিলে মিশে লোকসংগীতভিত্তিক আবহমান বাংলার গানের ধারাটিও অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে তাঁর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান উপজাতীয় সুর ঝুমুরঢঙের নিবিড় এবং ব্যাপক ব্যবহার। তাঁর এই অসাধারণ সাফল্যের অন্যতম কারণ—ঝুমুর অঞ্চলের লোক হওয়ার সুবাদে তাঁর ধমনীতে প্রবাহিত এই লোকসুরটির প্রয়োগ নজরুলের জন্যে হয়েছিল খুবই স্বতঃস্ফূর্ত। ফলে সৃষ্ট হয়েছে, এই বিশেষ লোকসুরমণ্ডিত অনেক কালজয়ী গান যেমন—এসো ঠাকুর মহুয়া বনে ছেড়ে বৃন্দাবন, কুনুর নদীর ধারে ঝুনুর ঝুনুর বাজে, ঝুম ঝুম ঝুমরা নাচ নেচে কে এল গো, তেপান্তরের মাঠে বঁধু হে একা বসে থাকি, হলুদ গাঁদার ফুল রাঙা পলাশ ফুল, নিমফুলের মউ পিয়ে ঝিম হয়েছে ভোমরা, চুড়ির তালে নুড়ির মালা রিনি ঝিনি বাজে লো, ও ঝুমরো তীর-ধনুক নিয়ে বল না কোথায় যাস, এই রাঙামাটির পথে লো প্রভৃতি।
তেমনি আজও সমান জনপ্রিয় নজরুলের ঝাপান সুরভঙ্গির গান যেমন হলুদ গাঁদার ফুল, কথা কইবে না বউ, কলার মান্দাস বানিয়ে দাও গো শ্বশুর সওদাগর, ওঠাও ডেরা এবার দূরে যেতে হবে, চিকন কালো বেদের কুমার কোন পাহাড়ে যাও প্রভৃতি। নজরুলের বেদে-বেদেনীর গানেও পাওয়া যায় সম্পূর্ণ নতুন ব্যঞ্জনা। মৌলিক সংগীতপ্রতিভা সাধারণ একটি লৌকিক সুরকে কেমন অলৌকিক সুরলোকে নিয়ে যেতে পারে—তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ নজরুলের ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’ গানটি।
ভাটিয়ালী ঢঙে অভিনব সুরযোগে নজরুলের মানের গান আর কেউ রচনা করেছেন বলে আমার মনে হয় না এবং এর প্রমাণ কেবল ইতিহাস সৃষ্টিকারী গান ‘পদ্মার ঢেউ রে’-ই নয়। এক্ষেত্রে তাঁর অনেক গানই অদ্যাবধি অনতিক্রান্ত যেমন, ‘এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে এই ত নদীর খেলা’, ‘আমার সাম্পান যাত্রী না লয়’, ‘আমার ভাঙা নায়ের বৈঠা ঠেলে’ ইত্যাদি। আর ভাওয়াইয়া ঢঙেও অমর হয়ে আছে তাঁর ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা’, ‘পদ্মদীঘির ধারে ঐ সখি লো কমল দীঘির ধারে’ ইত্যাদি।
বিভিন্ন লোকসুরের বৈচিত্র্যবিলাসী নজরুল কিন্তু পূর্বসূরিদের ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত বাউল সুর প্রয়োগেও বহু কালজয়ী গান সৃষ্টি করেছেন, যেমন—‘বাঁশি বাজায় কে কদমতলায় ওগো ললিতে’, ‘ভবের এই পাশা খেলায় খেলতে এলি হায় আনাড়ি’, ‘আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল আমার দেউল আমার এই আপন দেহ’, ‘ওহে রাখাল রাজ! কি সাজে সাজালে আমায় আজ’, ‘অসীম আকাশ হাতড়ে ফিরে খুঁজিস রে তুই কাকে’, ‘তুমি দুঃখের বেশে এলে বলে ভয় করি কি হরি’ প্রভৃতি। এ পর্যন্ত সংকলিত নজরুলের লোকসুরঋদ্ধ গানের সংখ্যাও কম নয়, প্রায় ১৫০। লোকসুরের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে নানা রকম লাগসই সুর পুরে বহু কালজয়ী গান রচনা করার সুবাদে নজরুল পথিকৃৎ হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন লোকসংগীতের ক্ষেত্রেও।
কাজী নজরুল ইসলাম স্মরণীয় হয়ে আছেন প্রকৃতি পর্যায়ের বহু অমর গানের কারণেও—বিশেষত বর্ষা, বসন্ত ও শরৎ ঋতু বিষয়ক (শরতের জন্য প্রধানত উমাসংগীত স্মর্তব্য)। উদাহরণ : (বর্ষা) এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া, মেঘের হিন্দোলা দেয় পূব হাওয়াতে দোলা, এল বরষা শ্যাম সরসা প্রিয় দরশা, রুম্ ঝুম্ ঝুম বাদল নূপুর বোলে বোলে, (বসন্ত) আসে বসন্ত ফুলবনে, এল ঐ বনান্তে পাগল বসন্ত, ফুল ফাগুনের এল মরশুম, আজি দোল ফাগুনের দোল লেগেছে, বসন্তমুখর আজি, (শরৎ) এস শারদপ্রাতের পথিক এস শিউলি বিছানো পথে প্রভৃতি।
কমিক-রিলিফরূপী বিষ্কম্ভক কিংবা গর্ভনাটক ছাড়াও, হাস্যরস সিনেমা-নাটকের শক্তিশালী অঙ্গবিশেষ। এই রসের স্বভূমি নয় সংগীত। তবু পঞ্চপ্রধানের দুজন তাঁদের গানেও এর শক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন—দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ব্যঙ্গগীতিতে ও রজনীকান্ত সেন রঙ্গগীতিতে। এই দুইজনের হাসির হাট জমজমাট থাকতেই অসাধারণ দক্ষতায় নজরুল তাঁর ব্যঙ্গগীতি ও রঙ্গগীতির—এককথায় হাস্যগীতির—পশরা সাজিয়ে মাতিয়েছিলেন সমগ্র বাংলার আবালবৃদ্ধবণিতাকে। তবে এ প্রসঙ্গে এও স্মর্তব্য যে গুরুগণের তুলনায় নজরুল উপকরণগত সুযোগ পেয়েছিলেন অনেক বেশি, যেমন গ্রামোফোন-বেতার-চলচ্চিত্র, আরো পেয়েছিলেন অনেক বেশি প্রতিভাবান গায়কের দল যেমন রঞ্জিত রায়, হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিমল গুপ্ত (দাশগুপ্ত) প্রমুখ।
এক্ষেত্রেও নজরুলের অনেক গানই কালজয়ী হয়েছে গানগুলির উপজীব্য চিরন্তন বলে—যেমন, টিকি আর টুপিতে লেগেছে দ্বন্দ্ব, বদনা গাড়ুতে মুখোমুখি বসে, দয়া করে দয়াময়ী ফাঁসিয়ে দে এই ভুঁড়ি, দে গরুর গা ধুইয়ে, আমার খোকার মাসী, প্রিয়ার চেয়ে শালী ভাল, ওহো আজকে হইব মোর বিয়া, আমার হরিনামে রুচি পরিণামে লুচি, ও তুই উল্টো বুঝ্লি রাম, দুপেয়ে জীব ছিল গদাই বিবাহ না করে প্রভৃতি।
নজরুল নিজেও তাঁর কাব্যের চেয়ে সংগীতের উপর বেশি আস্থা রাখতেন। মুজফ্ফর আহ্মদ তাঁর ‘নজরুল স্মৃতিকথা’য় লিখেছেন ‘আমার মনে আছে, একদিন শ্রীভূপতি মজুমদার বলেছিলেন—“নজরুল, কী তুমি এত ভালো গান গাও যে গান পেলেই মেতে ওঠ।” সেদিন নজরুল খুব আহত হয়েছিল। সে বলেছিল, “ভূপতি-দা আমার কবিতার যত খুশি সমালোচনা করুন। কিন্তু আমার গানের সম্বন্ধে কিছু বলবেন না।” (নজরুল-চরিতমানস, ড. সুশীলকুমার গুপ্ত, পৃ. ৩৪৯)।
তাঁর সংগীতের উৎকর্ষ সম্পর্কে নজরুল বরাবরই অবহিত ছিলেন। ১৯৩৮ সালে জনসাহিত্য সংসদের ভাষণে নজরুল বলেছিলেন, ‘সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই তবে এইটুকু মনে আছে, সঙ্গীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি। সঙ্গীতে যা দিয়েছি সে সম্বন্ধে আজ কোনো আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে তখন আমার কথা সবাই মনে করবেন—এ বিশ্বাস আমার আছে।’
একই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অভিন্ন উক্তিগুলিও এখানে উল্লেখ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। সংগীত-বিভাগের অধ্যক্ষ হেমেন্দ্রলাল রায়ের ভ্রাতা মেঘেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নিজে আমায় বলিয়াছিলেন’, “তোমরা কবি টবি যা বলো বলতে পারো, কিন্তু গানেই আমি বড়।” (প্রাগুক্ত, পৃ.৩৫০)। ৭ মার্চ ১৯৩৪ কিশোরীমোহন সাঁতরাকে লেখা পত্রে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আমার কাব্যের কোনোকালে অনাদর হতেও পারে কিন্তু বাংলাদেশের লোককে আমার গান গাইতেই হবে—সেই গানের সুরগুলি যদি বিকৃত বা লুপ্ত হয় তবে তাতে দেশের ক্ষতি এ আমি অহংকার করেই বলতে পারি’।
কথাগুলি যাঁরা বলেছেন তাঁরা-যে নির্ভুল ভবিষ্যতদ্রষ্টা তা আজ একুশ শতকের শূন্য-দশকশেষেও বিশ্বের পঁচিশ কোটি বাঙালি এক বাক্যেই বলতে পারে।
৯.
বাংলার সংগীতজগতে কাজী নজরুল ইসলামের এতসব নবসংযোজনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন না-হওয়া ছিল বিস্ময়কর। তার বদলে অবমূল্যায়ন হওয়া ছিল হতভম্বকর। কিন্তু কেন? কারণ কি এই যে নজরুল মাত্র ষোল বছর সংগীত রচনা করার পরই সম্বিত হারান ১৯৪২ সালে? না। ট্র্যাজিডিটি বরং তাঁর মহৎ কীর্তির প্রতি বর্ধিত দৃষ্টি আকর্ষণ করার কারণ হওয়ার কথা। বাস্তবে হয়েছে বিপরীত। যে-নজরুল বিশের দশকে বাংলার কাব্যজগতে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে ত্রিশের দশকে বাংলার সংগীতজগতের নায়করূপে বরিত হয়েছিলেন, সম্বিত হারানোর পর থেকে বারোটি বছর সে-নজরুলের শিল্পকর্ম তাঁর কর্মক্ষেত্র কলকাতাতেই সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে রইল।
নজরুল বিষয়ে প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করেন আজহারউদ্দীন খান (১৯৩০- ), ১৯৫৪ সালে তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থটি প্রকাশ করে (প্রকাশক, ক্যালকাটা বুক ক্লাব, ডিমাই পৃষ্ঠা সংখ্যা ২১২)। ৫০ বছর পর বইটি ২০০৪ সালে প্রকাশিত, বহুগুণ পরিবর্ধিত সপ্তম সংস্করণও আলোকঋদ্ধ হওয়ার চেয়ে তথ্যসমৃদ্ধই হয়েছে বেশি (প্রকাশক, সুপ্রিম পাবলিশার্স, রয়েল পৃ. ৮০৮)। এর পর ১৯৬০ সালে প্রকাশিত ড. সুশীলকুমার গুপ্ত’র (১৯২৬-৯৭) ‘নজরুল-চরিতমানস’ গ্রন্থটি বাঙালীর সংস্কৃতিতে নজরুলের যথাযথ অবস্থান নির্ণয় করে সুধীসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বটে তবে বেশ কিছু বিভ্রান্তিও ছড়িয়েছে। বর্তমানে বাজারে আছে কিছু নতুন তথ্য ও তত্ত্ব সংযোজিত গ্রন্থটির তৃতীয় দে’জ সংস্করণ। বইটি সংগীত-অংশে দীনতর। ক্রিয়াত্মক ও তত্ত্বীয় সংগীতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় আছে, তেমন পাঠকের মনে হবে ড. গুপ্ত’র অনেক ধারণাই ধার করা এবং ভুলে ভরা। কয়েকটা নমুনা:
‘বস্তুতঃ রবীন্দ্রসংগীতের সুরবৈচিত্র্য আর কোন ভারতীয় সুরকারের রচনায় দেখা যায় না।’ (পৃ.৩২০)।
‘আমার মনে হয় সবদিক বিচার করলে বীর্যব্যঞ্জক গানে নজরুল দ্বিজেন্দ্রলালের চেয়েও বড় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বী।’ (পৃ. ৩৪৬)।
‘মানবিক প্রেমগীতির মধ্যে নজরুলের গজলগুলি সর্বোৎকৃষ্ট।… তাঁর অন্যান্য প্রেমগীতিতে রবীন্দ্রপ্রভাব বিশেষভাবে অনুভূত হয়।’ (পৃ. ৩৩৭)।
‘তাঁর শ্যামাসংগীত রামপ্রসাদের আদর্শে রচিত। কীর্তন, বাউল প্রভৃতি গানে নজরুলের উপর রবীন্দ্রপ্রভাব খুবই বেশী।’ (পৃ. ৩৩৭)।
তবু বহু মূল্যবান উপাত্তের আকর এই গ্রন্থদুটির ঐতিহাসিক ভূমিকা বিরাট, যথা—ওই হন্তারক দুর্দিনে বিস্ময়কর কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে দ্রুতবিস্মরণশীল কালটিতে সার্বিক তথ্যাবলী তুলে ধরা এবং তা দুই মলাটের ভেতরে সংরক্ষণ করা।
সমসময়ে নজরুলের রচনাবলী সংরক্ষণের হাল ধরেছিলেন নজরুল গবেষণার পথিকৃৎ আবদুল কাদির। তাঁর উদ্যোগে প্রথমে পাকিস্তান পাবলিকেশন্স থেকে নজরুল-পরিচিতি নামে প্রবন্ধসংকলন বের হয় ১৯৫৯ সালে এবং নজরুল রচনাসম্ভার প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে ঢাকা থেকে, তবে সম্পাদকের নাম ছাড়া। গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ আবদুল কাদির সম্পাদিত বলে কলকাতার হরফ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে, কিন্তু সেটিও সম্পাদকের সমজদার প্রবেশক কিংবা রসগ্রাহী ভূমিকা ছাড়া।
চল্লি¬শের দশকের শেষ ও পঞ্চাশের দশকের প্রথমাংশে সম্বিতহারা নজরুলের শিল্প সম্পর্কিত চর্চা বিঘ্নিত হওয়ার বেশকিছু প্রসঙ্গবহির্ভূত কারণও ছিল যথা—মহাযুদ্ধ, মহাদুর্ভিক্ষ, দাঙ্গাহাঙ্গামা, দেশভাগ, সংগীতশিল্পীসহ গুণীজনদের বিপুলহারে দেশান্তরী হওয়া ইত্যাদি। অনতিবিলম্বেই অবশ্য বিখ্যাত নজরুলসংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম ও তাঁর স্বামী নজরুলসংগীতের অন্যতম পুরোধাপুরুষ কমল দাশগুপ্ত কলকাতায় ফিরে গিয়ে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীদের দিয়ে নজরুলগীতির এলপি বের করার উদ্যোগ নেন। প্রথমদিককার খ্যাতনামা নজরুলসংগীতশিল্পী সন্তোষ সেনগুপ্তের পরিচালনায় লাভ সঙ্স অব নজরুল শীর্ষক প্রথম এলপি-টি সুপারহিট হতেই বলতে গেলে সেখানে নজরুলচর্চার পুনরভ্যুদয় হয় যথাযোগ্য উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে। ষাটের দশকের শুরুতে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় নজরুলের উদ্দীপনী সংগীতনিচয় কলকাতার বেতার ও মঞ্চ মারফত জনগণকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে এবং এই প্রক্রিয়ায় নজরুলচর্চাও পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
তবে নজরুলচর্চার দ্বিতীয় অধ্যায় ইতিমধ্যেই স্থানান্তরিত হয়ে যায় কলকাতা থেকে ঢাকায়, বলা যায় একরকম অলক্ষ্যেই। অতঃপর নজরুলসংগীতের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে এদেশের বেতার-টিভি ছাড়াও ঢাকার ঐতিহাসিক কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যেমন, পঞ্চাশের দশকের বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, ষাটের দশকের ছায়ানট, সংগীত মহাবিদ্যালয়, নজরুল একাডেমী, সত্তরের দশকের হিন্দোল, দোলনচাঁপা, সংগীতভবন প্রভৃতি বহুবিধ বিষয়বস্তুবিশেষজ্ঞ সংগীতপ্রতিষ্ঠান। নজরলের সাহিত্য ও সংগীতের উভয় ক্ষেত্রেই অমূল্য অবদান রাখছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত নজরুল ইন্সটিটিউট। এইসব প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত অনুধ্যানের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সংগীত সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা শুরু হয় সত্তরের দশক থেকে এবং বাংলাদেশেই। এখানে মূল্যবান কাজ করে যাচ্ছেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম নজরুলসাহিত্যে (কাজী নজরুল ইসলাম/জীবন ও সৃষ্টি, নজরুল প্রসঙ্গে প্রভৃতি) এবং ড. করুণাময় গোস্বামী নজরুলসংগীতে (নজরুল-গীতি প্রসঙ্গ, বাংলা কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান ইত্যাদি)। ‘নজরুল ইন্সটিটিউট’-এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দও নজরুল গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন।
প্রকৃতপক্ষে সংগীতশিল্পী নজরুল হাঁটতেন জনতার মিছিলে—গান লিখতেন মজলিশে বসে, সুর করতেন রিহার্সেলরুমের কোলাহলে, গান গাইতেন ঘরোয়া জলসায়, কলকারখানায়, জনসভায়, গণমিছিলে। সংগীতসৃজনরত নজরুলকে দেখতে চাইলে পাঠক কবি জসীমউদ্দীনের চোখে একনজর দেখতে পারেন:
‘আমি দেখিয়াছি গ্রামোফোন কোম্পানীতে নানা ধরনের গানের হট্টগোলের মধ্যে কবি বসিয়া আছেন—সামনে হারমোনিয়ম—পাশে অনেকগুলি পান আর গরম চা। ছ’সাতজন নামকরা গায়ক বসিয়া আছেন কবির রচনার প্রতীক্ষায়—একজনের চাই শ্যামাসংগীত, অপর জনের কীর্তন, একজনের ইসলামী সংগীত, অন্যজনের ভাটিয়ালী গান—আরেকজনের চাই আধুনিক প্রেমের গান। এঁরা যেন অঞ্জলি পাতিয়া বাসিয়া আছেন। কবি তাঁহার মানস-লোক হইতে সুধা আহরণ করিয়া আনিয়া তাঁহাদের করপুট ভরিয়া দিবেন। কবি ধীরে ধীরে হারমোনিয়াম বাজাইতেছেন, আর গুন্গুন্ করিয়া গানের কথাগুলি গাহিয়া চলিয়াছেন। মাঝে মাঝে থামিয়া কথাগুলি লিখিয়া লইতেছেন। এইভাবে একই অধিবেশনে সাত-আটটি গান শুধু রচিত হইতেছে না—তাহার সুর সংযোজিত হইয়া উপযুক্ত শিষ্যের কণ্ঠে গিয়া আশ্রয় লইতেছে।’ (সংগীত-তত্ত্ব, নজরুল প্রসঙ্গ: দেবব্রত দত্ত সংগীত প্রভাকর, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮)।
১০.
‘কাব্য ও সুরবৈভব একই সুরসূত্রে সম্পৃক্ত করে মালাকার (নজরুল) তাঁর উত্তরসুরীদের জন্য যে সুরগীতি সৃষ্টি করে গেছেন তার সত্যিকারের মূল্যায়ন আজও সম্ভব হয়নি। কবি নজরুল সংগীত জগতে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুরকার। যা, কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করার উপায় নেই। সুতরাং এই সুরের যাদুস্পর্শ একদিন জনচিত্ত জয় করবেই।’ [ পৃ. ৪৮, সংগীত-তত্ত্ব (নজরুল প্রসঙ্গ), তৃতীয় সংস্করণ, দেবব্রত দত্ত, সংগীত প্রভাকর, ব্রতী প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯১]।
তা জনচিত্ত ইতোমধ্যেই জয় করেছে নজরুলসংগীত। বরং বলতে হয় যে একমাত্র নজরুলের গানই তার সহজসরল কথা, মনোরঞ্জক সুর ও স্বভাবগত গতিক্রিয়ার জাদুবলে জনচিত্ত বা আমজনতার চিত্ত জয় করেছে, যা রবীন্দ্রনাথের গান করেনি; তার জটিল ভাবগত ও গভীর প্রকৃতিগত কারণে। অথচ এই জনগণচিত্ত জয় করাটা গানের জন্য একান্তই জরুরি। কারণটা একটু সবিস্তারেই বলছি।
আধুনিক জীবনের অতি-দ্রুত গতি, বিহ্বল প্রকৃতি, রুদ্ধশ্বাস লয়-তাল, ভোগাসক্ত মানুষের ভোগজনিত ক্লান্তি, সর্বাত্মক প্রতিযোগিতার লাগাতার চাপ ইত্যাদির ক্রমপুঞ্জিত টেনশন ঈষৎ ভুলিয়ে রাখতে চারুশিল্পগুলির মধ্যে একমাত্র সংগীতই সক্ষম। পরিশ্রান্ত মনে সহজতর সাহিত্যের চেয়েও দুরূহতর সংগীতেরই উপভোগ সম্ভব হয়। কারণ, একমাত্র এই চারুশিল্পটিই পারে মগজকে না-খাটিয়েও হৃদয়কে মাতিয়ে তুলতে। কেবল সংগীতই পারে তার স্বয়ংক্রিয় চালিকাশক্তি দিয়ে ক্লিষ্ট চিত্তটিকে মুহূর্তে উদ্দীপ্ত করে দিতে।
শাস্ত্রীয় সংগীতের সুরধ্বনি প্রস্তুতিহীন শ্রোতার মনকেও ব্যাকুল করতে পারে। নির্মিতিহীন পাঠকের মনের ওপর কাব্যশিল্পের আবৃত্তি তা করতে পারে না। একই কারণে, সিডি-রম্ বাদিত কাব্য-নাট্য-গল্প-উপন্যাসও পারে না এমপিথ্রি বাদিত সংগীতশিল্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে। কেননা, প্রি-রেকর্ডেড্ কাব্য-নাট্যাদি শ্রবণের সমান্তরাল ক্রিয়া হিসাবে অন্য কোনো কর্ম সম্পাদন করা চলে না—যেমন চলে সংগীতশ্রবণের পাশাপাশি। চিত্র, ভাস্কর্য প্রভৃতি চারুকলা তো আলোচ্য ক্ষেত্রে সংগীতের কোনো প্রতিযোগীই নয়। সংগীতের তুলনায় ওরা বড় জোর ইন্টারনেট-স্ক্রীনের নিঃশব্দ-নিষ্প্রাণ স্থিরচিত্রবিশেষ।
এ ছাড়া বড়ো একটি যুগোপযোগী বৈশিষ্ট্যও রয়েছে সংগীতের। সে হচ্ছে, এই সুকুমারশিল্পটি যে-কোনো চারুশিল্পের চেয়ে অধিকতর গণতান্ত্রিক। সংগীতশ্রবণ শ্রোতাকে ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন দ্বীপে নির্বাসিত করে না—যেমন করে পুস্তকপঠন, চিত্রদর্শন, ভাস্কর্যবীক্ষণ প্রভৃতি। অন্যান্য চারুকলার রসাস্বাদন মানুষকে তার পরিকর-পরিজন থেকে বিযুক্ত করে ফেলে, যেখানে সংগীতকলার রসোপভোগ সকলকে সংযুক্ত করে। বস্তুতপক্ষে সংগীতশ্রবণ দলেবলেও চলে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল কর্মসংগীত, যা কর্মের সহায়ক পটভূমি রচনা করে এবং কর্মগান বা ওয়ার্ক্-সঙ্, যা কর্মীগণ নিজেরা করেই প্রাণিত হন। তাই হাটে-বাটে-মাঠে-ঘাটে তথা সদরে কিংবা দফতরে—এককথায় জলেস্থলে যেখানেই যতক্ষণ মানুষ জাগে, সেখানেই ততক্ষণ মিউজিক বাজে।
সংগীত এখন, শ্রমের এবং বিশ্রামের, উভয়েরই সমান সঙ্গী। এই সদাসক্রিয় সুহৃদটি আজ জীবনসংগ্রামী সকল গণমানুষেরই শেষ প্রেরণা এবং অন্তিম ভরসা। তার পাশে যখন আর কেউ থাকে না তাকে পরামর্শ, উৎসাহ বা সান্ত¡না দেবার জন্য; তখনো থাকে বেতার-বাহিত সংগীত। যেমন নির্জন চরাঞ্চলে চাষবাসের সময়, অঘোর অরণ্যে কাঠকাটার প্রহরে, গভীর সমুদ্রে মাছধরার সমরে তথা মরু-পথহারার সুনসান দুষ্কালেও স্বজনবিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গতম জীবিকাসন্ধানীটি তার কর্মসঙ্গী হিসেবে, এমনকি মর্মসঙ্গীরূপেও, একমাত্র সংগীতকেই কাছে পায়।
এদিকে গ্রাম-গঞ্জ-শহরের জনপদেও কর্মক্লান্ত দিনের শেষে মানুষ যখন ফুরিয়ে গিয়ে ঘরে ফেরে, তখন সংগীতেরই নিজস্ব সম্মোহ তার স্বয়ংক্রিয় শক্তিবলে শ্রোতার সর্বসত্তায় পরিব্যাপ্ত হয়ে জীবন্মৃতকেও জীবন্ত করে তোলে। মোদ্দা কথা: জনসাধারণের অস্বস্তিকর অস্থিরতার টেনশান্-শাসিত এই উদ্বেগজনক বিশ্বে গণসংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুটি আজ স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছে একমাত্র সংগীতেরই স্বস্তিকর অঙ্গনে।
সেই গণসংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুর সঙ্গে বহু সূত্রে যুক্ত হতে পেরেছে নজরুলসংগীত—তার বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবীশ্রেণির জাগরণের গান নিয়ে। নারী-জাগরণের গান, যুব-জাগরণের গান, ছাত্রদলের গান, অসাম্প্রদায়িকতার গান আর হিন্দু-মুসলিম মিলনের গান নিয়ে। লেটোর গান, ভাঙার গান, সর্বহারার গান, মার্চের গান এবং সাম্যের গান নিয়ে। মুসলিম-ভক্তিগীতি, হিন্দু-ভক্তিগীতির সঙ্গে লোকগীতি, পল্লীগীতি নিয়ে। ভাটিয়ালি, সাঁওতালি, খেমটা, ঝুমুর, গজল এবং ভাঙা ঠুংরি নিয়ে। এমনকি বিচিত্র হাসির গানের বিরাট একটি ডালি নিয়েও বাংলার আপামর জনসাধারণকে মাতিয়ে দিয়েছে নজরুলসংগীত। তুলনায় রবীন্দ্রসংগীত থেকে গিয়েছে কেবলি শহুরে এবং যুক্ত হয়েছে শহরেরও প্রধানত এলিট শ্রেণিটিরই সঙ্গে।
কেবল নজরুলের গান গেয়েই খ্যাতি কুড়াচ্ছিলেন বলে তখনকার শ্রেষ্ঠ গায়কগায়িকাগণ নতুন নতুন গানের জন্য দিবারাত্র কেবল তাঁকেই ঘিরে থাকতেন। কারণ, পঞ্চপ্রধান সংগীতস্রষ্টার মধ্যে একমাত্র সমাজ ও জীবনঘনিষ্ঠ কাজী নজরুলই মানুষের কাছে যেতেন, মানুষের সঙ্গে মিশতেন, মানুষের মধ্যে থাকতেন, পরাধীনতাবিরোধী মানুষের মিছিলে ও জনসভায় নিজের লেখা গান গাইতেন এবং এইসব সূত্রে প্রত্যক্ষ প্রক্রিয়ায় যুগমানসকে জানতেন—জানতেন যুগের শ্রোতৃচিত্ত কী শুনতে চায়। আসল কথা, নজরুল গান লিখতেন পরের তরে এবং সেজন্যেই ছিলেন বহির্মুখী। তুলনায় রবীন্দ্রনাথ লিখতেন নিজের জন্য এবং এ জন্যই ছিলেন অন্তর্মুখী। নজরুলের প্রেমের গান রক্তমাংসের মানব-মানবীর এবং সে-কারণেই উদ্বেলিত আবেগপূর্ণ। তুলনায় রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানে নারীপ্রেম-প্রকৃতিপ্রেম-ঈশ্বরপ্রেম একাকার বলেই সেখানে আবেগ সমাহিত।
উদ্ভূত পরিস্থিতির এমনি পরিপ্রেক্ষিতে, বিভিন্ন বিষয়ে ইতিহাস সৃষ্টিকারী, উনিশ শতকের ত্রিশের দশকটির সংগীতক্ষেত্রে একাধারে রেডিয়ো-রেকর্ড-সিনেমা-মঞ্চসহ সকল মাধ্যমে রকমারি কাজের সুবাদে নজরুলই একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন—যখন কিনা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছয় দশকের সংগীতসৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম পর্বে সৃজনশীলতার শীর্ষে বিরাজ করছিলেন। বস্তুত রীবন্দ্রনাথের গানও জনগণের অঙ্গনে প্রথম পৌঁছেছে অতুল ও নজরুলের গানের মোটা বাদামের হাওয়ার জোরে। গুরুদেবের পাতলা পালের হাওয়া তাঁকে শান্তিনিকেতন এবং ঠাকুরবাড়ির আঙিনা থেকে বের করে বেশি দূর আনতে পারেনি—অন্য ভাষায় কথাটা বুদ্ধদেব বসু ঠিকই বলেছেন। কারণ রবীন্দ্রনাথের গান প্রধানত মানসিক, তার আত্মপ্রকাশ মুখ্যত বুদ্ধিজৈবিক। প্রতিপক্ষে নজরুলের গান হার্দিক এবং তার স্বপ্রকাশ হৃদয়বৃত্তিক।
বিশের দশকে অতুল-নজরুলের গানের জোয়ারে ভেসেই ঘর থেকে বেরিয়ে ‘রবিবাবুর গান’ ‘রবিঠাকুরের গান’ হয়েছে। ঠাকুরের সেই ভাবের গানই তাঁর শেষ পর্বে ‘রবীন্দ্রনাথের গান’ হয়ে উঠেছে—যা প্রধানত রূপেরই গান এবং গভীর উপলব্ধির। প্রতিপক্ষে নজরুলের গান ভাবের এবং তার আত্মপ্রকাশ আবেগপ্রধান। গানে নজরুল সর্বদা উপস্থিত-শ্রোতাকেই সম্বোধন করেন। জনচিত্তমুখিতাই নজরুলসৃষ্ট নব্য-আধুনিকতার মূলকথা। সংগীতে এত কালের অন্তর্মুখিতার বদলে নজরুল-আনীত বহির্মুখিতা তাঁর গানের তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা লাভের এবং শ্রোতৃসমাজের কাছ থেকে উচ্ছ্বসিত সাড়া পাওয়ার একটা বড়ো কারণ। তাৎক্ষণিক সে-জনাদৃতি কালজয়ী হয়ে সমানে বিদ্যমান আছে অদ্যাবধি।
১১.
তবু বাংলা গানের শিরোপরে প্রজ্বলন্ত এই দুই লণ্ঠনের আপেক্ষিক অবস্থানটি কিছু দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে। জগতের রবি তো সর্বদাই দেদীপ্যমান থাকেন গগনের রবির মতো। বাংলা গানের আলোকস্তম্ভ সেই ‘প্রথম লণ্ঠন’-টির সমান গুরুত্ব যাচনদারদের বিচারে প্রায়শই পান না বাংলা মেলডির অনিঃশেষ নিধান ‘ঝাড়লণ্ঠন’টি। এটা ঘটে যাচাইকারীদেরই ভুলে, নজরুলের দোষে নয়। আমার ধারণায় এঁদের কারো চেয়ে কারো গুরুত্ব কম নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথ বাংলাগানের প্রাণ হলে, নজরুল বাংলাগানের মন। অবয়বী মনুষ্যের হেড অ্যান্ড হার্টের মতো, নিরবয়ব মন এবং প্রাণও সমান গুরুত্ববহ দুটো আলাদা সত্তা। তা না-হলে, দুটোকে নিয়েই গুরুদেব তাঁর স্রষ্টার অসীমে ধেয়ে যেতেন না এবং গাইতেন না ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই—’।
বাংলাভাষার অঙ্গনে কিছু বুদ্ধিজীবী এতোই প্রভাবশালী যে, তাঁদের ছিঁটেফোটা মন্তব্যই অন্যদের চিন্তাভাবনার সীমা নির্ধারণ করে দেয়। নজরুল সম্পর্কে এ ধরনের সীমা নির্ধারণকারী স্থায়ীভাবে গ্রন্থিত আছেন এমন তিনজনকে নিয়ে এখানে একটু আলোচনা আমি জরুরি ভাবছি। এঁদের প্রথমজন যুগপৎ সাহিত্য ও সংগীতব্যক্তিত্ব ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দ্বিতীয়জন সাহিত্যব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসু এবং তৃতীয়জন সংগীতগুণী রাজ্যেশ্বর মিত্র।
ধূর্জটিপ্রসাদ ১৩৩৬ সালের শ্রাবণ সংখ্যা ‘সংগীতবিজ্ঞান প্রবেশিকা’ পত্রিকায় ‘আজকালকার গান’ শিরোনামে সমকালীন গান সম্পর্কে তাঁর স্বভাবসুলভ কিছু তুচ্ছতাচ্ছিল্য মন্তব্য করেন। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে, তখনকার নজরুলের সংগীতখ্যাতির প্রধান ভিত্তি কেবল বছর তিনেকের সৃষ্টি গজল হলেও—বাংলার গানে সেই অভিনব সংযোজন বাঙালিকে নতুন ঢঙের নতুন সুরের নতুন উন্মাদনে তদ্দণ্ডেই অভিভূত করে ফেলেছিল। শ্রীমুখোপাধ্যায় তাঁর রচনায় অনেক প্রগল্ভতা ও সস্তা কথামালার পরম্পরায় লেখেন:
‘গত মাসে প্রায় দশ-বারোটি প্রতিভাশালী যুবক-যুবতীর গানবাজনা শুনলাম। তাদের মধ্যে মাত্র দুইজন রবিবাবুর গান গাইলেন, বাকী সব কার গান গাইলেন বুঝতে পারলুম না। সন্দেহ হল অতুলপ্রসাদের কিন্তু তাঁর নয়—তিনি নিজে অস্বীকার করলেন। শুনলাম সেগুলি কাজী নজরুলের। সত্য মিথ্যা জানি না। তাতে ছন্দের কিছু বৈচিত্র্য আছে বটে, কিন্তু মানে নেই মনে হল। তাতে সুরের একটা গতি আছে কিন্তু সে গতি অত্যন্ত হালকা এবং নিতান্তই একঘেয়ে। তাতে গজল ঠুংরি, লাউনীর মাধুর্য আনবার প্রয়াস আছে, কিন্তু সে মাধুর্য একেবারে ঝুটা। ঢাকার মুসলমানের উর্দুর সঙ্গে লখনৌ নবাবের উর্দুর যা তফাত, ভাটপাড়ার ভটচায্যি মশাই-এর সংস্কৃত পাঠের সঙ্গে এই বাংলাদেশের অভিনব ঠুংরির তফাত তাই। পশ্চিমাঞ্চলের ঠুংরি গজল শোনবার বিশেষত বাঈজীর মুখে শোনবার সৌভাগ্য যার ঘটেছে সেই বুঝবে এই তফাত কোথায় এবং কতখানি।’ (আজকালকার গান, পৃ. ১৮৬, ধূ.র. ৩য় খ-)।
‘এ বৎসর কলকাতায় এসে দেখছি যে কাজী নজরুলের গান দেশ ছেয়ে ফেলেছে। তাঁর সুরও ঠুংরি গজল নয়। তাঁর দেওয়া অনেক সুর শুনতে ভাল লাগলেও সুর হিসাবে খুব উচ্চ শ্রেণীর নয়। সুর-সৃষ্টি হিসাবেও তার মূল্য খুব বেশি নয়। অনেক সময় তাঁর সুর বাজারের ঠুংরি গজলের অনুকরণ মাত্র। যেখানে তিনি অনুকরণ করেননি, সেখানে তাঁর সুর রচনা অত্যন্ত ভষধঃ সাদামাঠা হয়েছে। আমার বিশ্বাস এই হালকা সুরের জন্য তাঁর গলা এবং কবিতা প্রধানত দায়ী। তাঁর গলা মোড় খায় না, তাঁর গলায় তান নেই, মীড় নেই। এই অভাবের জন্য তাঁর রচনার ক্ষতি হয়েছে। গান রচনার বাহাদুরী অলংকার ফোটাবার অবকাশ দেওয়া—যেমন স্বরবর্ণের প্রাচুর্য। কাজীর কবিতা সব ঠাস্বোনা, (অতুলপ্রসাদের নয়) ব্যঞ্জনবর্ণ সেখানে প্রধান। কাজী মনে মনে জানেন যে তাঁর গলা নেই, সেইজন্য গলার দোষ ঢাকবার জন্য তাঁর কলম ব্যঞ্জনবর্ণই ব্যবহার করতে উৎসুক এবং তালপ্রধান ঠুংরি গজলের ছাঁচে গান লিখতে ব্যগ্র—দুর্বলতার ক্ষতিপূরণ করতে। অতুলপ্রসাদের গলায় চমৎকার ছোট ছোট তান আছে, তাঁর গান গাইতে হলে ছোট তানের দরকার। সেইজন্য সকলেই কাজীর গান গাইতে পারে এবং সকলে অতুলপ্রসাদের গান গাইতে পারে না।’
এসব বেহুদা বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ ছাপান বিখ্যাত সংগীতব্যক্তিত্ব নলিনীকান্ত সরকার একই পত্রিকায়। নজরুলের গজল সম্পর্কে ধূর্জটিবাবুর হুবহু বিপরীত মত পোষণ করেন সংগীতগুণী ও সুগায়ক দিলীপকুমার রায় এবং তা তিনি ব্যাখ্যা সহকারে লেখেনও। অধিকন্তু শ্রীরায় স্বহস্তে স্বরলিপি প্রস্তুত করে ‘নজরুলিয়া’ গজল প্রচারের চেষ্টাও করেছিলেন।
ধূর্জটিবাবুর এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধদেব বসুর একটি মন্তব্যও স্মর্তব্য—‘ঐতিহাসিক কারণে দু-জনের নাম (অতুল ও নজরুলের) একসঙ্গে করতে হলেও প্রবীণতর ব্যারিস্টার-গুণীর তুলনায় নজরুলের প্রাধান্য প্রথম থেকেই স্পষ্ট, এখন স্বতঃসিদ্ধ। একে-তো কবিত্বে কোন তুলনাই হয় না, তার উপর সংগীতেও নজরুলের ক্ষমতা বড়ো, প্রাচুর্য বেশি, বিচিত্র বহুমুখিতা—রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে—অনন্য। অতুলপ্রসাদের বৈশিষ্ট্য, শেষ পর্যন্ত, এইখানে যে চিরাচরিত ভারতীয় ভক্তিরসে নিজস্ব একটি নিবিড়তা তিনি এনেছিলেন; কিন্তু নজরুলের মৌল উপকরণই অংশত অপূর্ব বলে বাংলা গানের সামগ্রিক গতিরই তিনি মোড় ফেরালেন। এটা লক্ষণীয় যে রচনার প্রবলতা এবং পরিমাণ, আর সেই সঙ্গে বিরল ব্যক্তিগত মনোহারিতা সত্ত্বেও, সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে নজরুলের প্রভাব ক্ষণস্থায়ী বা নামমাত্র; কিন্তু সংগীতে তিনি প্রবর্তক, প্রজনক; …’ (’বাংলার গান’, চতুরঙ্গ: সংখ্যা ৪ মাঘ ১৩৫৫)।
তবে শ্রীবসুও নজরুলসংগীতকে যথোচিত গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করেননি। ফলে বঙ্গীয় সংস্কৃতির আজকের প্রজন্মেরও পরমপূজ্য এই গুরুর অনেক অর্ধমনস্ক মন্তব্য রদবদল ব্যতিরেকে তাঁর রচনাবলীতে স্থায়ীভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নজরুলের গানের চিরন্তন অবমূল্যায়ন করে চলেছে। ‘নজরুল ইসলাম’-নামের প্রবন্ধটি বুদ্ধদেব লিখেছিলেন ১৯৪৪ সালে, যেটি সংকলিত হয় তাঁর কালের পুতুল গ্রন্থে এবং ১৯৬৬ সালে অন্তর্ভুক্ত হয় তাঁর ভারবি-প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন-এ। ধূর্জটিপ্রসাদের মতো সংগীততাত্ত্বিক না হলেও অতীব সংগীতসচেতন ছিলেন বুদ্ধদেব এবং বাংলা গানের বিবর্তনের ঐতিহাসিক ধারাটি সম্পর্কেও ছিলেন যথেষ্ট অবহিত। সঙ্গীতে তাঁর অধিকার বেশ সমীহ আদায় করে, কবিতার মতো অতটা না-হলেও।
রচনাটিতে বুদ্ধদেবের যে-মন্তব্য দুটি নিতান্তই ভ্রান্ত, তার একটি হলো ‘বীর্যব্যঞ্জক গানে চলতি ভাষায় যাকে স্বদেশী গান বলে—রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের পরেই তাঁর (নজরুলের) স্থান হতে পারে।’ অর্থাৎ বর্ণিত ক্ষেত্রে ওই দুজনের পরের স্থানটিও নজরুলের হবে কি না তা নিয়েও সংশয় আছে বুদ্ধদেবের। প্রকৃত অবস্থাটি কিন্তু বিপরীত বলেই আজ সংগীতের আমজনতা থেকে খাসমহল পর্যন্ত সকলেই অবহিত যে—বীররসাত্মক গানের সৌকর্যে, প্রাচুর্যে, বৈচিত্র্যে ও প্রতাপে নজরুলের স্থান নিশ্চিতভাবেই রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলালসহ সকলেরই অগ্রে। শ্রীবসুর দ্বিতীয় ভ্রান্ত মন্তব্যটি হল—“বুলবুল ও ‘চোখের চাতকে’ কিছু কিছু রচনা পাওয়া যাবে, যাকে অনিন্দ্য বললে অত্যন্ত বেশি বলা হয় না। আরো বেশি গান যে অনিন্দ্য হয়নি, তার কারণ নজরুলের দুরতিক্রম্য রুচির দোষ।”
প্রকৃতপক্ষে, অনিন্দ্য হয়েছে কেবল ‘আরো বেশি গান’ নয়, আরো অনেক বেশি গান। বরং বলা যায় যে নজরুলের যত সংখ্যক গান অনিন্দ্য হয়েছে তত সংখ্যক গান দ্বিজেন্দ্র, অতুল অথবা রজনী লেখেনই নি। রুচির দোষহেতু বর্জন করার জন্য নজরুলের হাজারখানেক গান বেশি আছে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও। বস্তুত সুবিপুল সংখ্যক গানেই নজরুল তাঁর রুচির দোষ অতিক্রম করতে পেরেছেন। অবশ্য বুদ্ধদেবও নজরুলের রুচির দোষকে ‘অনতিক্রম্য’ বলেননি, বলেছেন ‘দুরতিক্রম্য’। একই রচনায় তিনি অন্যত্র লিখেছেন, ‘বিদ্রোহী কবি, ‘সাম্যবাদী’ কবি কিংবা সর্বহারার কবি হিশেবে মহাকাল তাঁকে মনে রাখবে কিনা জানি না, কিন্তু কালের কণ্ঠে গানের যে-মালা তিনি পরিয়েছেন, সে-মালা ছোটো কিন্তু অক্ষয়।’
বুদ্ধদেব বসু কথিত কালের কণ্ঠে পরানো নজরুলের অক্ষয় গানের মালাটি ছোটো নয়। বস্তুত মালাটি এতো বড় এবং বৈচিত্র্যময় যে বহুমাত্রিক সে-মালাটি গাঁথার সাত দশক পরে এই তৃতীয়-চতুর্থ প্রজন্মের গানের আসরেও নজরুল বসে রয়েছেন ফোকাসের কেন্দ্রে রবীন্দ্রনাথের পাশে, যখন কিনা বাংলা কাব্যগীতির অন্য প্রধানগণ পড়ে আছেন ফোকাসের বাইরে। এ-কারণেই বাংলা গানের ভুবনে আজ নিত্যশ্রুত শব্দবন্ধ শুধুমাত্র দুটি—রবীন্দ্রসংগীত আর নজরুলসংগীত। এই দুই সংগীতেরই বিখ্যাত গবেষক ড. করুণাময় গোস্বামী নজরুলের আলোচ্য গানের মালাটিকে বর্ণনা করেছেন এভাবে:
‘বিচিত্রভাবের, বৈচিত্র্যময় বাণীগৌরবের, বৈচিত্র্যবহুল সাংগীতিকতার বহুসংখ্যক গানের পুষ্পে গড়া কালের কণ্ঠে দোলানো সেই মালা। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অপর কোন বাঙালি সংগীতরচয়িতা কালের কণ্ঠকে এমন উজ্জ্বল মালিকা দ্বারা সুশোভিত করতে পারেননি।’ (পৃ. ৫২০, নজরুল গীতি প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা)।
নজরুলসংগীতের উল্লিখিত অবমূল্যায়নের কালপর্বেই রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কিত কিছু অতিকথনও শ্রবণ প্রয়োজন, যাকে নারায়ণ চৌধুরী তাঁর রাগসংগীত ও লোকসংগীত শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন ‘রবীন্দ্রসংগীতের মাত্রাতিরিক্ত প্রচার’:
‘শুধু অনন্যই নন, অন্যেরা যখন খণ্ডিত তিনি (রবীন্দ্রনাথ) তখন পূর্ণতায় ভরা।… কেন জানি মনে হয়, বাংলা গানের চলার পথে তিনি (রবীন্দ্রনাথ) যেন সেই জংশন ইস্টিশনটি যেখানে এসে রেল গাড়িটিকে বেশ কিছুক্ষণ থাকতেই হবে। … অনেকদিন, অনেক কাল তো পার হয়ে গেল, গাড়িটা এখনো কেন ইস্টিশান ছাড়ে না? তবে এই কি সেই সব পেয়েছির দেশ যেখান থেকে অন্য কোথাও যাওয়ার আর প্রয়োজন নেই? কি জানি, হয়তো তাই।’ [‘দেশীগান: রবীন্দ্রনাথ’, পৃষ্ঠা ৪২, রবীন্দ্র সংগীতের নানাদিক, বীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সম্পাদিত]।
এমনি পরিবেশে এবং সম্ভবত ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত স্বনামধন্য সংগীততাত্ত্বিক এবং দেশ পত্রিকার শার্ঙ্গদেব-ছদ্মনামী সংগীতসমালোচক রাজ্যেশ্বর মিত্রের দুটি গ্রন্থের পরিপ্রেক্ষিতে, সাহিত্য ও সংগীত উভয় ক্ষেত্রের অভিজ্ঞ ভাষক এবং লেখক, নারায়ণ চৌধুরী তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ সংগীত পরিক্রমায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন:
‘অধুনা রবীন্দ্রসংগীতের সর্বব্যাপী জনপ্রিয়তার আবহাওয়ার ভিতর নজরুল সংগীতকে খাটো করবার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। একে ঠিক সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্র বলতে চাই নে, তবে চারিদিকে যে নজরুল-সংগীতের বিরুদ্ধে একটা ফিসফাস-গুজগাজের অভিযান চলছে সে লক্ষণ অতি স্পষ্ট। এই অভিযান অচিরেই স্তব্ধ হওয়া দরকার।’ [পৃ. ১৯৫, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৬৪]।
সংগীতে চালকের আসনে আসীন সুর, কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছেন যে গানে কথা আর সুরের মধ্যে কে বড় আর কে ছোট সে-বিচার সঙ্গত হয় না। তবু তা করতেই যদি হয়, তবে বলতে হবে সেক্ষেত্রে ‘সংগীত’ই স্বামী। তবু তাঁর অতি-ভক্তের দল মনে করেন ‘কথা’ই স্বামী এবং শেখান যে, রবীন্দ্রসংগীতের তুলনায় নজরুলসংগীতে কথা নিকৃষ্ট সুতরাং ওটি উৎকৃষ্ট সংগীত নয়। ফলে সংগীতশিক্ষার্থী এবং শ্রোতৃবৃন্দের মর্মমূলে এই ভুল ধারণাটি প্রোথিত হয়ে যায় যে, সংগীতে শ্রাব্যাংশের চেয়ে পাঠ্যাংশের মূল্যই বেশি। অন্যকথায়, ধ্বনিতে কথার অনুবাদের নামই সংগীত (!)।
এহেন ‘সংগীতবোদ্ধা’দের বিদ্রূপ করেই নারায়ণ চৌধুরী বলেছেন ‘আমরা তো গান শুনি না, আমরা গানের কথা শুনি। গানের কথার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে ভাবি গানের সুরের প্রেমে মুগ্ধ হয়েছি। কাজেই এই সমাজের কাছ থেকে সুরকার হিসাবে নজরুল-যে তাঁর প্রাপ্য পাবেন না সে-কথা তো সহজেই বোঝা যায়। কান আগে তৈরী হলে তবে গানের রসোপভোগ। কিন্তু হায়, শ্রুতিগত প্রস্তুতি আমাদের অনেকেরই নেই’ (কাজী নজরুলের গান, পৃষ্ঠা ২১-২২)।
শ্রীমিত্রের গ্রন্থ দুটির নাম ছিল বাংলার গীতকার এবং বাংলার গীতকার ও বাংলা গানের নানাদিক। একটা কথা তিনি দুটি পুস্তকেই লিপিবদ্ধ করেছেন, সম্ভবত অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ভেবেই—প্রথম বইটির ৯০ পৃষ্ঠায় এবং দ্বিতীয় বইটির ১২৮-১২৯ পৃষ্ঠায়। কথাটি এখানে উদ্ধৃত হল:
‘পরিশেষে সত্যভাষণের খাতিরে একটি কথা বলতে হবে। নজরুল সাহিত্য ও সংগীতের অনুরাগী কোন লেখক সুরকার হিসাবে নজরুলকে দ্বিজেন্দ্রলাল এবং অতুলপ্রসাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছেন। এমনকি তাঁর মতে স্বদেশী গান রচনায় নজরুলের কৃতিত্ব কোন কোন স্থলে রবীন্দ্রনাথেরও ওপরে। নজরুলের অত্যন্ত অনুরাগী হয়েও এই ধরনের মন্তব্যকে গ্রহণ করতে আমার প্রবল আপত্তি আছে। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল এবং অতুলপ্রসাদ আমাদের বর্তমান কাব্যসংগীতকে গড়ে তুলেছেন বললে অত্যুক্তি হয় না। সুরের বৈশিষ্ট্য, স্বকীয়তা, গভীরত্ব কোন দিক দিয়েই নজরুলের প্রতিভা এঁদের সঙ্গে সমকক্ষতা দাবী করতে পারে না। বস্তুত, এঁদের গড়া সংগীতেই নজরুল বৈচিত্র্য আনবার প্রয়াস পেয়েছিলেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ সার্থকতা লাভ করেছিলেন। এই দিক থেকেই তাঁকে আমরা একজন বিচিত্র স্রষ্টা বলে অভিনন্দিত করি এবং তাঁর রচনার ভূয়সী প্রশংসা করি। কিন্তু স্তুতির আতিশয্যে একজনকে প্রাপ্য গৌরব থেকে বঞ্চিত করে অপরকে সমধিক গৌরবান্বিত করার প্রচেষ্টা সমর্থনযোগ্য নয়। সমালোচনার প্রকৃত মূল্যই অকুণ্ঠ সত্যভাষণে নতুবা তাকে সমালোচনা বলব না, তা স্তুতিবাদেরই নামান্তর।’ [‘নজরুল ইসলাম’-শীর্ষক নিবন্ধ]।
‘ওরিয়েন্ট লংম্যান’ কর্তৃক ১৯৭০ সালে প্রকাশিত, রাজ্যেশ্বর মিত্রের উত্তরভারতীয় সংগীত-শীর্ষক গ্রন্থে আলোচ্য বিষয়ে তাঁর বক্তব্য আরও রহস্যময়। বইটির শেষ অধ্যায়ের উপজীব্য কাব্যসংগীত ও দেশাত্মবোধক গান। রবীন্দ্রনাথের কথা উল্লেখ করে লেখক বলেন:
‘এ বিষয়ে আর-একজন মহান সুরস্রষ্টা ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তাঁর ভাবগম্ভীর উদ্দীপনাপূর্ণ গানগুলি আজও দৃষ্টান্তস্থল হয়ে বিরাজ করছে। আরও পরবর্তী কালে রজনীকান্ত সেন এবং অতুলপ্রসাদ সেন বহুতর দেশাত্মবোধক এবং কাব্যসংগীত রচনা ক’রে বাংলার সংগীতের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেন।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১০২)।
আলোচ্য অধ্যায়ের শেষ সেকশনটি শেষ হয়েছে বঙ্গের উদ্দীপনীসংগীত-স্রষ্টাদের সম্বন্ধে এই বলে:
‘রবীন্দ্রনাথ লোকসংগীতের রীতি অবলম্বন ক’রে বহু স্বদেশ-সংগীত রচনা করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল প্রত্যক্ষভাবে পাশ্চাত্ত্য রীতি প্রয়োগ ক’রে একটি নতুন ধরনের উদ্দীপনার সৃষ্টি করেন। রজনীকান্ত সেন তাঁর স্বকীয়তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের আদর্শও অনুসরণ করেছিলেন। এইভাবে (কালীপ্রসন্ন ঘোষ, মনোমোহন বসু, গোবিন্দচন্দ্র রায় প্রমুখসহ) বহু কবি ও গীতিকারের রচনায় বাংলাদেশে স্বদেশ-সংগীত ব’লে একটি নূতন পর্যায় রচিত হয়েছে বলা যায়।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭)।
১৯৭০ সালে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে অখ- বঙ্গের আন্দোলনজনিত স্বদেশ-সংগীতের কথা এলে তার টানে ভারতবর্ষের স্বদেশী আন্দোলনজনিত স্বদেশ-সংগীতের উল্লেখ না-এসে পারে না, উপরিগত বা ভাসা-ভাসাভাবে হলেও। সে-উদ্দীপনী সংগীতের স্রষ্টা কাজী নজরুল, যাঁর সৃষ্টিতে উনিশ শতকের বিশের দশকের স্বদেশী যুগমানস এককভাবে প্রতিফলিত হয়ে বাংলার জনচিত্তকে অভূতপূর্বরূপে উদ্দীপিত করেছে। এ দাবি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের এবং ‘শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু’কে কবিগুরু তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছেন বঙ্গভূমে উদ্দীপনার ‘বসন্ত’ আনার জন্য, ‘নতুন ঢেউ’ আনার জন্য।
নজরুলের নামোল্লেখ করে অবমূল্যায়ন-পর্বের পরের পর্যায়ে চলে ভাসুর-জ্ঞানে তাঁকে গুমনাম করে ফেলার লীলাখেলাÑ তার মানে পরোক্ষে অনুল্লেখ্য রায় দেয়া। এ-পদেরও একটা নমুনা নেয়া যাক। জ্যোতির্ময় ঘোষ সম্পাদিত ও ১৯৭৫ সালে কলকাতার ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ’-কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’-শীর্ষক পুস্তকে সঙ্কলিত ভাস্কর মিত্র রচিত ‘বঙ্গ সংস্কৃতি ও বাঙালির সংগীত চিন্তা’-নামক প্রবন্ধটির সিদ্ধান্ত: ‘বাঙালির সংগীত সাধনাও তেমনই গানে রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদ, নৃত্যে উদয়শঙ্কর, বাদ্যে সুরেন্দ্রলাল-তিমিরবরণ-এর মাধ্যমে পরিণাম সন্ধানী…’ (পৃষ্ঠা ৬৪)। মানে বাঙালির গানে কাজী নজরুল কেউ না।
‘নজরুল-সংগীতের বিরুদ্ধে ফিসফাস-গুজগাজের অভিযান’ ‘স্তব্ধ হওয়া’র বদলে ১৯৭০ ও ১৯৭৫ সালে অভিযানটির এভাবে বেড়ে যাওয়া দেখে নারায়ণ চৌধুরী ক্ষুব্ধতর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত তাঁর কাজী নজরুলের গান-নামক গ্রন্থে লিখেছেন:
‘কোনো কোনো মহলে নজরুলের সাংগীতিক প্রতিভার অবমূল্যায়ন করার একটা প্রবণতা দেখা যায়। এই প্রবণতার সঙ্গে কায়েমী স্বার্থের সম্পর্ক আছে। তাছাড়া উত্তর ভারতীয় সংগীতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সম্পর্কে অচেতনতা কিংবা রাগ-রাগিণী সম্পর্কে অজ্ঞতাও এর একটা কারণ হতে পারে। প্রবণতাটি অশ্রদ্ধেয়, সে কথা বলাই বাহুল্য’। [পৃষ্ঠা ৮৯-৯০]।
‘পঞ্চপ্রদীপ’-অভিহিত দলে থাকলে একের সঙ্গে অন্যের অর্থহীন তুলনা চলতে থাকে—আম ভাল না জাম ভাল, তালগাছ মহৎ না বটগাছ মহৎ। এর ফলে কোনো কোনো রথী-মহারথীও ভুল রায় দিয়ে থাকেন। যেমন সংগীত-বিশেষজ্ঞ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রাজ্যেশ্বর মিত্র প্রমুখ নজরুলকে দ্বিজেন্দ্র-রজনী-অতুলের সমমর্যাদা দেননি এবং এই না-দেয়াটা তাঁদের গ্রন্থাবলিতে সংরক্ষিতও করে গেছেন। বাস্তবেও নজরুল পাঁচের ভেতরে এক ছিলেন না, ছিলেন একের ভেতরে পাঁচ। সেদিক থেকে কাজী নজরুল ইসলাম পঞ্চপ্রদীপের অন্যতম প্রদীপ কখনোই ছিলেন না, বরং লণ্ঠনও ছিলেন না—তিনি ছিলেন ঝাড়লণ্ঠন, শ্যান্ডেলিয়ার। গুরুদেবকে তো পাঁচজনের একজন ভাবাটাই পাপ। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন বাংলা গানের ‘প্রথম লণ্ঠন’টি হয়ে—সঠিক পথ দেখানোর লাইটহাউস, বাতিঘর, আলোকস্তম্ভ।
১২.
দেখা গেল যে, নজরুলের গান নিয়ে রসপ-িতদের অন্তিম সমস্যা ছিল দুটি—তাঁর রুচি নিকৃষ্ট আর কাব্য দুর্বল। বস্তুত এর একটাও এমন নয়, যার কারণে নজরুলসংগীতকে কৃপা করতে হবে।
প্রথমে ‘রুচি’ সংক্রান্ত আপত্তিটিকে বাজিয়ে দেখা যাক। আমার কথা হল, রুচির প্রশ্নে আপস না করে জনসাধারণের কাছে পৌঁছানো যায় না। সেখানে রবীন্দ্রনাথের পৌঁছাতে না-পারার অন্যতম কারণও এ-আপসটি না-করা। বিশেষজ্ঞগণ চারুশিল্পীদের শিকড় সন্ধানের এবং উৎসে ফেরার ওয়াজ শোনাবেন, বাস্তবঘনিষ্ঠতার এবং মৃত্তিকালগ্নতার সবক শেখাবেন, জনগণের কাতারে সামিল হবার তালিম দেবেন এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার নসিহত ফরমাবেন—কিন্তু জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে ‘রুচি’র প্রশ্নে অপরিহার্য ‘সন্ধি’টুকু করলেই ছি ছি করবেন, এমন দ্বৈতমান তো মেনে নেয়া যায় না। আবশ্যিক এই সন্ধিটুকু করতে পারি না বলে আমি নিজেও আমার লেখা নিয়ে জনগণের দুয়ারে পৌঁছাতে পারি না। ব্যক্তিরুচির গণ্ডি থেকে বেরুতে পারি না বিধায় অদ্যাবধি গল্প-প্রবন্ধ লিখে যাচ্ছি বুর্জোয়া ‘রুচি’র কড়াপাকের ঘিয়ে চুবিয়ে। জনগণকে সম্পৃক্ত করার গরজে কথিত ‘সন্ধি’টুকু করে থাকে ব’লে, গণসংগীত কণ্ঠে তুলে নিতেও আকৃষ্ট বোধ করি না আমি—যদিও কলম চালিয়ে বিষয়টির ওপর বই লিখে ফেলতে পারি।
এবার বাজিয়ে দেখা যাক নজরুলসংগীতের ‘কাব্য’ সংক্রান্ত আপত্তিটি। এ ব্যাপারে এখানে আমি কেবল দুজন বিশেষজ্ঞের উদ্ধৃতি দিয়েই বিদায় নেব। প্রথমে স্বয়ং সংগীততাত্ত্বিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন:
‘বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় সাহিত্যের ও সংগীতের আবেদন ভিন্ন আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া চাই।… কবিতা বুঝতেই যদি বেগ পেতে হয় তবে সেটা উৎকৃষ্ট গীতিকবিতা হতে পারে না।… সেই জন্যই বোধ হয় শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতায় দুর্বোধ্য কথার বদলে পুরাতন ও পরিচিত কথারই প্রয়োগ দেখা যায়। এখানে শ্র্রোতার দাবি খুব বেশি। গীতিকবিতায় অর্থ বোঝবার তাড়া নেই, কাজ করবার হুকুমও নেই। আছে খেয়াল, খামখেয়াল, যেটি গম্ভীর হলেও চলবে—কিন্তু সুগভীর চিন্তাধারা হলে চলবে না, হাল্কা হলেও চলবে কিন্তু তার উত্তেজনায় নেচে উঠলে চলবে না।’ [পৃ. ১২৯, কথা ও সুর, ধূ.র.খ-৩]।
আমাদের কথাও তাই। সনাতন কথাও সংগীতের হয়ে ওঠায় বাধ সাধে না। এমনকি প্রায় শূন্যগর্ভ কাব্য সার করেও পার পেয়ে যেতে পারে সংগীত। কারণ সংগীতের কাজ আকাশে উড়ে চলা অর্থাৎ ‘ফ্লাইং’। আর কথার কাজ আকাশে তোলার জন্য সংগীতকে নিয়ে মাটিতে দৌড়ে চলা অর্থাৎ ‘ট্যাক্সিয়িং’—যেটুকু কাজ মোটা কথাই সামাল দিতে পারে। বরং সেটুকু কাজের জন্য একটু স্থূল কাব্যই হতে পারে অধিক উপযোগী।
তাই নজরুলসংগীতের কথা সম্পর্কে সংগীতজ্ঞ সুকুমার রায় বলেন:
‘নজরুলের আবেগপ্রবণ ভাষা অনেক স্থলে সুর-চিন্তার সঙ্কেত হয়ে দাঁড়ায়। গানের ভঙ্গিকে গতি দান করবার উপযুক্ত ভাষা রচিত হয়।… পাঠের সময় অনেক গান এজন্যে কোথাও দুর্বল মনে হতে পারে, কিন্তু গতিপ্রবণতা নজরুলের রচনার প্রধান গুণ। গীতি সমালোচনা করতে সমালোচককে রচনার গীতিমূলকতা বা লিরিক বৈশিষ্ট্যের কথা আলোচনা করতে দেখা যায়, কেউ ‘সুরধর্মিতা’র কথা উল্লেখ করেন। কবিতার বিচারে এসব বিশেষ অর্থবোধক হতে পারে, কিন্তু গানের ক্ষেত্রে এ অতিকথন এবং গানে কথার সামান্য বিস্তারও পরিত্যাজ্য মনে হওয়া স্বাভাবিক। অর্থাৎ কবিতাকে গীতিপ্রবণ, ধ্বনি-প্রধান অথবা সুর-প্রধান বললে অর্থবোধক হয়, কিন্তু গীতির গুণ বিশ্লেষণে এসব উক্তির প্রয়োজন নেই। গীতি রচনা অন্যান্য গুণে অসাধারণ হয়। নজরুলের রচনা সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য এই যে গীতিরচনায় ও শব্দযোজনায় যে মৌলিক গতিশক্তি আছে, সুরভঙ্গি তাতে সহজ ও সাবলীল হয়ে উঠেছে। এই সম্পূর্ণ ক্রিয়াকে ‘গতি’ বলা যায়’। [পৃ ৬৭, বাংলা সংগীতের রূপ, সুকুমার রায়]।
বাংলা গানে নজরুলের অন্যতম স্থায়ী অবদান এই গতি-ক্রিয়া। নজরুলের দুর্বার গতিক্রিয়ায় সুর যে-অবাধ স্ফূর্তি লাভ করে তাতে মুগ্ধ হয়েই শতাব্দীর অন্যতমা সেরা গায়িকা আশা ভোঁসলে ১৯৯১ সালে কলকাতার সানন্দা পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন—কৃতী রূপকারের জন্য নজরুলসংগীতের তুলনা নেই। তাই তিনি একটি সিডি রেকর্ড করতে কলকাতায় এসে দুটি সিডি করে গিয়েছেন, বম্বের শিডিউল পিছিয়ে দিয়ে।
কণ্ঠসম্রাজ্ঞী আশা ভোঁসলে নজরুলের গান গেয়ে অতটাই খুশি হয়েছিলেন, যতটা অখুশি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে। ১৯৮০ সালে এইচ.এম.ভি. শ্রীসন্তোষ সেনগুপ্তের পরিচালনায় আশার কণ্ঠে বারোটি রবীন্দ্রসংগীতের একটি এল.পি. নির্মাণ করে। রবীন্দ্রনাথের গানগুলি গাইতে গিয়ে শিল্পী যে-প্রাণান্ত কষ্ট পেয়েছিলেন তা তিনি বিন্দুমাত্র ভুলতে পারেননি। এগারো বছর পর নজরুলসংগীত গাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা আশা রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার বেদনার কথা অনেক অতিরেক সহকারে বলে গিয়েছিলেন সানন্দা-পত্রিকার সবিস্তার এক সাক্ষাৎকারে। তাঁকে নাকি বলা হয়েছিল রবীন্দ্রসংগীত গাইতে হবে দাঁতে দাঁত চেপে। তিনি বলেছিলেন, দাঁতে কপাট লাগিয়ে গান গাওয়া তাঁরা শেখেন না, তাই তিনি গাইবেনও না। দাঁতকপাটি থেকে মুক্তি পেলেও ‘সুরকপাটি’ থেকে মুক্তি এক রত্তিও পাননি বেচারি। ‘এসো শ্যামল সুন্দর’ গানটির সুরের অন্তর্গত প্রবল ঝোঁকটি অনুভব করে গায়কীতে কিঞ্চিৎ শিল্পীসুলভ স্বাধিকার চেয়ে তিনি পাননি। আশা যদি জানতেন যে সে গানটির সুর আগাগোড়াই ধার করা তবে কি তিনি রেকর্ড-কোম্পানির ট্রেনারের কাছে সুরের অধিকারের দাবিতে, আরেকটু বেশি সওয়াল করতেন? (শান্তিনিকেতন-সংগীতভবনের যন্ত্রসংগীতের অধ্যাপক সুশীলকুমার ভঞ্জ চৌধুরীর তৈরি করা সেতারের একটি গতের সুরে রবীন্দ্রনাথ শুধু কথা বসিয়ে দিয়েছেন ‘এসো শ্যামল সুন্দর…মঞ্জীর রুণু রুণু’-গানটির (পৃ. ৭২১-৭২২, গীতবিতানের জগত, সুভাষ চৌধুরী, প্যাপিরাস, কলকাতা)।
সাক্ষাৎকারটিতে আশা ভোঁসলের সারকথাটি ছিল—যারা গাইতে জানে, তাদের জন্য নজরুলসংগীত; আর যারা গাইতে জানে না, তাদের জন্য রবীন্দ্রসংগীত। কথাটিকে কেবল গায়িকার ব্যক্তিগত ক্ষোভের অভিব্যক্তি হিসেবেই নিতে হবে। বড়জোর তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে নজরুল সঙ্গীতে গায়কগায়িকার শৈল্পিক অভিব্যক্তি অন্তরীণ নয়। (নজরুলের গানে রূপকারের শৈল্পিক অভিব্যক্তি-যে অন্তরীণ নয়, সেকথাটি কবি ১৯৩১ সালে কলকাতার ডি. এম. লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত তাঁর নিজের-করা নজরুল-স্বরলিপি গ্রন্থে কার্ফা তালের মান্দ্ ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি’র স্বরলিপির পাদটীকায় লিখে গিয়েছেন—‘উল্লিখিত অন্তরাগুলিকে প্রথম অন্তরার সুরেই গাহিতে হইবে; তবে প্রথম অন্তরার “জ্বালা” কথাটির উপর গজলের সুরেই কাজের যে “চং”-এর নিদর্শন দেওয়া হইল, অপরাপর অন্তরায় বাক্যবিশেষের উপর আর্টিস্ট পৃথক পৃথকভাবে সুরের কাজের সৃষ্টি করিয়া গানের একঘেয়েমি ভাব দূর করিবেন, এই আশায় অন্য অন্তরাগুলির কেবল ছন্দ ভাগ করিয়া দেওয়া হইবে)।’
শ্রীমতী ভোঁসলের বক্তব্যের অপর অংশটি ছিল, যে গাইতে জানে তার শিল্পীসত্তার স্বতঃস্ফূর্ততায় রবীন্দ্রসংগীতের শত বন্ধন অবশ্যই অন্তরায়। (যে-অন্তরায়হেতু ১৯৫২ সালে মহাজাতিসদনের এক অনুষ্ঠানে সংগীতগুণী দিলীপকুমার রায় বারবার অনুরুদ্ধ হয়েও রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে অস্বীকৃতি জানান—গুরুদেবের গানে রূপকারের স্বাধীনতা নেই বলে। এতে আশাভঙ্গ হয়েছিল শ্রীরায়ের গায়কীর তদানীন্তন ভক্ত তরুণ কবি শঙ্খ ঘোষের, যিনি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতে সেই ভারতবিখ্যাত গায়কের ‘সুরের গতিভঙ্গি’ প্রয়োগ ও ‘সুরের আর্কিটেকচার’ অঙ্কন উপভোগ করতে। পৃ. ১০৪, দিলীপকুমার রায়/স্মৃতি-বিস্মৃতির শতবর্ষ, ১৯৯৭, কলকাতা)। আশা ভোঁসলে তাঁর সাক্ষাৎকার শেষ করেন এই বলে—‘আর যে গাইতে জানে না তার কোনো অসুবিধাই হয় না (রবীন্দ্রসংগীত গাইতে), বাঁধা গতে গেয়ে গেলেই চলে’ (রবীন্দ্রনাথের ভাষায় অজন্তার চিত্রের ওপর দাগা বুলানোর মতো প্রাপ্ত ‘সুরের ওপর দাগা বুলিয়ে’—অর্থাৎ হিন্দুস্তানী সংগীতের ওস্তাদ অঘোর চক্রবর্তী ও রাধিকা গোস্বামীর মতো ‘কেবলমাত্র গাইয়ে অর্থাৎ সুর-আবৃত্তিকার’ হয়ে)।
আসলে পণ্ডিতগণের হেলাফেলা থেকে বাঁচাতে হলে জনগণের নজরুলকে পাণ্ডিত্যের মেলা থেকে বের করে ফেলা প্রয়োজন। অপরিহার্য সে-কাজটা অবশ্য মহাকালই করে ফেলেছে সময়ের যথাপরিসরে। নজরুলকে বসিয়ে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের পাশে, বাংলাগানের খাসমহলে—দেওয়ান-ই-খাসে। এঁরা যেন সংগীতসাম্রাজ্যের রাজা-উজির। বাকিদের বসিয়েছে আমমহলে—দেওয়ান-ই-আমে। তাঁরা যেন রাজদরবারের আমির-ওমরাহ। দেখা যাচ্ছে যে, বাংলা গানের ভুবনে ‘পঞ্চপ্রদীপে’র বহুল আলোচিত আসরটি বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায়নি। তাই আজ কেবল প্রথম এবং শেষ প্রদীপকেই প্রজ্বলন্ত দেখা যায় গানের আসরে, জয়ন্তীর উৎসবে। বাংলাদেশে বাকি তিন ‘প্রদীপ’-এর গানকে বলা হয় ‘তিন কবি’র গান, যদিও তাঁরাও মহান।
শেষকথাটি হল: নজরুলের গান বহুশাখী, যার প্রতিটি শাখাকেই মহত্তম ভাবা যেতে পারে—গণজাগরণী, গজলধর্মী, হিন্দুয়ানী ভক্তিমূলক, মুসলমানী ভক্তিমূলক, ধ্রুপদী আধুনিক, রাগসুররঞ্জিত লোকসংগীত, এবং রাগপ্রধানসংগীত। ভাবের, শব্দের, সুরের, ছন্দের, মেজাজের, পরিবেশের বহুমাত্রিকতায় বাংলার সংগীতভুবনে কাজী নজরুল ইসলাম এক স্বয়ম্ভর সংগীতসভার নাম।
(সৌজন্যে: আবদুশ শাকুর, আর্টসবিডিনিউজ২৪)
মহর্ষির প্রপৌত্র সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০১-৭৪) লাঙ্গল অফিসে নজরুলের পরিচয় দিয়েছেন তাঁর যাত্রী গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে (অভিযান পাবলিশিং হাউস, কলিকাতা, ১৩৫৭) এবং নজরুলের গলার সুর সম্পর্কে লিখেছেন:
‘…নজরুলের সঙ্গে আলাপ জমে গেলো। সে কবিতা পড়লো গান গেয়ে শোনালো। আমিও তাকে গান শোনালাম। কি ভালোই লেগেছিলো নজরুলকে সেই প্রথম আলাপে। সবল শরীর; ঝাঁকড়া চুল, চোখ দুটি যেন পেয়ালা, কখনো পেয়ালা খালি নেই, প্রাণের অরুণ রসে সদাই ভরপুর।… গলার স্বরটি ছিলো খুব ভারী… কিন্তু সেই মোটা গলার সুরে ছিলো যাদু। ঢেউয়ের আঘাতের মতো, ঝড়ের ঝাপটার মতো তার গান আছড়ে পড়তো শ্রোতার বুকে।… প্রাণ ছিল তার ঐ হাসির মতোই প্রবল ও দরাজ।… প্রবল হতে সে ভয় পেত না। রবীন্দ্রনাথের পরে এমন শক্তিশালী কবি আর আসেনি বাংলাদেশে। এমন সহজ গতি, আবেগের আগুন-ভরা কবিতা বাংলা সাহিত্যে বিরল।… ‘লাঙ্গলে’ বের হলো নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি। একদিনের মধ্যে ‘লাঙ্গল’ সব বিক্রি হয়ে গেলো, সেই সংখ্যাটা আমাদের আবার ছাপতে হলো। নজরুলের কবিতাই ছিলো ‘লাঙ্গলে’র প্রধান আকর্ষণ।’ (পৃ. ১০৮, ‘কাজী নজরুল ইসলাম/জীবন ও সৃষ্টি’, রফিকুল ইসলাম)। প্রসঙ্গত বুদ্ধদেব বসু তাঁর ১৯৪৪ সালে রচিত ও কালের পুতুল গ্রন্থে সংকলিত ‘নজরুল ইসলাম’-নামক প্রবন্ধে কাজীর গান গাওয়ার আকর্ষণ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে লেখেন:
‘কথার চেয়ে বেশি তাঁর হাসি, হাসির চেয়ে বেশি তাঁর গান। একটি হার্মোনিয়ম এবং যথেষ্ট পরিমাণে চা এবং পান দিয়ে একবার বসিয়ে দিতে পারলে তাঁকে দিয়ে একটানা পাঁচসাত ঘন্টা গান গাওয়ানো কিছুই নয়। গানে তাঁর আন্না নেই; ঘুমের সময় ছাড়া সবটুকু সময় গাইতে হলেও তিনি প্রস্তুত। কণ্ঠস্বর মধুর নয়, ভাঙা-ভাঙা খাদের গলা, কিন্তু গান গাওয়ায় এমন একটি আনন্দিত উৎসাহ, সমস্ত দেহ-মন-প্রাণের এমন একটি প্রেমের উচ্ছ্বাস ছিলো যে আমরা মুগ্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনেছি। সে-সময়ে গান রচনা করতেও দেখেছি তাঁকে—হার্মোনিয়ম, কাগজ আর কলম নিয়ে বসেছেন, বাজাতে-বাজাতে গেয়েছেন, গাইতে গাইতে লিখেছেন। সুরের নেশায় এসেছে কথা, কথার ঠেলা সুরকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সেবারে ঢাকায় যেসব গান তিনি লিখেছিলেন সেগুলি প্রায় সবই স্বরলিপি সমেত ‘প্রগতি’তে বেরিয়েছিলো।’ (লেখাটি ১৯৬৬ সালে ভারবি প্রকাশিত বুদ্ধদেবের ‘প্রবন্ধ সংকলন’-এও অন্তর্ভুক্ত হয়)।
এক স্মৃতিচারণায় নজরুলের গলা এবং গাওয়ার আকর্ষণ সম্পর্কে অসাধারণ গায়ক ও বিরল সংগীতগুণী দিলীপকুমার রায় বলেন:
‘কত সভায় এবং চ্যারিটি কনসার্টেই না সে আমাদের গানের পরে এই ভাবের নানা গান গাইত ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে ভাঙা গলায়। কিন্তু এমন গাইত যে, ভাঙা গলাকেও ভাঙা মনে হত না আগুন ছুটিয়ে দিত সে। এমন প্রাণোন্মাদী গায়ক কি আর দেখব এ-মনমরা যুগে? সত্যি আমাদের অবাক লাগত ভাবতে ভাঙা গলায়ও কোন জাদুতে কাজী এমন অসম্ভবকে সম্ভব করত দিনের পর দিন—ভাবের ঢলে পাথরের বুকে আলোর ঝর্না বইয়ে।’ (কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিচারণী তর্পণ, দিলীপ কুমার রায়, ধর্মবিজ্ঞান ও শ্রীঅরবিন্দ, বাক্সাহিত্য প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা)।
একই স্মৃতিচারণায় দিলীপ কুমার রায় সংগীতে নজরুলের অবদান প্রসঙ্গে বলেন:
‘ওর নানা কবিতা সুন্দর হলেও ওর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ হয়েছে ওর গানেই বলব। এ কথায় ওর অনুরাগীদের ক্ষুণ্ন হওয়া উচিত নয়। রবীন্দ্রনাথও কি বলেননি যে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান তাঁর গান? কাজীর সম্বন্ধেও ঐ কথা। আর সেইজন্যেই আমার মনের সঙ্গে ওর মনের সুর পুরোপুরি মিলত এসে এই গানেরই অন্দরমহলে, কবিতার রঙমহলে নয়।’
এই সূত্রেই নজরুলের গানের প্রতি সমকালীন সংগীতসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে দিলীপকুমার রায় এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর বেশ মনে ধরেছিল নজরুলের গজলের লঘু রাগসাংগীতিক চাল, যা তাঁর গলায় খেলতোও দারুণ। এই শাস্ত্রীয় সংগীতের রসের বশেই পরে তিনি নজরুলের প্রায় সকল ধরনের গানই গাইতেন। বাংলায় উর্দু গজলের মতো গজল গানের প্রচলন হওয়া ছিল তাঁর খুবই কাম্য একটি বস্তু। নানা প্রসঙ্গে দিলীপ রায় তাঁর এই অভিপ্রায় জ্ঞাপনও করতেন। তাঁর কামনা ছিল শ্রেষ্ঠ ফার্সি কবিদের গজলের মানের বাংলা গজল। কেননা তাঁর মতে উর্দুতে উচ্চমানের কবি নেই (এ এক অপার বিস্ময়েরই ব্যাপার যে শ্রীরায়ের মতো দিল্লি-লখনৌ-ঘোরা একজন রসপণ্ডিত গালিব-মোমিন-জাওক-জাফরের মতো বিশ্বমানের কালজয়ী গজলিয়াদের রসাবধারণে বঞ্চিত ছিলেন)।
যাহোক, নজরুল রচিত গজল এক বিশিষ্ট রূপবন্ধরূপে বাংলা কাব্যসংগীতের আসর মাত করামাত্রই দিলীপকুমার রায় তা নিজের অলংকৃত কণ্ঠে তুলে নিয়ে স্বয়ং এই গানের প্রচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কলকাতার বহু আসরে তিনি এই নবসংগীত যেমন কণ্ঠকার হিসেবে গেয়ে শুনিয়েছেন, তেমনি এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন ভাষ্যকার হিসেবে। নজরুলের গজলের শুদ্ধরূপে প্রচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে স্বরলিপি প্রণয়ন এবং তা পত্রপত্রিকায় মুদ্রণের ব্যাপারেও তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন সংগীতপ্রেমী দিলীপকুমার রায়। বাংলা গজল সম্পর্কে তিনি এতোই উৎসাহী ছিলেন যে নিজেও নজরুলের কয়েকটি গজলের স্বরলিপি প্রস্তুত করেন। তাঁর উদ্যোগেই রবীন্দ্র-পরিকরদের মধ্যেও নজরুলসংগীতের চর্চা প্রবেশ পায়—এমনকী রবীন্দ্রনাথের নিজের গানের রূপকার হিসেবে তাঁর সবচেয়ে পছন্দসই শিল্পী সাহানা দেবীকেও নজরুলের গান গাইতে দেখা যায় (এলো ফুলের মহলে ভোমরা গুনগুনিয়ে, নাচে সুনীল দরিয়া আজি দিল-দরিয়া পূর্ণিমা চাঁদ পেয়ে, মেগাফোন, জেএনজি ৭৬, ১৯৩৩)।
২.
কলকাতা-জীবনের প্রথমবর্ষে নজরুল ছিলেন সৌখিন গায়ক ও গীতিকার। সুর করার জন্য গান রচনা বা রচিত গানের সুর করা তখনও শুরু হয়নি তাঁর। তবে সে-পর্বও আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল অচিরেই এবং সেটা স্বদেশী গানের সূত্রে, যেটাকে তিনি সাম্যবাদী গানে রূপান্তরিত করে গণসংগীতের পথিকৃৎ হবার মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। নজরুল স্বদেশী হাওয়ায় তথা অসহযোগ আন্দোলনে উদ্বেলিত হন কুমিল্লায়—করাচি থেকে ফেরার বছরখানেক পরে, ১৯২১ সালের জুন-জুলাই মাসে। তিনি তাঁর সদ্যরচিত দেশাত্মবোধক গান গাইলেন মিছিলমুখর কুমিল্লা শহরের রাস্তায় রাস্তায় ‘এ কোন্ পাগল ছুটে এল বন্দিনী মা’র আঙ্গিনায়’। এ ছাড়াও সেসময় নজরুল আরও দুটি স্বদেশী গান ‘মরণবরণ’ (এস এস এস ওগো মরণ) এবং ‘বন্দী-বন্দনা’ (আজি রক্ত নিশি-ভোরে) রচনা করে কুমিল্লার টাউনহলে কংগ্রেসের সভায় গেয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক উদ্দীপনার সৃষ্টি করেন, যার অস্তিত্বই ছিল না বাংলার সংগীত-সংস্কৃতিতে এর আগে। একই বছরের নভেম্বর মাসে নজরুল পুনরায় ফিরে আসেন কুমিল্লায়। ২১ নভেম্বরে পালিত দেশব্যাপী হরতালের দিন তিনি মিছিলের পুরোভাগে শহর প্রদক্ষিণ করেন ‘জাগরণী’ গান গেয়ে—‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী’।
ডিসেম্বরে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফিরে নজরুল মাসটির শেষদিকে রচনা করেন স্বাদে গন্ধে বর্ণে ছন্দে বাংলা কবিতা ও গানের ইতিহাসে অদ্যাবধি অনতিক্রান্ত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা (বল বীর—বল উন্নত মম শির!) আর ‘ভাঙার গান’ (কারার ঐ লৌহ-কবাট ভেঙে ফেল্, কর রে লোপাট)। পরের বছর প্রমীলার সঙ্গে হৃদয় বিনিময়ের পর পর ১৯২২ সালের এপ্রিল মাসে ১৩২৯ সনের বাংলা নববর্ষের উৎসবকালে কুমিল্লাতেই রচিত হয় তাঁর আরেক অনতিক্রমণীয় কবিতা ও গান ‘প্রলয়োল্লাস’ (তোরা সব জয়ধ্বনি কর!)। ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন সঙ্গী নবীন কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর স্বদেশে সাম্যবাদকে আহ্বান করে রচেন এই গানটি। সেই মহাবিপ্লবের প্রেরণাতেই কলকাতায় ফিরে আগস্ট মাসে নজরুল স্বাধীনতাকামী অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু বের করেন।
এর আগের মাসেই কবি তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’-শীর্ষক রূপক কবিতাটি মারফত পরাধীনতা নাশনের জন্যে মহিষাসুরমর্দিনীকে আহ্বান করেছিলেন (দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,/ ভূ-ভারত আজ কশাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী!…)। এহেন রাজদ্রোহ মুদ্রণের জন্য ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয় বিপ্লবী কবিকে। ১৯২৩ সালে রাজবন্দী নজরুল হুগলী জেলে রচনা করেন তাঁর অগ্নিঝরানো ‘শিকল-পরার গান’ (এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল।/ এই শিকল প’রেই শিকল তোদের করব রে বিকল॥)। অসহযোগ আন্দোলনের ফসল এসব স্বদেশী গান সংবলিত বিষের বাঁশী ও ভাঙার গান-নামক দুটি গ্রন্থেরই বিজাতীয় সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হওয়া প্রকারান্তরে দেশবাসীর ওপর নজরুলের দেশাত্মবোধক গানের প্রচণ্ড প্রভাব স্বীকৃত হওয়া। এই স্বীকৃতি অন্যভাবে জাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকেও পেয়েছিলেন নজরুল। যেমন ১৯২৫ সালে কংগ্রেসের ফরিদপুর অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সামনে নজরুল তাঁর জনপ্রিয় ‘চরকার গান’ স্বকণ্ঠে গেয়ে তাঁদের প্রাণঢালা প্রশংসা পেয়েছিলেন (ঘোর—ঘোর রে ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর)। ১৯২৬ সালের মে মাসে কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার পটভূমিকায় কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের জন্যে নজরুল রচনা করেন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী তাঁর অবিস্মরণীয় গান ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার!’ (দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার/ লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!)। সম্মেলনে তিনি নিজে গানটি পরিবেশন করেন দিলীপকুমার রায় ও তাঁর সংগীতসম্প্রদায়ের সহযোগিতায়।
এর আগে মার্চ মাসে মাদারিপুরে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবী সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীতরূপে তিনি রচনা করেন ‘ধীবরদের গান’ (আমরা নিচে প’ড়ে রইব না আর/ শোন্ রে ও ভাই জেলে,/ এবার উঠব রে সব ঠেলে!/ ঐ বিশ্বসভায় উঠল সবাই রে,/ ঐ মুটে-মজুর হেলে/ এবার উঠব রে সব ঠেলে ॥)। ছাত্র সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে নজরুল রচনা করেন ‘ছাত্রদলের গান’ (আমরা শক্তি আমরা বল/ আমরা ছাত্রদল/ মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান/ ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।/ আমরা ছাত্রদল ॥)। যুব-সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীতরূপে তিনি মার্চের সুরে রচনা করেন ‘চল্ চল্ চল্’ (ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল,/ নিম্নে উতলা ধরণী-তল,/ অরুণ প্রাতের তরুণ দল/ চল্ রে চল্ রে চল্/ চল্ চল্ চল্ ॥)। ‘টলমল টলমল পদভরে’, ‘অগ্রপথিক হে সেনাদল’ প্রভৃতি গানও নতুন ধারার সমরসংগীতের তাল-লয়ে গ্রথিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে কবি নজরুল এই সব সম্মেলনের, গায়কদের তো বটেই, উদ্যোক্তাদেরও অন্যতম ছিলেন। এই দিকগুলির কারণেও বাংলার বরেণ্য বাগ্গেয়কারদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের স্থান অনন্য এবং অতুলনীয় (সাংগীতিক পরিভাষায় সংস্কৃত বাগ্গেয়কার-শব্দটি যুগপৎ কথাকার ও সুরকারকে বোঝায়)।
একই সময় নজরুল রচনা করেন তাঁর (সর্বহারা গ্রন্থে সংকলিত) সুবিখ্যাত কৃষক-শ্রমিকের গানগুলি। কংগ্রেসের ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’র (কিংবা স্বতন্ত্ররূপে নবগঠিত ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলে’র) কিষাণ সভার জন্য তিনি রচনা করেন ‘কৃষাণের গান’ (ওঠ্ রে চাষী জগদ্বাসী ধর ক’ষে লাঙল।/ আমরা মর্তে আছি—ভাল ক’রেই মর্ব এবার চল্ ॥) নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীতরূপে নজরুল রচনা করেন ‘শ্রমিকের গান’ (ওরে ধ্বংস-পথের যাত্রীদল!/ ধর্ হাতুড়ি, তোল্ কাঁধে শাবল ॥)। এসব গান সম্মেলনে স্বকণ্ঠে গেয়ে সমবেত জনতাকে উদ্বুদ্ধ করে তোলা ছিল সমাজপরিবর্তন-কর্মী হিসেবে কবির পূর্বিতাপ্রাপ্ত কর্মসূচির অন্তর্গত—যার জন্য তিনি রোগশয্যা থেকেও ছুটে আসতেন জনসভায়।
কারণ, রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক সাম্যপ্রতিষ্ঠার চিন্তা ছিল তাঁর একসূত্রে গ্রথিত এবং সৃজনশীল সত্তার পাশাপাশি মননশীল সত্তায় প্রোথিত। শেষোক্ত গান দুটি সম্পর্কে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র, ঠাকুরবাড়ির একমাত্র ‘বিপ্লবী’, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কমিউনিস্ট নেতা, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০১-১৯৭৪) তাঁর যাত্রী গ্রন্থে লিখেছেন: ‘বাংলা সাহিত্যে এই ধরনের গান ছিল না এর আগে, নজরুলই তার পথকার’। (মহর্ষির আরেক প্রপৌত্র সুভগেন্দ্রনাথ ওরফে সুভো ঠাকুর (১৯১২-৮৫) ছিলেন বাড়িটির একমাত্র ‘বিদ্রোহী’, যিনি লিখেছিলেন, ‘পোয়েট ট্যাগোর হন কে তোমার, জোড়াসাঁকোতেই থাক?/ বাবার খুড়ো যে হন শুনিয়াছি, মোর কেহ হয় নাকো’।)।
গণসংগীতের পথিকৃৎ কাজী নজরুল ১৩৩৪ সালের একই তারিখে, পয়লা বৈশাখে, একের পর এক রচনা করেন ‘অন্তর-ন্যাশনাল সংগীত’ (জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত !), ‘জাগর-তূর্য’ (ও রে ও শ্রমিক, সব মহিমার উত্তর-অধিকারী!/ অলিখিত যত গল্প-কাহিনী তোরা যে নায়ক তারি ॥), ‘রক্ত-পতাকার গান’ (ওড়াও ওড়াও লাল নিশান!/ দুলাও মোদের রক্ত-পতাকা/ ভরিয়া বাতাস জুড়িয়া বিমান!/ ওড়াও ওড়াও লাল নিশান ॥)। সামাজিক অন্যায়বিচারের জগদ্দল পাথর ভেঙে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করতে নজরুল এর আগে ১৩৩১ সালে ব্যান্ডের সুরে রচনা করেন ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল।/ মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়, মোরা প্রকৃতির মতো সচ্ছল॥’। পরে ১৩৩৭ সালে রচনা করেন নারী-জাগরণী গান ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা। জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্তটিকা॥’। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ও বহুল উদ্ধৃত সাম্যবাদী কবিতাগুলি সংকলিত হয়েছে তাঁর সাম্যবাদী গ্রন্থে (যেমন সাম্যবাদী, ঈশ্বর, মানুষ, পাপ, চোর-ডাকাত, বারাঙ্গনা, মিথ্যাবাদী, নারী, রাজা-প্রজা, সাম্য ও কুলি-মজুর)।
লক্ষণীয় যে নজরুল ছিলেন, যাকে বলে, প্র্যাক্সিসের মানুষ। মানে নিতান্ত ভার্বালিস্ট বা বচনসর্বস্ব অথবা নিতান্ত অ্যাক্টিভিস্ট বা করণসর্বস্ব ছিলেন না—তিনি ছিলেন অ্যাক্টিভিস্ট-কাম-ভার্বালিস্ট। এজন্যে তাঁর সৃজনে এমন একক এক অথেন্টিসিটি বর্তাতো যা আর কারও রচনায় প্রত্যাশিতও ছিল না। নজরুল সংগ্রামী গান রচনা করতেন পরাধীনতার বিরুদ্ধে মাঠে-বাটে সংগ্রাম করতে করতে (যেমন করতেন আর কেবল মুকুন্দ দাস, তবে তাঁর স্বর নজরুলের কণ্ঠের সঙ্গে তুলনীয় ছিল না), ঘরের কোণে বসে কলম পিষতে পিষতে নয়। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ নজরুলের উদ্দীপনামূলক ও দেশাত্মবোধক গানগুলিকে উচ্চতম মান এবং স্থায়ী মূল্য দান করেছে। তাঁর সভায়-মিছিলে অংশগ্রহণ এবং কারাবরণ ও অনশন পালন—সবই ছিল দেশবন্দনামূলক মহান সৃজনকর্মের সক্রিয় প্রস্তুতিস্বরূপ। এ বিষয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল-তনয় দিলীপকুমার রায়ের বয়ানে সুভাষচন্দ্র বসুর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ১৯২৫ সালের দোসরা মে নেতাজী মান্দালয় থেকে একটি পত্রে লিখেছিলেন—”We do not perhaps realise the magnitude of the debt owed by Kazi Nazrul Islam’s verse to the living experience he had of jails” (পৃ. ১৩১, নজরুল গীতি প্রসঙ্গ, ড. করুণাময় গোস্বামী)। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে জাতির পক্ষ থেকে আয়োজিত নজরুল-সংবর্ধনা সভাতেও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর প্রদত্ত ভাষণে বলেন:
‘তাঁর লেখার প্রভাব অসাধারণ। তাঁর গান পড়ে আমার মত বেরসিক লোকেরও জেলে বসে গান গাইবার ইচ্ছা হত। আমাদের প্রাণ নেই, তাই আমরা এমন প্রাণময় কবিতা লিখতে পারি না। নজরুলকে বিদ্রোহী বলা হয়—এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্ট বুঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব—তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব। আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বেড়াই, বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সংগীত শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, কিন্তু নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মত প্রাণ মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না। কবি নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা শুধু তাঁর নিজের স্বপ্ন নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩২)।
সংবর্ধনা-সভাটির সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেন:
‘রবীন্দ্রনাথের আওতায় নজরুলের প্রতিভা পরিপুষ্ট হয় নাই, তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁহাকে কবি বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন।’ উপসংহারে আচার্য রায় আরো বলেন, ‘আমরা আগামী সংগ্রামে কবি নজরুলের সংগীত কণ্ঠে ধারণ করিয়া শ্রীমান সুভাষের মতো তরুণ নেতাদের অনুসরণ করিব। নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতিমানুষে পরিণত হইবে।’
৩.
তবে স্মরণ রাখতে হবে যে দেশাত্মবোধক গান রচনার এই কালটি ছিল নজরুলের গভীরভাবে সংগীতজগতে প্রবেশ করার পূর্বকাল। এ পর্বের গানগুলির সুর ছিল সহজসরল ও উদ্দীপনাময়, বাণীও ছিল সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকারের—যে-সমূলবদলের সংগ্রামী সৈনিকরূপে তিনি তখন সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ। সত্যিকার অর্থে সংগীতক্ষেত্রে অবতরণ তাঁর এর পরে—১৯২৬ সাল থেকে, যার শুরু গজলপর্ব দিয়ে। ১৯২৬-১৯২৮-এর কৃষ্ণনগরের জীবনে নজরুল শোষণমুক্তি ও সাম্যপ্রতিষ্ঠা অভিলাষী নতুন ধারার সাম্যবাদী গান রচনার সমসময়েই শুরু করেন নতুন ছন্দের নতুন বর্ণের নতুন স্বাদের নতুন আবেগের প্রেমের গান রচনা। গজল-নামে অভিষিক্ত রক্তমাংসের এই নতুন প্রেমের বন্যা চোখের পলকে প্লাবিত করে দিল প্রেমের গানের ক্ষমতাসীন মহারাজ রবীন্দ্রনাথের রাজধানী শহর-কলকাতাকেই।
লখ্নৌ প্রবাসী উর্দু-দাঁ অতুলপ্রসাদ সেন নজরুলের আগে কয়েকটি গজল রচনা করেছিলেন (যেমন ‘কে গো তুমি বিরহিণী, আমারে সম্ভাষিলে/ এ পোড়া পরান তরে এত ভালবাসিলে’, ‘রাতারাতি করল কে রে ভরা বাগান ফাঁকা/ রাঙা পায়ের চিহ্ন শুধু আঙিনাতে আঁকা’)। দু একটি গজল তাঁর ভালোও হয়েছে (যেমন ‘বলো গো সজনী, কেমনে ভুলিব তোমায়?/ যতন যাতনা বাড়ায়’, ‘কত গান তো হল গাওয়া/ আর মিছে কেন গাওয়াও?/ যদি দেখা নাহি দিবে/ তবে মিছে কেন চাওয়াও?’ তবে তাঁর শ্রেষ্ঠতম গজল ‘জল বলে চল মোর সাথে চল/ কখনো তোর আঁখিজল হবে না বিফল’ এখানে উল্লেখ্য নয় যেহেতু এটির সৃষ্টি নজরুলের ‘এত জল ও-কাজল-চোখে পাষাণী আন্লে বল কে।/ টলমল জল্-মোতির মালা দুলিছে ঝালর-পালকে’-গজলটির প্রেরণায় (বলেছেন দিলীপকুমার রায়)। এখানে বিশেষভাবে বলার কথাটি হল অতুলপ্রসাদ গজলের তরঙ্গই সৃষ্টি করতে পারেননি, ধারা রচনা করা তো পরের কথা।
নজরুল শুধু ১৩৩৩ থেকে ১৩৩৫—এ দুটি বছরেই অতুলের মোট গজলের চেয়ে অনেক বেশি গজল সৃষ্টি করে গজলের জলোচ্ছ্বাস বইয়ে দিয়েছেন বাংলা গানের জগতে। ১৩৩৩ সালে ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল’ দিয়ে শুরু করে তিনি একের পর এক লিখে গিয়েছেন ‘আসে বসন্ত ফুলবনে’, ‘বসিয়া বিজনে কেন একা মনে’, ‘আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায়’, ‘দুরন্ত বায়ু বহে পুরবঁইয়া’, ‘মৃদুল বায়ে বকুল ছায়ে’, ‘করুণ কেন অরুণ আঁখি’, ‘এত জল ও কাজল চোখে’, ‘কেন কাঁদে পরাণ’, ‘চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না’, ‘কে বিদেশী বন-উদাসী’, ‘নিশি ভোর হল জাগিয়া পরান পিয়া’ ইত্যাদি একসে-এক মনোহরণ গজল। ১৩৩৫ সালেও সমানে চলল তাঁর গজলবর্ষণ। যেমন ‘এ বাসি বাসরে আসিলে কে গো ছলিতে’, ‘নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখি-জল’, ‘কেন আন ফুল-ডোর আজি বিদায়-বেলা’, ‘কেমনে রাখি আঁখি-বারি চাপিয়া’ ইত্যাদি। এসব গজল প্রকাশিত হত প্রায়শ স্বরলিপিসহ (যার বেশ কিছু কবিকৃতও) শীর্ষস্থানীয় সকল পত্রিকায় (যেমন কল্লোল, কালিকলম, প্রগতি, বঙ্গবাণী, নওরোজ, সওগাতে)।
নজরুলের গজল-সংকলনরূপে বিখ্যাত ‘বুলবুল’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে [পরপর প্রকাশিত ‘চোখের চাতক’ও গজল-খ্যাত]। তবে এ সময় তাঁর গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার ফলে রকমারি গানের চাহিদা গজলকে পেছনে ঠেলে দেয়। তবু এরই মধ্যে নজরুল গজলকে বাংলাগানের আসরে সম্মানিত একটি স্থায়ী আসন অর্জন করে দিতে পেরেছেন। পেরেছেন এ কারণে যে এর প্রস্তুতি তাঁর সম্পূর্ণ হয়েছিল অনেক আগেই, করাচি-বাসকালে—ফার্সি কাব্যপাঠ, বিশেষত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গজলিয়া পারশ্যের হাফিজের গজল পাঠ ও আবৃত্তি শোনা ও শেখার মাধ্যমে (সে-আবৃত্তি বাংলা কবিতা আবৃত্তির মতো নয়, সুরেলা আবৃত্তি—যাকে তাঁরা বলেন ‘তারান্নুম’-যুক্ত পাঠ)।
গজলের পথ বেয়েই নজরুল সংগীতের উপত্যকায় পৌঁছান। পৌঁছেই গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগদান তাঁর সাহিত্যরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাঁকে সংগীতনগরের নাগরিক করেই রেখে দেয়। সেখানেই নজরুল বহু সংগীতগুণীর সৃজনশীল সান্নিধ্য এবং তৎপ্রসূত শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের মওকা পান। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন ঠুংরির ভাণ্ডারি জমিরুদ্দীন খাঁ, ঠুংরি-মুখড়ার খনি মঞ্জু সাহেব, মাস্তান গামা, ওস্তাদ কাদের বখশ, দবীর খাঁ, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী প্রমুখ। সংগীতে পুষ্টিলাভ করার মানসে নজরুল রাগসংগীতের বিখ্যাত স্বাস্থ্যনিবাসেও যেতেন—যেমন খলিফা বদল খাঁ বা আফতাবে মওসিকী ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের সকাশে। তবে এঁদের জোগানের পরিমাণ তেমন বেশি ছিল না। বেশি ছিল নজরুলের বিধিদত্ত প্রতিভাপুষ্ট স্বশিক্ষা, ঠুংরি সম্রাট মৌজুদ্দীনের মতো। সেজন্য কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলার সংগীত জগতের শ্রেষ্ঠতম ‘আতায়ী’ উস্তাদ বললেও অত্যুক্তি হয় না।
৪.
বস্তুতপক্ষে নজরুলের রাগসংগীতপ্রীতি জন্মগত বলেই সেই সংগীতে কৃতি তাঁর বিধিদত্ত। তাঁর প্রকাশিত প্রথম গানটিও ছিল বসন্ত-সোহিনী রাগে ও দাদরা তালে রচিত (বাজাও প্রভু বাজাও ঘন বাজাও)। সম্ভবত তাই রাগসংগীতের ভুবনে এ-আগন্তুকের কাছে বাংলা গান যা পেয়েছে—রাগসংগীতের ঐতিহ্যে লালিত বাকি চার প্রধানের কাছে সম্মিলিতভাবেও তা পায়নি। স্মর্তব্য যে নজরুল ছাড়া সকলেই জন্মেছিলেন ঐতিহ্যবাহী সংগীতচর্চাকারী পরিবারে।
রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরবাড়ি ছিল অন্যতম দেশখ্যাত সংগীতকেন্দ্র, যেখানে বিখ্যাত শাস্ত্রীয় কলাবতগণ থাকতেন এবং পরিবারের নতুন প্রজন্মকে তাদের শিশুকাল থেকেই গান শেখাতেন। বিষ্ণু চক্রবর্তী, যদুনাথ ভট্টাচার্য, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর মতো স্বনামধন্য ধ্রুপদিয়াদের আবাল্য সান্নিধ্যে গড়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের সংগীতসত্তা। দ্বিজেন্দ্রলালের সংগীতজীবনের গোড়াপত্তন হয় টপ-খেয়ালিয়া ও গীতিরচয়িতা পিতা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের তালিমে।
অতুলপ্রসাদ সেন গায়ক পিতার মৃত্যুর পর প্রতিপালিত হন গায়ক ও গীতিরচয়িতা মাতামহের আশ্রয়ে। কর্মজীবনের সূত্রে লখনৌ শহরে সুর ও বাণীর আবহাওয়াতেই ছিল তাঁর বসবাস। তাই আজীবন সংগীত রচনা করেন তিনি শাস্ত্রীয়সংগীতের স্বভূমিতে, রাগসংগীতিক পরিবেশে বসে। পাবনার সংগীতজ্ঞ কবির পুত্র রজনীকান্ত সেনের শৈশব-কৈশোরও সংগীতসমৃদ্ধ এবং আইনজীবী হিসেবে রাজশাহীর জীবনও ছিল তাঁর উচ্চমানের সাংগীতিক পরিমণ্ডলে।
প্রতিপক্ষে একমাত্র কাজী নজরুল ইসলামই জন্মেছিলেন দরিদ্রগৃহে এবং শিশুশ্রমিকের জীবনটিও কেটেছে তাঁর কঠোর সংগ্রামে আর কঠিন সঙ্কটে। অথচ ঐতিহ্য ব্যতিরেকেই এই স্বভাবশিল্পী সৃষ্টি করে গেছেন বাংলার সংগীত জগতে রাগসংগীতের কালজয়ী ধারাটি এবং পুষ্টও করে গেছেন প্রভূত পরিমাণে।
বাণীর বিচারে যে-শ্রেণীতেই জমা পড়ুক, সুরের বিন্যাসে রাগসাংগীতিক চারিত্র্য নজরুলের, কেবল গজলকেই নয়, সকল শ্রেণীর গানকেই শনাক্তযোগ্যভাবে ‘নজরুলিয়া’রূপ দিয়েছে। তবে এক কথায় বলতে গেলে ‘রাগপ্রধান গান’-নামক বিশেষ শ্রেণিটিই তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাগসাংগীতিক অবদান। এই গান হিন্দুস্তানী সংগীতরীতির প্রতিকৃতি কিংবা প্রতিধ্বনি নয়—এ এক রাগাশ্রয়ী সংগীতরীতিই বটে, তবে খাঁটি বাঙালি। এ-গানকে ‘শুদ্ধবাদী’ও বলা যায় এ-অর্থে যে এতে থাকে কেবল মৌলিক রাগরূপ ও রাগভাবসহ রাগাঙ্গীণ অলঙ্কৃতি—থাকে না সুরপ্রস্তারের বহুলতা, নানান ফাঁদের তানকর্তবের কৃত্রিমতা, দুরূহতার কার্দানি, জটিলতার প্রদর্শনী প্রভৃতি। সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনার এই সংগীত-সংরূপটির জন্ম হয় উনিশ শো ত্রিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে—স্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম এবং নামদাতা তাঁর সহযোগী কৃতী রাগসংগীতশিল্পী ও তাত্ত্বিক সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বাংলা একাডেমীর নজরুল রচনাবলী দশম খণ্ডে পূর্ণরূপে প্রকাশিতব্য নজরুলের ‘সুর ও শ্রুতি’-শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রবন্ধটি সম্বন্ধে শ্রীকল্পতরু সেনগুপ্ত তাঁর নজরুল-গীতি অন্বেষা নামক গ্রন্থে বলেছেন:
‘এই রচনাটি অপ্রকাশিত। একটি বাঁধাই খাতায় কাজী নজরুল ইসলামের নিজের হাতের লেখায় পাওয়া গেছে। খাতায় তিনি এত দ্রুত লিখেছেন যে, কোথাও কোথাও পাঠোদ্ধারের অসুবিধা হয়েছে। রাগ-রাগিণী ও শ্রুতির চার্টগুলি তাঁর নিজের হাতে তৈরি। এই চার্টগুলি দেখে, অনুমান করা যায় শাস্ত্রীয় সংগীতের তুলনামূলক বিচারে তিনি কিরূপ আগ্রহী ছিলেন এবং কিরূপ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সংগীত-শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন। একই খাতায় তিনি আরো কয়েকটি রাগের প্রকৃতি ও পরিচয় বর্ণনা করেছেন। খাতা-দৃষ্টে অনুমান হয় ১৯৩৫-৩৬ সালে তিনি এই লেখা আরম্ভ করেছিলেন।’
প্রবন্ধটি লিখিত হয়েছে প্রখ্যাত সংগীত ব্যক্তিত্ব লখনৌর রাজা নবাব আলী রচিত এবং উনিশ শত বিশের দশকে প্রকাশিত মারিফুন্নাগমাত-নামক রাগসংগীত বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থটির প্রথম খণ্ডের অনুসরণে। খণ্ডটির অধ্যায় ছিল তিনটি—স্বরাধ্যায়, রাগ অধ্যায় ও তাল অধ্যায়। স্বরাধ্যায়ে ছিল শাস্ত্রীয় সংগীতের সাধারণ উপপত্তিক বিষয়গুলি। রাগ অধ্যায়ে ছিল ১৫৩টি রাগের বিবরণ, স্বরবিস্তার ও একটি করে লক্ষণগীত। এতে করে অনেকগুলি রাগ সাধারণ্যের নাগালে চলে এল, যেগুলি ইতিপূর্বে বিভিন্ন ওস্তাদদের কুক্ষিগত ছিল। কবির সৃষ্টিধারায় এই গ্রন্থের প্রভাব অনুভব করা যায় ত্রিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে।
মারিফুন্নাগমাতে কবি দেড়শতাধিক রাগের লক্ষণগীতি হাতে পেলেন। অর্থাৎ রাগ পরিচয় ও স্বরবিস্তার ছাড়াও প্রত্যেক রাগের একটি করে গানের মডেল স্বরলিপিসহ হাতের কাছে পাওয়া গেল। এই মডেলগুলির কাঠামো বজায় রেখে কবি অনুরূপ বন্দিশে অনায়াসেই গান বাঁধতে পারতেন (রবীন্দ্রনাথ যেমন বেঁধেছেন তাঁর বহু ভাঙা-গান)। স্বরগুলো তো ছকে সাজানোই ছিল, তার নিচে পছন্দমতো বাংলা কথা বসিয়ে দিলে (রবীন্দ্রনাথ যেমন বসিয়ে দিয়েছেন, যথা ‘হৃদয়নন্দনবনে নিভৃত এ নিকেতনে’) খুব সহজে বহুসংখ্যক রাগভিত্তিক নজরুল-গীতির জন্ম হতো। কবি কিন্তু তা করেননি। কবি রাগভিত্তিক গান বেঁধেছেন রাগের ধ্যানমূর্তি মানসপটে প্রতিষ্ঠা করে নিয়ে। লক্ষণগীতির স্বরলিপিতে রাগ কূপের জলের মতো অকিঞ্চিৎকর হয়ে থাকে। রাগের মোহিনীমূর্তি আবির্ভূত হয় উপযুক্ত গুণীর কণ্ঠে অথবা যন্ত্রে। রাগ তখন রঙে রসে বৈভবে কলস্বিনী নদীর মতো অনুভবের জোয়ারে শ্রবণতট রসপ্লাবিত করে। রসের সেই মূর্তি কবি নিয়ত সন্ধান করেছেন উপযুক্ত গুণীজনের কাছে কখনো শিক্ষার্থী হয়ে, কখনো ফরমাশ করে, কখনো বা উৎকর্ণ শ্রোতার আসনে বসে। পুঁথির বিধান কবিকে রাগের ব্যাকরণ দিয়েছে, রাগের রসমাধুর্য দিয়েছেন শিল্পীজন। (‘নজরুল ও মারিফুন্নাগমাত’, অমলকুমার মিত্র, নজরুল একাডেমী পত্রিকা, ১৩৯৪, ঢাকা)।
কট্টর উর্দু ভাষায় লিখিত শাস্ত্রীয় সংগীতের জটিল বিষয়াদি অনুধাবন করে বস্তুসার স্বচ্ছ বঙ্গভাষায় স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল অভিব্যক্তিতে সংগীতসমাজে পরিবেশন—ভাষা ও সংগীতের ক্ষেত্রে নজরুলের সহজাত প্রতিভার একটি বিস্ময়কর দৃষ্টান্তই বটে।
৫.
ভক্তিসংগীতের দুটি ধারাতে নজরুলের কৃতি তুলনারহিত—হিন্দুধর্মসংগীতর আবহমান ধারা আর মুসলিমধর্মসংগীতের নতুন ধারা। হিন্দু ভক্তিসংগীতে তাঁর রচনার অসংখ্যতা ও বিষয়ের অজস্রতা এককথায় বিহ্বলকর। ঈশ্বরবন্দনামূলক গান যেমন—অন্তরে তুমি আছ চিরদিন, খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিশ্বব্যাপিয়া আছ তুমি জেনে, মন বলে তুমি আছ ভগবান, যুগ যুগ ধরি লোকে লোকে প্রভৃতি। শ্যামাসংগীত যেমন—শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা, মহাকালের কোলে এসে, শ্মশানকালীর রূপ দেখে যা, আমার মা আছে রে সকল নামে, ওমা বক্ষে ধরেন শিব যে চরণ, কে তোরে কি বলেছে মা, বল রে জবা বল, সংসারেরই দোলনাতে মা প্রভৃতি।
দুর্গাসংগীত যেমন—জয় দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, এস আনন্দিতা ত্রিলোকবন্দিতা, মৃন্ময়ী রূপ তোর পূজি শ্রীদুর্গা, ভবাণী শিবাণী দশপ্রহরণধারিণী, কে জানে মা তব মায়া মহামায়া রূপিণী ইত্যাদি। আগমনী গান বা উমাসংগীত যেমন—ওরে আলয়ে আজ মহালয়া, আমার উমা কই গিরিরাজ, তুই পাষাণগিরির মেয়ে হলি, বর্ষা গেল আশ্বিন এল উমা এল কই, মা হবি না মেয়ে হবি দে মা উমা বলে, কে সাজালে আমার মাকে বিসর্জনের বিদায় সাজে, ইত্যাদি। শিবসংগীত যেমন—গরজে গম্ভীর গগনে কম্বু নাচিছে সুন্দর নাচে স্বয়ম্ভু, সৃজনছন্দে আনন্দে, জাগো অরুণ ভৈরব, প্রভৃতি।
কৃষ্ণসংগীত যেমন (নারায়ণরূপী কৃষ্ণ) জাগো শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী, হে প্রবল প্রতাপ দর্পহারী, তিমিরবিদারী অলখবিহারী কৃষ্ণমুরারী আগত ঐ, প্রভৃতি। (গোপীবল্লভরূপী কৃষ্ণ) একি অপরূপ রূপের কুমার, আমি কেন হেরিলাম নবঘনশ্যাম, সখি যায়নি তো শ্যাম মথুরায়, ব্রজগোপী খেলে হোরী, ইত্যাদি। ব্রজলীলা যেমন (কীর্তন) মুরালীধ্বনি শুনি ব্রজনারী, রাখ রাখ রাঙা পায় হে শ্যমরায়, শ্যামসুন্দর গিরিধারী, দোলে বনতমালের ঝুলনাতে কিশোরী কিশোর, সখি আমিই না হয় মান করেছিনু, মন মোর ছুটে যায় দ্বাপর যুগে প্রভৃতি। (ভজন) চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, প্রভু রাখ এ মিনতি, তোমার আমার এই বিরহ সইব কত আর, হে চিরসুন্দর বিশ্বচরাচর, হে মহামৌনী তব প্রশান্ত গম্ভীর বাণী শোনাবে কবে প্রভৃতি।
হিন্দুধর্মসংগীত বিভাগে নজরুলের গানে রচনার পরিমাণগত বিপুলতা, বিষয়বৈচিত্র্যের ব্যাপকতা ও সুরৈশ্বর্যের উৎকৃষ্টতা তথা কাব্যসংগীতের সামগ্রিক উৎকর্ষের মাধ্যমে যুগপৎ আবহমান বাংলার হিন্দুপ্রভাব পুনরুজ্জীবিত হয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথের হাতে শীর্ষস্পর্শী ব্রাহ্মপ্রভাব তিরোহিত হয়েছে। এর একটা সাধারণ প্রমাণ এই যে বাংলা ভাষায় জনপ্রিয়তম দুর্গাসংগীতটি নজরুলসংগীত যথা ‘কে জানে মা তব মায়া মহামায়ারূপিণী’। আরেকটা বিশেষ প্রমাণ এই যে গাজন-গম্ভীরা ইত্যাদি লোকসংগীতের উপজীব্য শিবের গীতকে ধ্রুপদ-খেয়াল অঙ্গপ্রধান কাব্যসংগীতে উন্নীত করেছেন কাজী নজরুল ইসলামই এবং বাংলার স্বল্পসংখ্যক শিবসংগীতের শ্রেষ্ঠতমটিও তাঁরই, যথা—গরজে গম্ভীর গগনে কম্বু।
শ্যামাসংগীতে নজরুলের অবদান সম্পর্কে ডক্টর করুণাময় গোস্বামী লেখেন, ‘বলতে কি শ্যামাসংগীত রচয়িতারূপে রামপ্রসাদ সেন বা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য সাংগীতিক নান্দনিকতায় যে স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, নজরুল তদপেক্ষা উচ্চস্তরে পৌঁছেছিলেন। কেননা, কবি ও সুরস্রষ্টারূপে তিনি পূর্ববতী সংগীতরচয়িতাদের চেয়ে মহৎ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। সে পরিচয় তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে রেখেছেন তাঁর গানে।’ (পৃ. ২৫৩, নজরুলগীতি প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী ১৯৯৬)। তিনি আরও বলেন, ‘হিন্দুধর্মসংগীত পর্যায়ে কাজী নজরুল ইসলামের রচনা একদিকে যেমন বিপুল অপরদিকে তেমনি বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্যের ব্যাপকতা এমনি বিস্ময়কর যে স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। অপর কোন বাঙালি কবির রচনাকর্মে হিন্দুধর্ম-সম্পৃক্ত বিষয়ের এমন বহুমুখী রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করা যায়নি। বর্তমান শতকের ত্রিশের দশকের পরবর্তীকালে গেয় জনপ্রিয় হিন্দুধর্ম সংগীতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই নজরুলের রচনা (প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৩)।’
এই বিপুলতার উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে হরফ প্রকাশনীর অখণ্ড নজরুলগীতির ষষ্ঠ সংস্করণে এই শ্রেণিতে সংকলিত ৫৪২টি গানের সঙ্গে আরো অনেক গানই যুক্ত হচ্ছে নানাসূত্রে নিত্যপ্রাপ্ত নজরুলগীতির অশেষ ভাণ্ডার থেকে। আর বৈচিত্র্যের দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে নজরুলের বেশুমার ভক্তিগীতিতে বন্দিত হয়েছেন কেবল শক্তিদেবী কালী নয়, বরং নানা রূপের নানা কালী—শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, নিত্যকালী, মহাকালী। তেমনি দুর্গাও গীত হয়েছেন চণ্ডী, কৌষিকী, শাকম্ভরী, সতী প্রভৃতি রূপে। শাক্ত ও বৈষ্ণবীয় দেবীকাহিনীর হেন অনুষঙ্গ নেই যা নজরুলের গানে আসেনি। পৌরাণিক বিষয়াবলীর এমন জম্পেশ সমাবেশ অন্য কোন সংগীতকারের রচনায় ঘটেনি।
৬.
নজরুল প্রবর্তিত ইসলামী গানের ধারাটিকে এখানে আমি বলব মুসলিমধর্মসংগীত যেহেতু এটি হিন্দুধর্মসংগীতের পরিপূরকরূপে বাংলার ভক্তিগীতির ধারাটিকে অভূতপূর্ব এক পরিপূর্ণতা দান করেছে। দুই শতের মতো গান দিয়ে মাত্র কয়েক বছরে তিনি বাংলা শীলিত সংগীতের ঐতিহ্যে ইসলামী ভক্তিসংগীতের ধারাটি সংযোজন করেন। সুদীর্ঘ কালের পরম্পরাগত চর্চার ফলে ভক্তিসংগীতের অন্যান্য শাখা যথা ব্রহ্মসংগীত, শ্যামাসংগীত, উমাসংগীত প্রভৃতি যে-উচ্চতায় উঠেছে—ইসলামী গানকে লোকসংগীতের পর্যায় থেকে রাগসংগীতের লেবাস পরিয়ে নজরুল এক হাতেই সেখানে উন্নীত করে দিয়ে ইসলামের নতুন এক সাংগীতিক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
লোকসংগীত প্রভাবিত ইসলামী গানের উদাহরণ হচ্ছে—ওরে ও দরিয়ার মাঝি, পুবান হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া, এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি প্রভৃতি। রাগসংগীতের সুররঞ্জিত ইসলামী গানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে—মোহররমের চাঁদ এল ঐ, ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে, সাহারাতে ফুটল রে ফুল, খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে, বক্ষে আমার কাবার ছবি, যাবি কে মদীনায়, ইসলামের ঐ সওদা লয়ে প্রভৃতি। আল্লা-রসুলের প্রশস্তি, ধর্মীয় বিধান, ইসলামের ইতিহাস, এবাদত, বন্দেগী, মাযার, মসজিদ ইত্যাদি বিষয় অবলম্বন করে নজরুলের মুসলিমধর্মসংগীতমালা গ্রথিত। হামদ বা আল্লার জয়গানের উদাহরণ—তুমি অনেক দিলে খোদা দিলে অশেষ নিয়ামত, তুমি আশা পুরাও খোদা সবাই যখন নিরাশ করে, তোমারি মহিমা সব বিশ্বপালক করতার, রোজ হাশরে আল্লা আমার করো না বিচার ইত্যাদি।
এর মধ্যে মোনাজাতরূপে উল্লেখিত গানগুলির সুরবাণীর আবেদন সর্বজনীন এবং সর্বকালীন, যেমন ‘খোদা এই গরীবের শোনো শোনো মোনাজাত’, ‘শোনো শোনো ইয়া ইলাহী আমারি মোনাজাত’ ইত্যাদি। আবির্ভাব ও তিরোভাবসহ নবীমহিমা বিষয়ক নাত-শ্রেণির সংগীতে ইসলামী গানের শীর্ষে আরোহণ করে নজরুল তাঁর সাংগীতিক উচ্চতার প্রতিনিধিত্বকারী ইসলামী গান উপহার দেন—যেমন মোহাম্মদ নাম যতই জপি, ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ, এ কোন মধুর শরাব দিলে ইত্যাদি। রমজান এবং ঈদ ছাড়াও নজরুল অবিস্মরণীয় যত গান রচনা করেন কাবা ও হজ্ব বিষয়ে যেমন দুখের সাহারা পার হয়ে আমি চলেছি কাবার পানে, পূবান হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া প্রভৃতি।
মসজিদ-আজান-নামাজ বিষয়ে—যেমন বাজল কি রে ভোরের শানাই, মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ, আঁধার মনের মিনারে মোর হে মুয়াজ্জিন দাও আজান প্রভৃতি। মোহররম বিষয়ে যেমন—মোহররমের চাঁদ এল ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়, ওগো মা ফাতেমা ছুটে আয়, ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে প্রভৃতি। ফাতেমা, আরব, মক্কা, মদীনা বিষয়ে যেমন—খাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননী বিশ্বদুলালী নবীনন্দিনী, দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটির হতে, সুদূর মক্কা মদীনার পথে আমি রাহি মুসাফির, ভেসে যায় হৃদয় আমার মদীনা পানে ইত্যাদি। মোট কথা বাংলা কাব্যসংগীতের দীর্ঘকালের লালিত ধারায় রাতারাতি একই মানের ইসলামী গানের যোজনা কাজী নজরুল ইসলামের এক অবিশ্বাস্য কীর্তি। তার ওপর রেকর্ড রিলিজমাত্রই এ-গানের বিস্ফোরক জনাদৃতির সূত্রে বিস্ময়কর বিপণন সাফল্য এক অকল্পনীয় ইতিহাসেরই সৃষ্টি করেছে।
নজরুলের নতুন সুরের এই মধুর সুরধুনী, ধর্ম কর্তৃক নিরুৎসাহিত মুসলমানদের এতোই সংগীতমনস্ক করে তোলে যে মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত বঙ্গদেশে ইসলামী গানই হয়ে ওঠে রেকর্ড কোম্পানির বেস্টসেলার সিরিজ। ফলে নজরুলসৃষ্ট এই নবধারার গান রেকর্ড করার জন্য এত শিল্পীর প্রয়োজন পড়ে যে, ক্রেতার কথা ভেবে বহু হিন্দু গায়ক-গায়িকাকে মুসলিম নাম ধারণ করতে হয় রেকর্ডের লেবেলে। এই প্রক্রিয়ায় রেকর্ডের লেবেলে ধীরেন দাস হয়ে যান ‘গনি মিঞা’ (তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ ক্ষমা করো হজরত, তোমারি প্রকাশ মহান এ নিখিল দুনিয়া জাহান, ঈদের খুশির তুফানে আজ ভাসলো দো-জাহান, মেষ চারণে যায় নবীকিশোর রাখাল বেশে, মারহাবা সৈয়দ মক্কী মদনী আল-আরবী, ফুরিয়ে এলো রমজানের এই মোবারক মাস, এসেছি তব দ্বারে ভক্তিশূন্য প্রাণে)।
ঊষারাণী হয়ে যান ‘রওশন আরা বেগম’ (আমার ধ্যানের ছবি আমার হজরত, নতুন চাঁদের তকবীর শোন কয় ডেকে ঐ মুয়াজ্জিন, হেরেমের বন্দিনী কাঁদিয়া ডাকে তুমি শুনিতে কি পাও, হে প্রিয় নবী রসূল আমার, তোমারি নূরের রওশনী মাখা নিখিল ভুবন, নিশিদিন জপে খোদা দুনিয়া জাহান)। সীতা দেবী হয়ে যান ‘দুলি বিবি’ (আমি বাণিজ্যেতে যাব এবার মদীনা শহর, ওগো মুরশীদ পীর বলো রসুল কোথায় থাকে)। হরিমতী দেবী হয়ে যান ‘সাকিনা বেগম’ (আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ, কেন তুমি কাঁদাও মোরে হে মদিনাওয়ালা, এলো এলো শবে বরাত তোরা জ্বাল রে বাতি, ভক্তিভরে পড় রে তোরা কলমা শাহাদাত, চীন আরব হিন্দুস্থান নিখিল ধরাধাম, নামাজ-রোজা হজ্জ-জাকাতের পসারিনী আমি, প্রিয় মোহ্রে নবুয়তধারী হে হজরত তরিতে উম্মতে এলে ধরায়, মসজিদে ঐ শোন রে আজান,)। গিরীণ চক্রবর্ত্তী হয়ে যান ‘সোনা মিয়া’ (ঈমান বাইন্ধা রাখ রে, মন রে মায়া জগতের মূল মায়া)। গিরীণবাবুই আবার আরেক গানের জন্য হয়ে যান গোলাম হায়দার এন্ড পার্টি (আল্লার নাম জপিও ভাই, ইয়া আল্লা তুমি রক্ষা কর)। তিনিই আরেক গানের জন্য হন সুজন মাঝি (আকাশের আর্শীতে ভাই পইরাছে মোর মনের ছায়া)। চিত্ত রায়কে হতে হয়েছে দেলওয়ার হোসেন (ক্ষমাসুন্দর আল্লা, মোদের ভয় দেখিও না আর, আল্লা রসূল তরু আর ফুল প্রেমিক হৃদয় জানে)।
এক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি বিড়ম্বিত হতে হয়েছিল মুনশী মহম্মদ কাসেমকে। খদ্দেরের রুচিসম্মত হওয়ার জন্য মহম্মদ কাসেম মল্লিককে অতুল-নজরুল প্রমুখের গান গাওয়ার জন্য প্রথমে হতে হয়েছিল কে. মল্লিক (‘ডাকে কোয়েলা বারে বারে’, ‘কেন কাঁদে পরাণ’, ‘কেন দিলে এ কাঁটা’ এবং হিন্দি জাতীয় গান গাওয়ার জন্য শঙ্কর মিশ্র (অম্বরে মেঘে মৃদঙ্গ বাজে জলদ তালে, দোলে প্রাণের কোলে প্রভুর নামের মেলা, ও কে মুঠি মুঠি আবির কাননে ছড়ায়)। পরে আবার ইসলামী গান গাওয়ার জন্য তাঁকে হতে হল ‘মনু মিয়া’ (ও রে ও মদীনা বলতে পারিস কোন সে পথে তোর, দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটির হতে, আমিনা দুলাল নাচে হালিমার কোলে, তোমার নামের এ কি নেশা হে প্রিয় হজরত)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ইসলামী গান গাননি বলে তালাত মাহমুদ কেবল হিন্দু-নামেই নজরুলগীতি গেয়েছেন—তপনকুমার।
৭.
১৯৩৩ থেকে শুরু হয় নজরুলের আধুনিক ও লোকসংগীত ধারার সংগীতসৃষ্টির পর্ব। বিগত শতকের ত্রিশের দশকে প্রবর্তিত আধুনিক বাংলা গানের যে-মেলডি কিংবা সুরলহরী আজকের প্রজন্মকেও মাতায় বলে হালের গানের বাজারটি ‘রিমেকিঙে’র বাজার হয়ে দাঁড়ায়—সুরমূর্ছনা প্লাস শব্দগ্রন্থনার সে-মডেলটির প্রতিষ্ঠাতা কাজী নজরুল ইসলাম। জনসাধারণের মনমাতানো সুর ও শব্দের এই সহজ সরল সাংগীতিক বিন্যাসটি তিনি সৃষ্টি করেন প্রধানত গ্রামোফোন-বেতার ও সবাক সিনেমার ত্রিমুখী চাহিদার দ্রুতবর্ধিষ্ণু তাগিদে। বাংলাগানের ভুবনে চাহিদা কিংবা বাজারের ব্যাপারটি ১৯০৪ সালে এদেশে আসা গ্রামোফোন কোম্পানির নতুন সংযোজন। ১৯২৭ সালে যুক্ত হওয়া বেতারবাহিত গণসম্প্রচার মাধ্যমের দিবারাত্রির ক্ষুধা এবং ১৯৩১ সালে সবাক হওয়া চলচ্চিত্র মারফত বর্ধিত সংগীততৃষ্ণা নিবারণের কারণেও বহুগুণ বেড়েছে এই চাহিদা। এই তিনটি নতুন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলার মহৎ সংগীতকারদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ছিলেন কেবল নজরুলই।
[এ-কারণেই কি বাংলা গানের অন্যান্য শাখার বিখ্যাত শিল্পীদের রেকর্ডেও আমরা নজরুলসংগীত শুনতে পাই? যেমন সাহানা দেবীর রেকর্ডের কথা আগেই বলা হয়েছে। কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে কলম্বিয়ার রেকর্ডে: চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, কোথা তুই খুঁজিস ভগবান, মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর, আমি দ্বার খুলে আর রাখবো না পালিয়ে যাবো গো। ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে কলম্বিয়ার রেকর্ডে: না মিটিতে মনোসাধ যেয়ো না হে শ্যামচাঁদ, বৃথা প্রবোধ দিস নে ললিতে। পান্নালাল ভট্টাচার্যের কণ্ঠে কলম্বিয়ার রেকর্ডে: আর লুকাবি কোথায় মা কালী, আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়। তালাত মাহমুদের কণ্ঠে এচএমভি’র রেকর্ডে: নিশি ভোর হল জাগিয়া পরাণ পিয়া, আসলো যখন ফুলের ফাগুন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে এচএমভি’র রেকর্ডে: হে বিধাতা দুঃখ শোক মাঝে তোমারি পরশ রাজে প্রভৃতি।]
সারকথা, ত্রিশের দশকের সূচনায় সৃষ্ট সবিশেষ সাংগীতিক পরিস্থিতির নিজস্ব উত্তাপে গ্রামোফোন কোম্পানির সদ্য নিয়োজিত গীতিকার-সুরকার-প্রশিক্ষক কাজী নজরুল শব্দ ও সুরের যে-সুরমূর্ছনা বা সুতান সৃষ্টি করলেন তার নাম নিজেই কোথাও লিখলেন ‘মডার্ণ’ কোথাও লিখলেন ‘আধুনিক’ (আমার জানামতে পঞ্চপ্রধানের আর কেউ তাঁদের কোনো শ্রেণীর গানকে এই অভিধায় অভিহিত করেননি)। এই শিরোনামের মাধ্যমে নজরুল যেন বোঝাতে চাইলেন, এ গান কোনো নির্দিষ্ট সুর-শব্দ কিংবা রূপবন্ধের কাছে দায়বদ্ধ নয়, এ গান সাংগীতিক বিন্যাসে মুক্ত রীতির, এ গান জনচিত্ত অভিমুখী, এ গানের উৎসার হৃদয় থেকে, অভিসারও হৃদয়ের দিকে। সংগীতরচয়িতা হিসাবে বস্তুত এই সমস্ত গুণই নজরুলের বৈশিষ্ট্য।
গানে তিনি সর্বদা উপস্থিত শ্রোতাকেই সম্বোধন করেন। জনচিত্তমুখিতাই নজরুলসৃষ্ট নব্যআধুনিকতার মূলকথা। সংগীতে এত কালের অন্তর্মুখিতার বদলে নজরুল-আনীত বহির্মুখিতা তাঁর গানের তাৎক্ষণিক জনাদৃতি এবং শ্রোতৃসমাজের কাছ থেকে উচ্ছ্বসিত সাড়া পাওয়ার একটা বড়ো কারণ। তাৎক্ষণিক সে-জনাদৃতি কালজয়ী হয়ে সমানে বিদ্যমান আছে অদ্যাবধি। নজরুল প্রবর্তিত সেই আধুনিক বাংলা গান তাই আজ বোদ্ধা মহলে ‘ধ্রুপদী আধুনিক’ বলে অভিহিত। হরফ প্রকাশনীর ‘অখণ্ড নজরুল গীতি’র ষষ্ঠ সংস্করণে নজরুলের আধুনিক গান সংকলিত হয়েছে ৭৮১টি। তবে চলমান আহরণের প্রক্রিয়ায় সংখ্যাটা বিপুলতর হবার কথা এবং হয়ে চলেছেও।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বাংলা গান নজরুলের আবির্ভাব পর্যন্ত ছিল মোটামুটি সর্বজ্ঞশাসিত অর্থাৎ কথাকার, সুরকার ও রূপকার একই ব্যক্তি—যেমন রামপ্রসাদ, রামনিধি, রবীন্দ্রনাথ। প্রতিপক্ষে নজরুল তাঁর গানকে বিশেষজ্ঞদের দক্ষতা মারফত সমৃদ্ধতম হয়ে ওঠার পথ করে দিলেন। যেমন কথাকার নজরুল গানের দাবির বিচারে গানবিশেষকে সুরারোপ করতে দিলেন কমলদাশগুপ্তকে কিংবা শৈলেশ দত্তগুপ্তকে এবং গাইতে দিলেন উস্তাদ জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীকে কিংবা অভিনেত্রী-গায়িকা কাননবালাকে। তবে স্মর্তব্য যে সংগীতের সামগ্রিক রূপবন্ধটির ‘নজরুলিয়া’ বৈশিষ্ট্যগুলি সংরক্ষিত থাকতো যেহেতু আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞগণ সকলেই ছিলেন—উদ্যাপিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী বাংলার অন্যতম প্রধান কাব্যসংগীতকার, কাজী নজরুল ইসলামের পরম ভক্ত পরিকর।
নজরুল প্রযোজিত—বিশেষজ্ঞ গীতিকার বিশেষজ্ঞ সুরকার ও বিশেষজ্ঞ রূপকার—এই তিন রত্নের সম্মিলিত অবদানে আধুনিক বাংলা গান উৎপাদিত হচ্ছে আজও। তবে মান থাকছে না ম্যাসপ্রোডাকশনের কারণে, যেজন্যে সৃজিত না-বলে উৎপাদিত হচ্ছে বলতে হল। এদেশে যথা-অর্থে আধুনিক গানের প্রথম মিউজিক কম্পোজার ও প্রডিউসার কাজী নজরুল ইসলাম। কথাটা বলেছেন সংগীতগুণী সুকুমার রায়। দিলীপকুমার রায়ও ঠিকই বলেছিলেন যে এর আগে মিউজিক কম্পোজিশনের কোনো কনসেপ্টই ছিল না আমাদের। তাই বলতে হয় সাবেক কালের শেষ প্রধান প্রতিনিধি যেমন নজরুল, আধুনিক কালের প্রথম প্রধান প্রতিনিধিও তিনিই।
নজরুলের কালজয়ী আধুনিক গানের কিছু উদাহরণ: অরুণ রাঙা গোলাপ কলি, আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়, আমার ভুবন কান পেতে রয় প্রিয়তম তব লাগিয়া, আমায় নহে গো ভালবাস শুধু ভালবাস মোর গান, আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, আমি পূরব দেশের পুরনারী, আমি যার নূপুরের ছন্দ, কথা কও কও কথা থাকিও না চুপ করে, সবার কথা কইলে কবি, কেন মন বনে মালতী বল্লরী দোলে, গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়, গানগুলি মোর আহত পাখির সম, চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়, জানি জানি প্রিয় এ জীবনে মিটিবে না সাধ, তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, তুমি হাতখানি যবে রাখ মোর হাতের পরে, নাই চিনিলে আমায় তুমি রইব আধেক চেনা, বলেছিলে তুমি তীর্থে আসিবে আমার তনুর তীরে, বঁধু তোমার আমার এই যে বিরহ এক জনমের নহে, বিদায় সন্ধ্যা আসিল ঐ, মনে পড়ে আজ সে কোন্ জনমে বিদায় সন্ধ্যা বেলা, মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম, যবে তুলসীতলায় প্রিয় সন্ধ্যাবেলায়, যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, সাঁঝের পাখীরা ফিরিল কুলায় প্রভৃতি।
৮.
নজরুলসংগীত শব্দটা শুনেই অনুষঙ্গবাদীরা, লোকসংগীতের অঙ্গনটি টপকে, রাগসংগীতের ভাবানুষঙ্গে চলে যান এবং ভুলে বসেন যে লোকসুরই রাগসুরের মূলাধার। সেদিক থেকে আজন্ম রাগসংগীতপ্রেমী নজরুলের লোকসুরের সঙ্গে ছিল নাড়ির সম্পর্ক। সে-কারণে লোকসুরভিত্তিক বাংলা গানে তাঁর অবদান ছিল মৌলিক এবং উচ্চতম মানের। নজরুলের পূর্বে কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে অতুলপ্রসাদ সেন পর্যন্ত লোকসংগীতের কেবল বাউল সুরাঙ্গ অবলম্বনে গান রচিত হয়।
কিন্তু নজরুলের রচনায় বাউল ছাড়াও ঝুমুর, ঝাপান, সারিসহ ভাটিয়ালী-ভাওয়াইয়া ইত্যাদি নানান সুরভঙ্গি এসে মিলে মিশে লোকসংগীতভিত্তিক আবহমান বাংলার গানের ধারাটিও অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে তাঁর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান উপজাতীয় সুর ঝুমুরঢঙের নিবিড় এবং ব্যাপক ব্যবহার। তাঁর এই অসাধারণ সাফল্যের অন্যতম কারণ—ঝুমুর অঞ্চলের লোক হওয়ার সুবাদে তাঁর ধমনীতে প্রবাহিত এই লোকসুরটির প্রয়োগ নজরুলের জন্যে হয়েছিল খুবই স্বতঃস্ফূর্ত। ফলে সৃষ্ট হয়েছে, এই বিশেষ লোকসুরমণ্ডিত অনেক কালজয়ী গান যেমন—এসো ঠাকুর মহুয়া বনে ছেড়ে বৃন্দাবন, কুনুর নদীর ধারে ঝুনুর ঝুনুর বাজে, ঝুম ঝুম ঝুমরা নাচ নেচে কে এল গো, তেপান্তরের মাঠে বঁধু হে একা বসে থাকি, হলুদ গাঁদার ফুল রাঙা পলাশ ফুল, নিমফুলের মউ পিয়ে ঝিম হয়েছে ভোমরা, চুড়ির তালে নুড়ির মালা রিনি ঝিনি বাজে লো, ও ঝুমরো তীর-ধনুক নিয়ে বল না কোথায় যাস, এই রাঙামাটির পথে লো প্রভৃতি।
তেমনি আজও সমান জনপ্রিয় নজরুলের ঝাপান সুরভঙ্গির গান যেমন হলুদ গাঁদার ফুল, কথা কইবে না বউ, কলার মান্দাস বানিয়ে দাও গো শ্বশুর সওদাগর, ওঠাও ডেরা এবার দূরে যেতে হবে, চিকন কালো বেদের কুমার কোন পাহাড়ে যাও প্রভৃতি। নজরুলের বেদে-বেদেনীর গানেও পাওয়া যায় সম্পূর্ণ নতুন ব্যঞ্জনা। মৌলিক সংগীতপ্রতিভা সাধারণ একটি লৌকিক সুরকে কেমন অলৌকিক সুরলোকে নিয়ে যেতে পারে—তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ নজরুলের ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’ গানটি।
ভাটিয়ালী ঢঙে অভিনব সুরযোগে নজরুলের মানের গান আর কেউ রচনা করেছেন বলে আমার মনে হয় না এবং এর প্রমাণ কেবল ইতিহাস সৃষ্টিকারী গান ‘পদ্মার ঢেউ রে’-ই নয়। এক্ষেত্রে তাঁর অনেক গানই অদ্যাবধি অনতিক্রান্ত যেমন, ‘এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে এই ত নদীর খেলা’, ‘আমার সাম্পান যাত্রী না লয়’, ‘আমার ভাঙা নায়ের বৈঠা ঠেলে’ ইত্যাদি। আর ভাওয়াইয়া ঢঙেও অমর হয়ে আছে তাঁর ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা’, ‘পদ্মদীঘির ধারে ঐ সখি লো কমল দীঘির ধারে’ ইত্যাদি।
বিভিন্ন লোকসুরের বৈচিত্র্যবিলাসী নজরুল কিন্তু পূর্বসূরিদের ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত বাউল সুর প্রয়োগেও বহু কালজয়ী গান সৃষ্টি করেছেন, যেমন—‘বাঁশি বাজায় কে কদমতলায় ওগো ললিতে’, ‘ভবের এই পাশা খেলায় খেলতে এলি হায় আনাড়ি’, ‘আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল আমার দেউল আমার এই আপন দেহ’, ‘ওহে রাখাল রাজ! কি সাজে সাজালে আমায় আজ’, ‘অসীম আকাশ হাতড়ে ফিরে খুঁজিস রে তুই কাকে’, ‘তুমি দুঃখের বেশে এলে বলে ভয় করি কি হরি’ প্রভৃতি। এ পর্যন্ত সংকলিত নজরুলের লোকসুরঋদ্ধ গানের সংখ্যাও কম নয়, প্রায় ১৫০। লোকসুরের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে নানা রকম লাগসই সুর পুরে বহু কালজয়ী গান রচনা করার সুবাদে নজরুল পথিকৃৎ হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন লোকসংগীতের ক্ষেত্রেও।
কাজী নজরুল ইসলাম স্মরণীয় হয়ে আছেন প্রকৃতি পর্যায়ের বহু অমর গানের কারণেও—বিশেষত বর্ষা, বসন্ত ও শরৎ ঋতু বিষয়ক (শরতের জন্য প্রধানত উমাসংগীত স্মর্তব্য)। উদাহরণ : (বর্ষা) এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া, মেঘের হিন্দোলা দেয় পূব হাওয়াতে দোলা, এল বরষা শ্যাম সরসা প্রিয় দরশা, রুম্ ঝুম্ ঝুম বাদল নূপুর বোলে বোলে, (বসন্ত) আসে বসন্ত ফুলবনে, এল ঐ বনান্তে পাগল বসন্ত, ফুল ফাগুনের এল মরশুম, আজি দোল ফাগুনের দোল লেগেছে, বসন্তমুখর আজি, (শরৎ) এস শারদপ্রাতের পথিক এস শিউলি বিছানো পথে প্রভৃতি।
কমিক-রিলিফরূপী বিষ্কম্ভক কিংবা গর্ভনাটক ছাড়াও, হাস্যরস সিনেমা-নাটকের শক্তিশালী অঙ্গবিশেষ। এই রসের স্বভূমি নয় সংগীত। তবু পঞ্চপ্রধানের দুজন তাঁদের গানেও এর শক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন—দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ব্যঙ্গগীতিতে ও রজনীকান্ত সেন রঙ্গগীতিতে। এই দুইজনের হাসির হাট জমজমাট থাকতেই অসাধারণ দক্ষতায় নজরুল তাঁর ব্যঙ্গগীতি ও রঙ্গগীতির—এককথায় হাস্যগীতির—পশরা সাজিয়ে মাতিয়েছিলেন সমগ্র বাংলার আবালবৃদ্ধবণিতাকে। তবে এ প্রসঙ্গে এও স্মর্তব্য যে গুরুগণের তুলনায় নজরুল উপকরণগত সুযোগ পেয়েছিলেন অনেক বেশি, যেমন গ্রামোফোন-বেতার-চলচ্চিত্র, আরো পেয়েছিলেন অনেক বেশি প্রতিভাবান গায়কের দল যেমন রঞ্জিত রায়, হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিমল গুপ্ত (দাশগুপ্ত) প্রমুখ।
এক্ষেত্রেও নজরুলের অনেক গানই কালজয়ী হয়েছে গানগুলির উপজীব্য চিরন্তন বলে—যেমন, টিকি আর টুপিতে লেগেছে দ্বন্দ্ব, বদনা গাড়ুতে মুখোমুখি বসে, দয়া করে দয়াময়ী ফাঁসিয়ে দে এই ভুঁড়ি, দে গরুর গা ধুইয়ে, আমার খোকার মাসী, প্রিয়ার চেয়ে শালী ভাল, ওহো আজকে হইব মোর বিয়া, আমার হরিনামে রুচি পরিণামে লুচি, ও তুই উল্টো বুঝ্লি রাম, দুপেয়ে জীব ছিল গদাই বিবাহ না করে প্রভৃতি।
নজরুল নিজেও তাঁর কাব্যের চেয়ে সংগীতের উপর বেশি আস্থা রাখতেন। মুজফ্ফর আহ্মদ তাঁর ‘নজরুল স্মৃতিকথা’য় লিখেছেন ‘আমার মনে আছে, একদিন শ্রীভূপতি মজুমদার বলেছিলেন—“নজরুল, কী তুমি এত ভালো গান গাও যে গান পেলেই মেতে ওঠ।” সেদিন নজরুল খুব আহত হয়েছিল। সে বলেছিল, “ভূপতি-দা আমার কবিতার যত খুশি সমালোচনা করুন। কিন্তু আমার গানের সম্বন্ধে কিছু বলবেন না।” (নজরুল-চরিতমানস, ড. সুশীলকুমার গুপ্ত, পৃ. ৩৪৯)।
তাঁর সংগীতের উৎকর্ষ সম্পর্কে নজরুল বরাবরই অবহিত ছিলেন। ১৯৩৮ সালে জনসাহিত্য সংসদের ভাষণে নজরুল বলেছিলেন, ‘সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই তবে এইটুকু মনে আছে, সঙ্গীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি। সঙ্গীতে যা দিয়েছি সে সম্বন্ধে আজ কোনো আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে তখন আমার কথা সবাই মনে করবেন—এ বিশ্বাস আমার আছে।’
একই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অভিন্ন উক্তিগুলিও এখানে উল্লেখ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। সংগীত-বিভাগের অধ্যক্ষ হেমেন্দ্রলাল রায়ের ভ্রাতা মেঘেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নিজে আমায় বলিয়াছিলেন’, “তোমরা কবি টবি যা বলো বলতে পারো, কিন্তু গানেই আমি বড়।” (প্রাগুক্ত, পৃ.৩৫০)। ৭ মার্চ ১৯৩৪ কিশোরীমোহন সাঁতরাকে লেখা পত্রে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আমার কাব্যের কোনোকালে অনাদর হতেও পারে কিন্তু বাংলাদেশের লোককে আমার গান গাইতেই হবে—সেই গানের সুরগুলি যদি বিকৃত বা লুপ্ত হয় তবে তাতে দেশের ক্ষতি এ আমি অহংকার করেই বলতে পারি’।
কথাগুলি যাঁরা বলেছেন তাঁরা-যে নির্ভুল ভবিষ্যতদ্রষ্টা তা আজ একুশ শতকের শূন্য-দশকশেষেও বিশ্বের পঁচিশ কোটি বাঙালি এক বাক্যেই বলতে পারে।
৯.
বাংলার সংগীতজগতে কাজী নজরুল ইসলামের এতসব নবসংযোজনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন না-হওয়া ছিল বিস্ময়কর। তার বদলে অবমূল্যায়ন হওয়া ছিল হতভম্বকর। কিন্তু কেন? কারণ কি এই যে নজরুল মাত্র ষোল বছর সংগীত রচনা করার পরই সম্বিত হারান ১৯৪২ সালে? না। ট্র্যাজিডিটি বরং তাঁর মহৎ কীর্তির প্রতি বর্ধিত দৃষ্টি আকর্ষণ করার কারণ হওয়ার কথা। বাস্তবে হয়েছে বিপরীত। যে-নজরুল বিশের দশকে বাংলার কাব্যজগতে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে ত্রিশের দশকে বাংলার সংগীতজগতের নায়করূপে বরিত হয়েছিলেন, সম্বিত হারানোর পর থেকে বারোটি বছর সে-নজরুলের শিল্পকর্ম তাঁর কর্মক্ষেত্র কলকাতাতেই সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে রইল।
নজরুল বিষয়ে প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করেন আজহারউদ্দীন খান (১৯৩০- ), ১৯৫৪ সালে তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থটি প্রকাশ করে (প্রকাশক, ক্যালকাটা বুক ক্লাব, ডিমাই পৃষ্ঠা সংখ্যা ২১২)। ৫০ বছর পর বইটি ২০০৪ সালে প্রকাশিত, বহুগুণ পরিবর্ধিত সপ্তম সংস্করণও আলোকঋদ্ধ হওয়ার চেয়ে তথ্যসমৃদ্ধই হয়েছে বেশি (প্রকাশক, সুপ্রিম পাবলিশার্স, রয়েল পৃ. ৮০৮)। এর পর ১৯৬০ সালে প্রকাশিত ড. সুশীলকুমার গুপ্ত’র (১৯২৬-৯৭) ‘নজরুল-চরিতমানস’ গ্রন্থটি বাঙালীর সংস্কৃতিতে নজরুলের যথাযথ অবস্থান নির্ণয় করে সুধীসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বটে তবে বেশ কিছু বিভ্রান্তিও ছড়িয়েছে। বর্তমানে বাজারে আছে কিছু নতুন তথ্য ও তত্ত্ব সংযোজিত গ্রন্থটির তৃতীয় দে’জ সংস্করণ। বইটি সংগীত-অংশে দীনতর। ক্রিয়াত্মক ও তত্ত্বীয় সংগীতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় আছে, তেমন পাঠকের মনে হবে ড. গুপ্ত’র অনেক ধারণাই ধার করা এবং ভুলে ভরা। কয়েকটা নমুনা:
‘বস্তুতঃ রবীন্দ্রসংগীতের সুরবৈচিত্র্য আর কোন ভারতীয় সুরকারের রচনায় দেখা যায় না।’ (পৃ.৩২০)।
‘আমার মনে হয় সবদিক বিচার করলে বীর্যব্যঞ্জক গানে নজরুল দ্বিজেন্দ্রলালের চেয়েও বড় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বী।’ (পৃ. ৩৪৬)।
‘মানবিক প্রেমগীতির মধ্যে নজরুলের গজলগুলি সর্বোৎকৃষ্ট।… তাঁর অন্যান্য প্রেমগীতিতে রবীন্দ্রপ্রভাব বিশেষভাবে অনুভূত হয়।’ (পৃ. ৩৩৭)।
‘তাঁর শ্যামাসংগীত রামপ্রসাদের আদর্শে রচিত। কীর্তন, বাউল প্রভৃতি গানে নজরুলের উপর রবীন্দ্রপ্রভাব খুবই বেশী।’ (পৃ. ৩৩৭)।
তবু বহু মূল্যবান উপাত্তের আকর এই গ্রন্থদুটির ঐতিহাসিক ভূমিকা বিরাট, যথা—ওই হন্তারক দুর্দিনে বিস্ময়কর কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে দ্রুতবিস্মরণশীল কালটিতে সার্বিক তথ্যাবলী তুলে ধরা এবং তা দুই মলাটের ভেতরে সংরক্ষণ করা।
সমসময়ে নজরুলের রচনাবলী সংরক্ষণের হাল ধরেছিলেন নজরুল গবেষণার পথিকৃৎ আবদুল কাদির। তাঁর উদ্যোগে প্রথমে পাকিস্তান পাবলিকেশন্স থেকে নজরুল-পরিচিতি নামে প্রবন্ধসংকলন বের হয় ১৯৫৯ সালে এবং নজরুল রচনাসম্ভার প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে ঢাকা থেকে, তবে সম্পাদকের নাম ছাড়া। গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ আবদুল কাদির সম্পাদিত বলে কলকাতার হরফ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে, কিন্তু সেটিও সম্পাদকের সমজদার প্রবেশক কিংবা রসগ্রাহী ভূমিকা ছাড়া।
চল্লি¬শের দশকের শেষ ও পঞ্চাশের দশকের প্রথমাংশে সম্বিতহারা নজরুলের শিল্প সম্পর্কিত চর্চা বিঘ্নিত হওয়ার বেশকিছু প্রসঙ্গবহির্ভূত কারণও ছিল যথা—মহাযুদ্ধ, মহাদুর্ভিক্ষ, দাঙ্গাহাঙ্গামা, দেশভাগ, সংগীতশিল্পীসহ গুণীজনদের বিপুলহারে দেশান্তরী হওয়া ইত্যাদি। অনতিবিলম্বেই অবশ্য বিখ্যাত নজরুলসংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম ও তাঁর স্বামী নজরুলসংগীতের অন্যতম পুরোধাপুরুষ কমল দাশগুপ্ত কলকাতায় ফিরে গিয়ে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীদের দিয়ে নজরুলগীতির এলপি বের করার উদ্যোগ নেন। প্রথমদিককার খ্যাতনামা নজরুলসংগীতশিল্পী সন্তোষ সেনগুপ্তের পরিচালনায় লাভ সঙ্স অব নজরুল শীর্ষক প্রথম এলপি-টি সুপারহিট হতেই বলতে গেলে সেখানে নজরুলচর্চার পুনরভ্যুদয় হয় যথাযোগ্য উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে। ষাটের দশকের শুরুতে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় নজরুলের উদ্দীপনী সংগীতনিচয় কলকাতার বেতার ও মঞ্চ মারফত জনগণকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে এবং এই প্রক্রিয়ায় নজরুলচর্চাও পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
তবে নজরুলচর্চার দ্বিতীয় অধ্যায় ইতিমধ্যেই স্থানান্তরিত হয়ে যায় কলকাতা থেকে ঢাকায়, বলা যায় একরকম অলক্ষ্যেই। অতঃপর নজরুলসংগীতের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে এদেশের বেতার-টিভি ছাড়াও ঢাকার ঐতিহাসিক কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যেমন, পঞ্চাশের দশকের বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, ষাটের দশকের ছায়ানট, সংগীত মহাবিদ্যালয়, নজরুল একাডেমী, সত্তরের দশকের হিন্দোল, দোলনচাঁপা, সংগীতভবন প্রভৃতি বহুবিধ বিষয়বস্তুবিশেষজ্ঞ সংগীতপ্রতিষ্ঠান। নজরলের সাহিত্য ও সংগীতের উভয় ক্ষেত্রেই অমূল্য অবদান রাখছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত নজরুল ইন্সটিটিউট। এইসব প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত অনুধ্যানের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সংগীত সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা শুরু হয় সত্তরের দশক থেকে এবং বাংলাদেশেই। এখানে মূল্যবান কাজ করে যাচ্ছেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম নজরুলসাহিত্যে (কাজী নজরুল ইসলাম/জীবন ও সৃষ্টি, নজরুল প্রসঙ্গে প্রভৃতি) এবং ড. করুণাময় গোস্বামী নজরুলসংগীতে (নজরুল-গীতি প্রসঙ্গ, বাংলা কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান ইত্যাদি)। ‘নজরুল ইন্সটিটিউট’-এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দও নজরুল গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন।
প্রকৃতপক্ষে সংগীতশিল্পী নজরুল হাঁটতেন জনতার মিছিলে—গান লিখতেন মজলিশে বসে, সুর করতেন রিহার্সেলরুমের কোলাহলে, গান গাইতেন ঘরোয়া জলসায়, কলকারখানায়, জনসভায়, গণমিছিলে। সংগীতসৃজনরত নজরুলকে দেখতে চাইলে পাঠক কবি জসীমউদ্দীনের চোখে একনজর দেখতে পারেন:
‘আমি দেখিয়াছি গ্রামোফোন কোম্পানীতে নানা ধরনের গানের হট্টগোলের মধ্যে কবি বসিয়া আছেন—সামনে হারমোনিয়ম—পাশে অনেকগুলি পান আর গরম চা। ছ’সাতজন নামকরা গায়ক বসিয়া আছেন কবির রচনার প্রতীক্ষায়—একজনের চাই শ্যামাসংগীত, অপর জনের কীর্তন, একজনের ইসলামী সংগীত, অন্যজনের ভাটিয়ালী গান—আরেকজনের চাই আধুনিক প্রেমের গান। এঁরা যেন অঞ্জলি পাতিয়া বাসিয়া আছেন। কবি তাঁহার মানস-লোক হইতে সুধা আহরণ করিয়া আনিয়া তাঁহাদের করপুট ভরিয়া দিবেন। কবি ধীরে ধীরে হারমোনিয়াম বাজাইতেছেন, আর গুন্গুন্ করিয়া গানের কথাগুলি গাহিয়া চলিয়াছেন। মাঝে মাঝে থামিয়া কথাগুলি লিখিয়া লইতেছেন। এইভাবে একই অধিবেশনে সাত-আটটি গান শুধু রচিত হইতেছে না—তাহার সুর সংযোজিত হইয়া উপযুক্ত শিষ্যের কণ্ঠে গিয়া আশ্রয় লইতেছে।’ (সংগীত-তত্ত্ব, নজরুল প্রসঙ্গ: দেবব্রত দত্ত সংগীত প্রভাকর, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮)।
১০.
‘কাব্য ও সুরবৈভব একই সুরসূত্রে সম্পৃক্ত করে মালাকার (নজরুল) তাঁর উত্তরসুরীদের জন্য যে সুরগীতি সৃষ্টি করে গেছেন তার সত্যিকারের মূল্যায়ন আজও সম্ভব হয়নি। কবি নজরুল সংগীত জগতে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুরকার। যা, কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করার উপায় নেই। সুতরাং এই সুরের যাদুস্পর্শ একদিন জনচিত্ত জয় করবেই।’ [ পৃ. ৪৮, সংগীত-তত্ত্ব (নজরুল প্রসঙ্গ), তৃতীয় সংস্করণ, দেবব্রত দত্ত, সংগীত প্রভাকর, ব্রতী প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯১]।
তা জনচিত্ত ইতোমধ্যেই জয় করেছে নজরুলসংগীত। বরং বলতে হয় যে একমাত্র নজরুলের গানই তার সহজসরল কথা, মনোরঞ্জক সুর ও স্বভাবগত গতিক্রিয়ার জাদুবলে জনচিত্ত বা আমজনতার চিত্ত জয় করেছে, যা রবীন্দ্রনাথের গান করেনি; তার জটিল ভাবগত ও গভীর প্রকৃতিগত কারণে। অথচ এই জনগণচিত্ত জয় করাটা গানের জন্য একান্তই জরুরি। কারণটা একটু সবিস্তারেই বলছি।
আধুনিক জীবনের অতি-দ্রুত গতি, বিহ্বল প্রকৃতি, রুদ্ধশ্বাস লয়-তাল, ভোগাসক্ত মানুষের ভোগজনিত ক্লান্তি, সর্বাত্মক প্রতিযোগিতার লাগাতার চাপ ইত্যাদির ক্রমপুঞ্জিত টেনশন ঈষৎ ভুলিয়ে রাখতে চারুশিল্পগুলির মধ্যে একমাত্র সংগীতই সক্ষম। পরিশ্রান্ত মনে সহজতর সাহিত্যের চেয়েও দুরূহতর সংগীতেরই উপভোগ সম্ভব হয়। কারণ, একমাত্র এই চারুশিল্পটিই পারে মগজকে না-খাটিয়েও হৃদয়কে মাতিয়ে তুলতে। কেবল সংগীতই পারে তার স্বয়ংক্রিয় চালিকাশক্তি দিয়ে ক্লিষ্ট চিত্তটিকে মুহূর্তে উদ্দীপ্ত করে দিতে।
শাস্ত্রীয় সংগীতের সুরধ্বনি প্রস্তুতিহীন শ্রোতার মনকেও ব্যাকুল করতে পারে। নির্মিতিহীন পাঠকের মনের ওপর কাব্যশিল্পের আবৃত্তি তা করতে পারে না। একই কারণে, সিডি-রম্ বাদিত কাব্য-নাট্য-গল্প-উপন্যাসও পারে না এমপিথ্রি বাদিত সংগীতশিল্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে। কেননা, প্রি-রেকর্ডেড্ কাব্য-নাট্যাদি শ্রবণের সমান্তরাল ক্রিয়া হিসাবে অন্য কোনো কর্ম সম্পাদন করা চলে না—যেমন চলে সংগীতশ্রবণের পাশাপাশি। চিত্র, ভাস্কর্য প্রভৃতি চারুকলা তো আলোচ্য ক্ষেত্রে সংগীতের কোনো প্রতিযোগীই নয়। সংগীতের তুলনায় ওরা বড় জোর ইন্টারনেট-স্ক্রীনের নিঃশব্দ-নিষ্প্রাণ স্থিরচিত্রবিশেষ।
এ ছাড়া বড়ো একটি যুগোপযোগী বৈশিষ্ট্যও রয়েছে সংগীতের। সে হচ্ছে, এই সুকুমারশিল্পটি যে-কোনো চারুশিল্পের চেয়ে অধিকতর গণতান্ত্রিক। সংগীতশ্রবণ শ্রোতাকে ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন দ্বীপে নির্বাসিত করে না—যেমন করে পুস্তকপঠন, চিত্রদর্শন, ভাস্কর্যবীক্ষণ প্রভৃতি। অন্যান্য চারুকলার রসাস্বাদন মানুষকে তার পরিকর-পরিজন থেকে বিযুক্ত করে ফেলে, যেখানে সংগীতকলার রসোপভোগ সকলকে সংযুক্ত করে। বস্তুতপক্ষে সংগীতশ্রবণ দলেবলেও চলে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল কর্মসংগীত, যা কর্মের সহায়ক পটভূমি রচনা করে এবং কর্মগান বা ওয়ার্ক্-সঙ্, যা কর্মীগণ নিজেরা করেই প্রাণিত হন। তাই হাটে-বাটে-মাঠে-ঘাটে তথা সদরে কিংবা দফতরে—এককথায় জলেস্থলে যেখানেই যতক্ষণ মানুষ জাগে, সেখানেই ততক্ষণ মিউজিক বাজে।
সংগীত এখন, শ্রমের এবং বিশ্রামের, উভয়েরই সমান সঙ্গী। এই সদাসক্রিয় সুহৃদটি আজ জীবনসংগ্রামী সকল গণমানুষেরই শেষ প্রেরণা এবং অন্তিম ভরসা। তার পাশে যখন আর কেউ থাকে না তাকে পরামর্শ, উৎসাহ বা সান্ত¡না দেবার জন্য; তখনো থাকে বেতার-বাহিত সংগীত। যেমন নির্জন চরাঞ্চলে চাষবাসের সময়, অঘোর অরণ্যে কাঠকাটার প্রহরে, গভীর সমুদ্রে মাছধরার সমরে তথা মরু-পথহারার সুনসান দুষ্কালেও স্বজনবিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গতম জীবিকাসন্ধানীটি তার কর্মসঙ্গী হিসেবে, এমনকি মর্মসঙ্গীরূপেও, একমাত্র সংগীতকেই কাছে পায়।
এদিকে গ্রাম-গঞ্জ-শহরের জনপদেও কর্মক্লান্ত দিনের শেষে মানুষ যখন ফুরিয়ে গিয়ে ঘরে ফেরে, তখন সংগীতেরই নিজস্ব সম্মোহ তার স্বয়ংক্রিয় শক্তিবলে শ্রোতার সর্বসত্তায় পরিব্যাপ্ত হয়ে জীবন্মৃতকেও জীবন্ত করে তোলে। মোদ্দা কথা: জনসাধারণের অস্বস্তিকর অস্থিরতার টেনশান্-শাসিত এই উদ্বেগজনক বিশ্বে গণসংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুটি আজ স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছে একমাত্র সংগীতেরই স্বস্তিকর অঙ্গনে।
সেই গণসংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুর সঙ্গে বহু সূত্রে যুক্ত হতে পেরেছে নজরুলসংগীত—তার বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবীশ্রেণির জাগরণের গান নিয়ে। নারী-জাগরণের গান, যুব-জাগরণের গান, ছাত্রদলের গান, অসাম্প্রদায়িকতার গান আর হিন্দু-মুসলিম মিলনের গান নিয়ে। লেটোর গান, ভাঙার গান, সর্বহারার গান, মার্চের গান এবং সাম্যের গান নিয়ে। মুসলিম-ভক্তিগীতি, হিন্দু-ভক্তিগীতির সঙ্গে লোকগীতি, পল্লীগীতি নিয়ে। ভাটিয়ালি, সাঁওতালি, খেমটা, ঝুমুর, গজল এবং ভাঙা ঠুংরি নিয়ে। এমনকি বিচিত্র হাসির গানের বিরাট একটি ডালি নিয়েও বাংলার আপামর জনসাধারণকে মাতিয়ে দিয়েছে নজরুলসংগীত। তুলনায় রবীন্দ্রসংগীত থেকে গিয়েছে কেবলি শহুরে এবং যুক্ত হয়েছে শহরেরও প্রধানত এলিট শ্রেণিটিরই সঙ্গে।
কেবল নজরুলের গান গেয়েই খ্যাতি কুড়াচ্ছিলেন বলে তখনকার শ্রেষ্ঠ গায়কগায়িকাগণ নতুন নতুন গানের জন্য দিবারাত্র কেবল তাঁকেই ঘিরে থাকতেন। কারণ, পঞ্চপ্রধান সংগীতস্রষ্টার মধ্যে একমাত্র সমাজ ও জীবনঘনিষ্ঠ কাজী নজরুলই মানুষের কাছে যেতেন, মানুষের সঙ্গে মিশতেন, মানুষের মধ্যে থাকতেন, পরাধীনতাবিরোধী মানুষের মিছিলে ও জনসভায় নিজের লেখা গান গাইতেন এবং এইসব সূত্রে প্রত্যক্ষ প্রক্রিয়ায় যুগমানসকে জানতেন—জানতেন যুগের শ্রোতৃচিত্ত কী শুনতে চায়। আসল কথা, নজরুল গান লিখতেন পরের তরে এবং সেজন্যেই ছিলেন বহির্মুখী। তুলনায় রবীন্দ্রনাথ লিখতেন নিজের জন্য এবং এ জন্যই ছিলেন অন্তর্মুখী। নজরুলের প্রেমের গান রক্তমাংসের মানব-মানবীর এবং সে-কারণেই উদ্বেলিত আবেগপূর্ণ। তুলনায় রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানে নারীপ্রেম-প্রকৃতিপ্রেম-ঈশ্বরপ্রেম একাকার বলেই সেখানে আবেগ সমাহিত।
উদ্ভূত পরিস্থিতির এমনি পরিপ্রেক্ষিতে, বিভিন্ন বিষয়ে ইতিহাস সৃষ্টিকারী, উনিশ শতকের ত্রিশের দশকটির সংগীতক্ষেত্রে একাধারে রেডিয়ো-রেকর্ড-সিনেমা-মঞ্চসহ সকল মাধ্যমে রকমারি কাজের সুবাদে নজরুলই একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন—যখন কিনা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছয় দশকের সংগীতসৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম পর্বে সৃজনশীলতার শীর্ষে বিরাজ করছিলেন। বস্তুত রীবন্দ্রনাথের গানও জনগণের অঙ্গনে প্রথম পৌঁছেছে অতুল ও নজরুলের গানের মোটা বাদামের হাওয়ার জোরে। গুরুদেবের পাতলা পালের হাওয়া তাঁকে শান্তিনিকেতন এবং ঠাকুরবাড়ির আঙিনা থেকে বের করে বেশি দূর আনতে পারেনি—অন্য ভাষায় কথাটা বুদ্ধদেব বসু ঠিকই বলেছেন। কারণ রবীন্দ্রনাথের গান প্রধানত মানসিক, তার আত্মপ্রকাশ মুখ্যত বুদ্ধিজৈবিক। প্রতিপক্ষে নজরুলের গান হার্দিক এবং তার স্বপ্রকাশ হৃদয়বৃত্তিক।
বিশের দশকে অতুল-নজরুলের গানের জোয়ারে ভেসেই ঘর থেকে বেরিয়ে ‘রবিবাবুর গান’ ‘রবিঠাকুরের গান’ হয়েছে। ঠাকুরের সেই ভাবের গানই তাঁর শেষ পর্বে ‘রবীন্দ্রনাথের গান’ হয়ে উঠেছে—যা প্রধানত রূপেরই গান এবং গভীর উপলব্ধির। প্রতিপক্ষে নজরুলের গান ভাবের এবং তার আত্মপ্রকাশ আবেগপ্রধান। গানে নজরুল সর্বদা উপস্থিত-শ্রোতাকেই সম্বোধন করেন। জনচিত্তমুখিতাই নজরুলসৃষ্ট নব্য-আধুনিকতার মূলকথা। সংগীতে এত কালের অন্তর্মুখিতার বদলে নজরুল-আনীত বহির্মুখিতা তাঁর গানের তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা লাভের এবং শ্রোতৃসমাজের কাছ থেকে উচ্ছ্বসিত সাড়া পাওয়ার একটা বড়ো কারণ। তাৎক্ষণিক সে-জনাদৃতি কালজয়ী হয়ে সমানে বিদ্যমান আছে অদ্যাবধি।
১১.
তবু বাংলা গানের শিরোপরে প্রজ্বলন্ত এই দুই লণ্ঠনের আপেক্ষিক অবস্থানটি কিছু দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে। জগতের রবি তো সর্বদাই দেদীপ্যমান থাকেন গগনের রবির মতো। বাংলা গানের আলোকস্তম্ভ সেই ‘প্রথম লণ্ঠন’-টির সমান গুরুত্ব যাচনদারদের বিচারে প্রায়শই পান না বাংলা মেলডির অনিঃশেষ নিধান ‘ঝাড়লণ্ঠন’টি। এটা ঘটে যাচাইকারীদেরই ভুলে, নজরুলের দোষে নয়। আমার ধারণায় এঁদের কারো চেয়ে কারো গুরুত্ব কম নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথ বাংলাগানের প্রাণ হলে, নজরুল বাংলাগানের মন। অবয়বী মনুষ্যের হেড অ্যান্ড হার্টের মতো, নিরবয়ব মন এবং প্রাণও সমান গুরুত্ববহ দুটো আলাদা সত্তা। তা না-হলে, দুটোকে নিয়েই গুরুদেব তাঁর স্রষ্টার অসীমে ধেয়ে যেতেন না এবং গাইতেন না ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই—’।
বাংলাভাষার অঙ্গনে কিছু বুদ্ধিজীবী এতোই প্রভাবশালী যে, তাঁদের ছিঁটেফোটা মন্তব্যই অন্যদের চিন্তাভাবনার সীমা নির্ধারণ করে দেয়। নজরুল সম্পর্কে এ ধরনের সীমা নির্ধারণকারী স্থায়ীভাবে গ্রন্থিত আছেন এমন তিনজনকে নিয়ে এখানে একটু আলোচনা আমি জরুরি ভাবছি। এঁদের প্রথমজন যুগপৎ সাহিত্য ও সংগীতব্যক্তিত্ব ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দ্বিতীয়জন সাহিত্যব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসু এবং তৃতীয়জন সংগীতগুণী রাজ্যেশ্বর মিত্র।
ধূর্জটিপ্রসাদ ১৩৩৬ সালের শ্রাবণ সংখ্যা ‘সংগীতবিজ্ঞান প্রবেশিকা’ পত্রিকায় ‘আজকালকার গান’ শিরোনামে সমকালীন গান সম্পর্কে তাঁর স্বভাবসুলভ কিছু তুচ্ছতাচ্ছিল্য মন্তব্য করেন। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে, তখনকার নজরুলের সংগীতখ্যাতির প্রধান ভিত্তি কেবল বছর তিনেকের সৃষ্টি গজল হলেও—বাংলার গানে সেই অভিনব সংযোজন বাঙালিকে নতুন ঢঙের নতুন সুরের নতুন উন্মাদনে তদ্দণ্ডেই অভিভূত করে ফেলেছিল। শ্রীমুখোপাধ্যায় তাঁর রচনায় অনেক প্রগল্ভতা ও সস্তা কথামালার পরম্পরায় লেখেন:
‘গত মাসে প্রায় দশ-বারোটি প্রতিভাশালী যুবক-যুবতীর গানবাজনা শুনলাম। তাদের মধ্যে মাত্র দুইজন রবিবাবুর গান গাইলেন, বাকী সব কার গান গাইলেন বুঝতে পারলুম না। সন্দেহ হল অতুলপ্রসাদের কিন্তু তাঁর নয়—তিনি নিজে অস্বীকার করলেন। শুনলাম সেগুলি কাজী নজরুলের। সত্য মিথ্যা জানি না। তাতে ছন্দের কিছু বৈচিত্র্য আছে বটে, কিন্তু মানে নেই মনে হল। তাতে সুরের একটা গতি আছে কিন্তু সে গতি অত্যন্ত হালকা এবং নিতান্তই একঘেয়ে। তাতে গজল ঠুংরি, লাউনীর মাধুর্য আনবার প্রয়াস আছে, কিন্তু সে মাধুর্য একেবারে ঝুটা। ঢাকার মুসলমানের উর্দুর সঙ্গে লখনৌ নবাবের উর্দুর যা তফাত, ভাটপাড়ার ভটচায্যি মশাই-এর সংস্কৃত পাঠের সঙ্গে এই বাংলাদেশের অভিনব ঠুংরির তফাত তাই। পশ্চিমাঞ্চলের ঠুংরি গজল শোনবার বিশেষত বাঈজীর মুখে শোনবার সৌভাগ্য যার ঘটেছে সেই বুঝবে এই তফাত কোথায় এবং কতখানি।’ (আজকালকার গান, পৃ. ১৮৬, ধূ.র. ৩য় খ-)।
‘এ বৎসর কলকাতায় এসে দেখছি যে কাজী নজরুলের গান দেশ ছেয়ে ফেলেছে। তাঁর সুরও ঠুংরি গজল নয়। তাঁর দেওয়া অনেক সুর শুনতে ভাল লাগলেও সুর হিসাবে খুব উচ্চ শ্রেণীর নয়। সুর-সৃষ্টি হিসাবেও তার মূল্য খুব বেশি নয়। অনেক সময় তাঁর সুর বাজারের ঠুংরি গজলের অনুকরণ মাত্র। যেখানে তিনি অনুকরণ করেননি, সেখানে তাঁর সুর রচনা অত্যন্ত ভষধঃ সাদামাঠা হয়েছে। আমার বিশ্বাস এই হালকা সুরের জন্য তাঁর গলা এবং কবিতা প্রধানত দায়ী। তাঁর গলা মোড় খায় না, তাঁর গলায় তান নেই, মীড় নেই। এই অভাবের জন্য তাঁর রচনার ক্ষতি হয়েছে। গান রচনার বাহাদুরী অলংকার ফোটাবার অবকাশ দেওয়া—যেমন স্বরবর্ণের প্রাচুর্য। কাজীর কবিতা সব ঠাস্বোনা, (অতুলপ্রসাদের নয়) ব্যঞ্জনবর্ণ সেখানে প্রধান। কাজী মনে মনে জানেন যে তাঁর গলা নেই, সেইজন্য গলার দোষ ঢাকবার জন্য তাঁর কলম ব্যঞ্জনবর্ণই ব্যবহার করতে উৎসুক এবং তালপ্রধান ঠুংরি গজলের ছাঁচে গান লিখতে ব্যগ্র—দুর্বলতার ক্ষতিপূরণ করতে। অতুলপ্রসাদের গলায় চমৎকার ছোট ছোট তান আছে, তাঁর গান গাইতে হলে ছোট তানের দরকার। সেইজন্য সকলেই কাজীর গান গাইতে পারে এবং সকলে অতুলপ্রসাদের গান গাইতে পারে না।’
এসব বেহুদা বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ ছাপান বিখ্যাত সংগীতব্যক্তিত্ব নলিনীকান্ত সরকার একই পত্রিকায়। নজরুলের গজল সম্পর্কে ধূর্জটিবাবুর হুবহু বিপরীত মত পোষণ করেন সংগীতগুণী ও সুগায়ক দিলীপকুমার রায় এবং তা তিনি ব্যাখ্যা সহকারে লেখেনও। অধিকন্তু শ্রীরায় স্বহস্তে স্বরলিপি প্রস্তুত করে ‘নজরুলিয়া’ গজল প্রচারের চেষ্টাও করেছিলেন।
ধূর্জটিবাবুর এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধদেব বসুর একটি মন্তব্যও স্মর্তব্য—‘ঐতিহাসিক কারণে দু-জনের নাম (অতুল ও নজরুলের) একসঙ্গে করতে হলেও প্রবীণতর ব্যারিস্টার-গুণীর তুলনায় নজরুলের প্রাধান্য প্রথম থেকেই স্পষ্ট, এখন স্বতঃসিদ্ধ। একে-তো কবিত্বে কোন তুলনাই হয় না, তার উপর সংগীতেও নজরুলের ক্ষমতা বড়ো, প্রাচুর্য বেশি, বিচিত্র বহুমুখিতা—রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে—অনন্য। অতুলপ্রসাদের বৈশিষ্ট্য, শেষ পর্যন্ত, এইখানে যে চিরাচরিত ভারতীয় ভক্তিরসে নিজস্ব একটি নিবিড়তা তিনি এনেছিলেন; কিন্তু নজরুলের মৌল উপকরণই অংশত অপূর্ব বলে বাংলা গানের সামগ্রিক গতিরই তিনি মোড় ফেরালেন। এটা লক্ষণীয় যে রচনার প্রবলতা এবং পরিমাণ, আর সেই সঙ্গে বিরল ব্যক্তিগত মনোহারিতা সত্ত্বেও, সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে নজরুলের প্রভাব ক্ষণস্থায়ী বা নামমাত্র; কিন্তু সংগীতে তিনি প্রবর্তক, প্রজনক; …’ (’বাংলার গান’, চতুরঙ্গ: সংখ্যা ৪ মাঘ ১৩৫৫)।
তবে শ্রীবসুও নজরুলসংগীতকে যথোচিত গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করেননি। ফলে বঙ্গীয় সংস্কৃতির আজকের প্রজন্মেরও পরমপূজ্য এই গুরুর অনেক অর্ধমনস্ক মন্তব্য রদবদল ব্যতিরেকে তাঁর রচনাবলীতে স্থায়ীভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নজরুলের গানের চিরন্তন অবমূল্যায়ন করে চলেছে। ‘নজরুল ইসলাম’-নামের প্রবন্ধটি বুদ্ধদেব লিখেছিলেন ১৯৪৪ সালে, যেটি সংকলিত হয় তাঁর কালের পুতুল গ্রন্থে এবং ১৯৬৬ সালে অন্তর্ভুক্ত হয় তাঁর ভারবি-প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন-এ। ধূর্জটিপ্রসাদের মতো সংগীততাত্ত্বিক না হলেও অতীব সংগীতসচেতন ছিলেন বুদ্ধদেব এবং বাংলা গানের বিবর্তনের ঐতিহাসিক ধারাটি সম্পর্কেও ছিলেন যথেষ্ট অবহিত। সঙ্গীতে তাঁর অধিকার বেশ সমীহ আদায় করে, কবিতার মতো অতটা না-হলেও।
রচনাটিতে বুদ্ধদেবের যে-মন্তব্য দুটি নিতান্তই ভ্রান্ত, তার একটি হলো ‘বীর্যব্যঞ্জক গানে চলতি ভাষায় যাকে স্বদেশী গান বলে—রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের পরেই তাঁর (নজরুলের) স্থান হতে পারে।’ অর্থাৎ বর্ণিত ক্ষেত্রে ওই দুজনের পরের স্থানটিও নজরুলের হবে কি না তা নিয়েও সংশয় আছে বুদ্ধদেবের। প্রকৃত অবস্থাটি কিন্তু বিপরীত বলেই আজ সংগীতের আমজনতা থেকে খাসমহল পর্যন্ত সকলেই অবহিত যে—বীররসাত্মক গানের সৌকর্যে, প্রাচুর্যে, বৈচিত্র্যে ও প্রতাপে নজরুলের স্থান নিশ্চিতভাবেই রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলালসহ সকলেরই অগ্রে। শ্রীবসুর দ্বিতীয় ভ্রান্ত মন্তব্যটি হল—“বুলবুল ও ‘চোখের চাতকে’ কিছু কিছু রচনা পাওয়া যাবে, যাকে অনিন্দ্য বললে অত্যন্ত বেশি বলা হয় না। আরো বেশি গান যে অনিন্দ্য হয়নি, তার কারণ নজরুলের দুরতিক্রম্য রুচির দোষ।”
প্রকৃতপক্ষে, অনিন্দ্য হয়েছে কেবল ‘আরো বেশি গান’ নয়, আরো অনেক বেশি গান। বরং বলা যায় যে নজরুলের যত সংখ্যক গান অনিন্দ্য হয়েছে তত সংখ্যক গান দ্বিজেন্দ্র, অতুল অথবা রজনী লেখেনই নি। রুচির দোষহেতু বর্জন করার জন্য নজরুলের হাজারখানেক গান বেশি আছে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও। বস্তুত সুবিপুল সংখ্যক গানেই নজরুল তাঁর রুচির দোষ অতিক্রম করতে পেরেছেন। অবশ্য বুদ্ধদেবও নজরুলের রুচির দোষকে ‘অনতিক্রম্য’ বলেননি, বলেছেন ‘দুরতিক্রম্য’। একই রচনায় তিনি অন্যত্র লিখেছেন, ‘বিদ্রোহী কবি, ‘সাম্যবাদী’ কবি কিংবা সর্বহারার কবি হিশেবে মহাকাল তাঁকে মনে রাখবে কিনা জানি না, কিন্তু কালের কণ্ঠে গানের যে-মালা তিনি পরিয়েছেন, সে-মালা ছোটো কিন্তু অক্ষয়।’
বুদ্ধদেব বসু কথিত কালের কণ্ঠে পরানো নজরুলের অক্ষয় গানের মালাটি ছোটো নয়। বস্তুত মালাটি এতো বড় এবং বৈচিত্র্যময় যে বহুমাত্রিক সে-মালাটি গাঁথার সাত দশক পরে এই তৃতীয়-চতুর্থ প্রজন্মের গানের আসরেও নজরুল বসে রয়েছেন ফোকাসের কেন্দ্রে রবীন্দ্রনাথের পাশে, যখন কিনা বাংলা কাব্যগীতির অন্য প্রধানগণ পড়ে আছেন ফোকাসের বাইরে। এ-কারণেই বাংলা গানের ভুবনে আজ নিত্যশ্রুত শব্দবন্ধ শুধুমাত্র দুটি—রবীন্দ্রসংগীত আর নজরুলসংগীত। এই দুই সংগীতেরই বিখ্যাত গবেষক ড. করুণাময় গোস্বামী নজরুলের আলোচ্য গানের মালাটিকে বর্ণনা করেছেন এভাবে:
‘বিচিত্রভাবের, বৈচিত্র্যময় বাণীগৌরবের, বৈচিত্র্যবহুল সাংগীতিকতার বহুসংখ্যক গানের পুষ্পে গড়া কালের কণ্ঠে দোলানো সেই মালা। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অপর কোন বাঙালি সংগীতরচয়িতা কালের কণ্ঠকে এমন উজ্জ্বল মালিকা দ্বারা সুশোভিত করতে পারেননি।’ (পৃ. ৫২০, নজরুল গীতি প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা)।
নজরুলসংগীতের উল্লিখিত অবমূল্যায়নের কালপর্বেই রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কিত কিছু অতিকথনও শ্রবণ প্রয়োজন, যাকে নারায়ণ চৌধুরী তাঁর রাগসংগীত ও লোকসংগীত শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন ‘রবীন্দ্রসংগীতের মাত্রাতিরিক্ত প্রচার’:
‘শুধু অনন্যই নন, অন্যেরা যখন খণ্ডিত তিনি (রবীন্দ্রনাথ) তখন পূর্ণতায় ভরা।… কেন জানি মনে হয়, বাংলা গানের চলার পথে তিনি (রবীন্দ্রনাথ) যেন সেই জংশন ইস্টিশনটি যেখানে এসে রেল গাড়িটিকে বেশ কিছুক্ষণ থাকতেই হবে। … অনেকদিন, অনেক কাল তো পার হয়ে গেল, গাড়িটা এখনো কেন ইস্টিশান ছাড়ে না? তবে এই কি সেই সব পেয়েছির দেশ যেখান থেকে অন্য কোথাও যাওয়ার আর প্রয়োজন নেই? কি জানি, হয়তো তাই।’ [‘দেশীগান: রবীন্দ্রনাথ’, পৃষ্ঠা ৪২, রবীন্দ্র সংগীতের নানাদিক, বীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সম্পাদিত]।
এমনি পরিবেশে এবং সম্ভবত ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত স্বনামধন্য সংগীততাত্ত্বিক এবং দেশ পত্রিকার শার্ঙ্গদেব-ছদ্মনামী সংগীতসমালোচক রাজ্যেশ্বর মিত্রের দুটি গ্রন্থের পরিপ্রেক্ষিতে, সাহিত্য ও সংগীত উভয় ক্ষেত্রের অভিজ্ঞ ভাষক এবং লেখক, নারায়ণ চৌধুরী তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ সংগীত পরিক্রমায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন:
‘অধুনা রবীন্দ্রসংগীতের সর্বব্যাপী জনপ্রিয়তার আবহাওয়ার ভিতর নজরুল সংগীতকে খাটো করবার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। একে ঠিক সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্র বলতে চাই নে, তবে চারিদিকে যে নজরুল-সংগীতের বিরুদ্ধে একটা ফিসফাস-গুজগাজের অভিযান চলছে সে লক্ষণ অতি স্পষ্ট। এই অভিযান অচিরেই স্তব্ধ হওয়া দরকার।’ [পৃ. ১৯৫, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৬৪]।
সংগীতে চালকের আসনে আসীন সুর, কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছেন যে গানে কথা আর সুরের মধ্যে কে বড় আর কে ছোট সে-বিচার সঙ্গত হয় না। তবু তা করতেই যদি হয়, তবে বলতে হবে সেক্ষেত্রে ‘সংগীত’ই স্বামী। তবু তাঁর অতি-ভক্তের দল মনে করেন ‘কথা’ই স্বামী এবং শেখান যে, রবীন্দ্রসংগীতের তুলনায় নজরুলসংগীতে কথা নিকৃষ্ট সুতরাং ওটি উৎকৃষ্ট সংগীত নয়। ফলে সংগীতশিক্ষার্থী এবং শ্রোতৃবৃন্দের মর্মমূলে এই ভুল ধারণাটি প্রোথিত হয়ে যায় যে, সংগীতে শ্রাব্যাংশের চেয়ে পাঠ্যাংশের মূল্যই বেশি। অন্যকথায়, ধ্বনিতে কথার অনুবাদের নামই সংগীত (!)।
এহেন ‘সংগীতবোদ্ধা’দের বিদ্রূপ করেই নারায়ণ চৌধুরী বলেছেন ‘আমরা তো গান শুনি না, আমরা গানের কথা শুনি। গানের কথার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে ভাবি গানের সুরের প্রেমে মুগ্ধ হয়েছি। কাজেই এই সমাজের কাছ থেকে সুরকার হিসাবে নজরুল-যে তাঁর প্রাপ্য পাবেন না সে-কথা তো সহজেই বোঝা যায়। কান আগে তৈরী হলে তবে গানের রসোপভোগ। কিন্তু হায়, শ্রুতিগত প্রস্তুতি আমাদের অনেকেরই নেই’ (কাজী নজরুলের গান, পৃষ্ঠা ২১-২২)।
শ্রীমিত্রের গ্রন্থ দুটির নাম ছিল বাংলার গীতকার এবং বাংলার গীতকার ও বাংলা গানের নানাদিক। একটা কথা তিনি দুটি পুস্তকেই লিপিবদ্ধ করেছেন, সম্ভবত অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ভেবেই—প্রথম বইটির ৯০ পৃষ্ঠায় এবং দ্বিতীয় বইটির ১২৮-১২৯ পৃষ্ঠায়। কথাটি এখানে উদ্ধৃত হল:
‘পরিশেষে সত্যভাষণের খাতিরে একটি কথা বলতে হবে। নজরুল সাহিত্য ও সংগীতের অনুরাগী কোন লেখক সুরকার হিসাবে নজরুলকে দ্বিজেন্দ্রলাল এবং অতুলপ্রসাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছেন। এমনকি তাঁর মতে স্বদেশী গান রচনায় নজরুলের কৃতিত্ব কোন কোন স্থলে রবীন্দ্রনাথেরও ওপরে। নজরুলের অত্যন্ত অনুরাগী হয়েও এই ধরনের মন্তব্যকে গ্রহণ করতে আমার প্রবল আপত্তি আছে। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল এবং অতুলপ্রসাদ আমাদের বর্তমান কাব্যসংগীতকে গড়ে তুলেছেন বললে অত্যুক্তি হয় না। সুরের বৈশিষ্ট্য, স্বকীয়তা, গভীরত্ব কোন দিক দিয়েই নজরুলের প্রতিভা এঁদের সঙ্গে সমকক্ষতা দাবী করতে পারে না। বস্তুত, এঁদের গড়া সংগীতেই নজরুল বৈচিত্র্য আনবার প্রয়াস পেয়েছিলেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ সার্থকতা লাভ করেছিলেন। এই দিক থেকেই তাঁকে আমরা একজন বিচিত্র স্রষ্টা বলে অভিনন্দিত করি এবং তাঁর রচনার ভূয়সী প্রশংসা করি। কিন্তু স্তুতির আতিশয্যে একজনকে প্রাপ্য গৌরব থেকে বঞ্চিত করে অপরকে সমধিক গৌরবান্বিত করার প্রচেষ্টা সমর্থনযোগ্য নয়। সমালোচনার প্রকৃত মূল্যই অকুণ্ঠ সত্যভাষণে নতুবা তাকে সমালোচনা বলব না, তা স্তুতিবাদেরই নামান্তর।’ [‘নজরুল ইসলাম’-শীর্ষক নিবন্ধ]।
‘ওরিয়েন্ট লংম্যান’ কর্তৃক ১৯৭০ সালে প্রকাশিত, রাজ্যেশ্বর মিত্রের উত্তরভারতীয় সংগীত-শীর্ষক গ্রন্থে আলোচ্য বিষয়ে তাঁর বক্তব্য আরও রহস্যময়। বইটির শেষ অধ্যায়ের উপজীব্য কাব্যসংগীত ও দেশাত্মবোধক গান। রবীন্দ্রনাথের কথা উল্লেখ করে লেখক বলেন:
‘এ বিষয়ে আর-একজন মহান সুরস্রষ্টা ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তাঁর ভাবগম্ভীর উদ্দীপনাপূর্ণ গানগুলি আজও দৃষ্টান্তস্থল হয়ে বিরাজ করছে। আরও পরবর্তী কালে রজনীকান্ত সেন এবং অতুলপ্রসাদ সেন বহুতর দেশাত্মবোধক এবং কাব্যসংগীত রচনা ক’রে বাংলার সংগীতের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেন।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১০২)।
আলোচ্য অধ্যায়ের শেষ সেকশনটি শেষ হয়েছে বঙ্গের উদ্দীপনীসংগীত-স্রষ্টাদের সম্বন্ধে এই বলে:
‘রবীন্দ্রনাথ লোকসংগীতের রীতি অবলম্বন ক’রে বহু স্বদেশ-সংগীত রচনা করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল প্রত্যক্ষভাবে পাশ্চাত্ত্য রীতি প্রয়োগ ক’রে একটি নতুন ধরনের উদ্দীপনার সৃষ্টি করেন। রজনীকান্ত সেন তাঁর স্বকীয়তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের আদর্শও অনুসরণ করেছিলেন। এইভাবে (কালীপ্রসন্ন ঘোষ, মনোমোহন বসু, গোবিন্দচন্দ্র রায় প্রমুখসহ) বহু কবি ও গীতিকারের রচনায় বাংলাদেশে স্বদেশ-সংগীত ব’লে একটি নূতন পর্যায় রচিত হয়েছে বলা যায়।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭)।
১৯৭০ সালে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে অখ- বঙ্গের আন্দোলনজনিত স্বদেশ-সংগীতের কথা এলে তার টানে ভারতবর্ষের স্বদেশী আন্দোলনজনিত স্বদেশ-সংগীতের উল্লেখ না-এসে পারে না, উপরিগত বা ভাসা-ভাসাভাবে হলেও। সে-উদ্দীপনী সংগীতের স্রষ্টা কাজী নজরুল, যাঁর সৃষ্টিতে উনিশ শতকের বিশের দশকের স্বদেশী যুগমানস এককভাবে প্রতিফলিত হয়ে বাংলার জনচিত্তকে অভূতপূর্বরূপে উদ্দীপিত করেছে। এ দাবি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের এবং ‘শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু’কে কবিগুরু তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছেন বঙ্গভূমে উদ্দীপনার ‘বসন্ত’ আনার জন্য, ‘নতুন ঢেউ’ আনার জন্য।
নজরুলের নামোল্লেখ করে অবমূল্যায়ন-পর্বের পরের পর্যায়ে চলে ভাসুর-জ্ঞানে তাঁকে গুমনাম করে ফেলার লীলাখেলাÑ তার মানে পরোক্ষে অনুল্লেখ্য রায় দেয়া। এ-পদেরও একটা নমুনা নেয়া যাক। জ্যোতির্ময় ঘোষ সম্পাদিত ও ১৯৭৫ সালে কলকাতার ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ’-কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’-শীর্ষক পুস্তকে সঙ্কলিত ভাস্কর মিত্র রচিত ‘বঙ্গ সংস্কৃতি ও বাঙালির সংগীত চিন্তা’-নামক প্রবন্ধটির সিদ্ধান্ত: ‘বাঙালির সংগীত সাধনাও তেমনই গানে রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদ, নৃত্যে উদয়শঙ্কর, বাদ্যে সুরেন্দ্রলাল-তিমিরবরণ-এর মাধ্যমে পরিণাম সন্ধানী…’ (পৃষ্ঠা ৬৪)। মানে বাঙালির গানে কাজী নজরুল কেউ না।
‘নজরুল-সংগীতের বিরুদ্ধে ফিসফাস-গুজগাজের অভিযান’ ‘স্তব্ধ হওয়া’র বদলে ১৯৭০ ও ১৯৭৫ সালে অভিযানটির এভাবে বেড়ে যাওয়া দেখে নারায়ণ চৌধুরী ক্ষুব্ধতর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত তাঁর কাজী নজরুলের গান-নামক গ্রন্থে লিখেছেন:
‘কোনো কোনো মহলে নজরুলের সাংগীতিক প্রতিভার অবমূল্যায়ন করার একটা প্রবণতা দেখা যায়। এই প্রবণতার সঙ্গে কায়েমী স্বার্থের সম্পর্ক আছে। তাছাড়া উত্তর ভারতীয় সংগীতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সম্পর্কে অচেতনতা কিংবা রাগ-রাগিণী সম্পর্কে অজ্ঞতাও এর একটা কারণ হতে পারে। প্রবণতাটি অশ্রদ্ধেয়, সে কথা বলাই বাহুল্য’। [পৃষ্ঠা ৮৯-৯০]।
‘পঞ্চপ্রদীপ’-অভিহিত দলে থাকলে একের সঙ্গে অন্যের অর্থহীন তুলনা চলতে থাকে—আম ভাল না জাম ভাল, তালগাছ মহৎ না বটগাছ মহৎ। এর ফলে কোনো কোনো রথী-মহারথীও ভুল রায় দিয়ে থাকেন। যেমন সংগীত-বিশেষজ্ঞ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রাজ্যেশ্বর মিত্র প্রমুখ নজরুলকে দ্বিজেন্দ্র-রজনী-অতুলের সমমর্যাদা দেননি এবং এই না-দেয়াটা তাঁদের গ্রন্থাবলিতে সংরক্ষিতও করে গেছেন। বাস্তবেও নজরুল পাঁচের ভেতরে এক ছিলেন না, ছিলেন একের ভেতরে পাঁচ। সেদিক থেকে কাজী নজরুল ইসলাম পঞ্চপ্রদীপের অন্যতম প্রদীপ কখনোই ছিলেন না, বরং লণ্ঠনও ছিলেন না—তিনি ছিলেন ঝাড়লণ্ঠন, শ্যান্ডেলিয়ার। গুরুদেবকে তো পাঁচজনের একজন ভাবাটাই পাপ। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন বাংলা গানের ‘প্রথম লণ্ঠন’টি হয়ে—সঠিক পথ দেখানোর লাইটহাউস, বাতিঘর, আলোকস্তম্ভ।
১২.
দেখা গেল যে, নজরুলের গান নিয়ে রসপ-িতদের অন্তিম সমস্যা ছিল দুটি—তাঁর রুচি নিকৃষ্ট আর কাব্য দুর্বল। বস্তুত এর একটাও এমন নয়, যার কারণে নজরুলসংগীতকে কৃপা করতে হবে।
প্রথমে ‘রুচি’ সংক্রান্ত আপত্তিটিকে বাজিয়ে দেখা যাক। আমার কথা হল, রুচির প্রশ্নে আপস না করে জনসাধারণের কাছে পৌঁছানো যায় না। সেখানে রবীন্দ্রনাথের পৌঁছাতে না-পারার অন্যতম কারণও এ-আপসটি না-করা। বিশেষজ্ঞগণ চারুশিল্পীদের শিকড় সন্ধানের এবং উৎসে ফেরার ওয়াজ শোনাবেন, বাস্তবঘনিষ্ঠতার এবং মৃত্তিকালগ্নতার সবক শেখাবেন, জনগণের কাতারে সামিল হবার তালিম দেবেন এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার নসিহত ফরমাবেন—কিন্তু জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে ‘রুচি’র প্রশ্নে অপরিহার্য ‘সন্ধি’টুকু করলেই ছি ছি করবেন, এমন দ্বৈতমান তো মেনে নেয়া যায় না। আবশ্যিক এই সন্ধিটুকু করতে পারি না বলে আমি নিজেও আমার লেখা নিয়ে জনগণের দুয়ারে পৌঁছাতে পারি না। ব্যক্তিরুচির গণ্ডি থেকে বেরুতে পারি না বিধায় অদ্যাবধি গল্প-প্রবন্ধ লিখে যাচ্ছি বুর্জোয়া ‘রুচি’র কড়াপাকের ঘিয়ে চুবিয়ে। জনগণকে সম্পৃক্ত করার গরজে কথিত ‘সন্ধি’টুকু করে থাকে ব’লে, গণসংগীত কণ্ঠে তুলে নিতেও আকৃষ্ট বোধ করি না আমি—যদিও কলম চালিয়ে বিষয়টির ওপর বই লিখে ফেলতে পারি।
এবার বাজিয়ে দেখা যাক নজরুলসংগীতের ‘কাব্য’ সংক্রান্ত আপত্তিটি। এ ব্যাপারে এখানে আমি কেবল দুজন বিশেষজ্ঞের উদ্ধৃতি দিয়েই বিদায় নেব। প্রথমে স্বয়ং সংগীততাত্ত্বিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন:
‘বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় সাহিত্যের ও সংগীতের আবেদন ভিন্ন আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া চাই।… কবিতা বুঝতেই যদি বেগ পেতে হয় তবে সেটা উৎকৃষ্ট গীতিকবিতা হতে পারে না।… সেই জন্যই বোধ হয় শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতায় দুর্বোধ্য কথার বদলে পুরাতন ও পরিচিত কথারই প্রয়োগ দেখা যায়। এখানে শ্র্রোতার দাবি খুব বেশি। গীতিকবিতায় অর্থ বোঝবার তাড়া নেই, কাজ করবার হুকুমও নেই। আছে খেয়াল, খামখেয়াল, যেটি গম্ভীর হলেও চলবে—কিন্তু সুগভীর চিন্তাধারা হলে চলবে না, হাল্কা হলেও চলবে কিন্তু তার উত্তেজনায় নেচে উঠলে চলবে না।’ [পৃ. ১২৯, কথা ও সুর, ধূ.র.খ-৩]।
আমাদের কথাও তাই। সনাতন কথাও সংগীতের হয়ে ওঠায় বাধ সাধে না। এমনকি প্রায় শূন্যগর্ভ কাব্য সার করেও পার পেয়ে যেতে পারে সংগীত। কারণ সংগীতের কাজ আকাশে উড়ে চলা অর্থাৎ ‘ফ্লাইং’। আর কথার কাজ আকাশে তোলার জন্য সংগীতকে নিয়ে মাটিতে দৌড়ে চলা অর্থাৎ ‘ট্যাক্সিয়িং’—যেটুকু কাজ মোটা কথাই সামাল দিতে পারে। বরং সেটুকু কাজের জন্য একটু স্থূল কাব্যই হতে পারে অধিক উপযোগী।
তাই নজরুলসংগীতের কথা সম্পর্কে সংগীতজ্ঞ সুকুমার রায় বলেন:
‘নজরুলের আবেগপ্রবণ ভাষা অনেক স্থলে সুর-চিন্তার সঙ্কেত হয়ে দাঁড়ায়। গানের ভঙ্গিকে গতি দান করবার উপযুক্ত ভাষা রচিত হয়।… পাঠের সময় অনেক গান এজন্যে কোথাও দুর্বল মনে হতে পারে, কিন্তু গতিপ্রবণতা নজরুলের রচনার প্রধান গুণ। গীতি সমালোচনা করতে সমালোচককে রচনার গীতিমূলকতা বা লিরিক বৈশিষ্ট্যের কথা আলোচনা করতে দেখা যায়, কেউ ‘সুরধর্মিতা’র কথা উল্লেখ করেন। কবিতার বিচারে এসব বিশেষ অর্থবোধক হতে পারে, কিন্তু গানের ক্ষেত্রে এ অতিকথন এবং গানে কথার সামান্য বিস্তারও পরিত্যাজ্য মনে হওয়া স্বাভাবিক। অর্থাৎ কবিতাকে গীতিপ্রবণ, ধ্বনি-প্রধান অথবা সুর-প্রধান বললে অর্থবোধক হয়, কিন্তু গীতির গুণ বিশ্লেষণে এসব উক্তির প্রয়োজন নেই। গীতি রচনা অন্যান্য গুণে অসাধারণ হয়। নজরুলের রচনা সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য এই যে গীতিরচনায় ও শব্দযোজনায় যে মৌলিক গতিশক্তি আছে, সুরভঙ্গি তাতে সহজ ও সাবলীল হয়ে উঠেছে। এই সম্পূর্ণ ক্রিয়াকে ‘গতি’ বলা যায়’। [পৃ ৬৭, বাংলা সংগীতের রূপ, সুকুমার রায়]।
বাংলা গানে নজরুলের অন্যতম স্থায়ী অবদান এই গতি-ক্রিয়া। নজরুলের দুর্বার গতিক্রিয়ায় সুর যে-অবাধ স্ফূর্তি লাভ করে তাতে মুগ্ধ হয়েই শতাব্দীর অন্যতমা সেরা গায়িকা আশা ভোঁসলে ১৯৯১ সালে কলকাতার সানন্দা পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন—কৃতী রূপকারের জন্য নজরুলসংগীতের তুলনা নেই। তাই তিনি একটি সিডি রেকর্ড করতে কলকাতায় এসে দুটি সিডি করে গিয়েছেন, বম্বের শিডিউল পিছিয়ে দিয়ে।
কণ্ঠসম্রাজ্ঞী আশা ভোঁসলে নজরুলের গান গেয়ে অতটাই খুশি হয়েছিলেন, যতটা অখুশি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে। ১৯৮০ সালে এইচ.এম.ভি. শ্রীসন্তোষ সেনগুপ্তের পরিচালনায় আশার কণ্ঠে বারোটি রবীন্দ্রসংগীতের একটি এল.পি. নির্মাণ করে। রবীন্দ্রনাথের গানগুলি গাইতে গিয়ে শিল্পী যে-প্রাণান্ত কষ্ট পেয়েছিলেন তা তিনি বিন্দুমাত্র ভুলতে পারেননি। এগারো বছর পর নজরুলসংগীত গাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা আশা রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার বেদনার কথা অনেক অতিরেক সহকারে বলে গিয়েছিলেন সানন্দা-পত্রিকার সবিস্তার এক সাক্ষাৎকারে। তাঁকে নাকি বলা হয়েছিল রবীন্দ্রসংগীত গাইতে হবে দাঁতে দাঁত চেপে। তিনি বলেছিলেন, দাঁতে কপাট লাগিয়ে গান গাওয়া তাঁরা শেখেন না, তাই তিনি গাইবেনও না। দাঁতকপাটি থেকে মুক্তি পেলেও ‘সুরকপাটি’ থেকে মুক্তি এক রত্তিও পাননি বেচারি। ‘এসো শ্যামল সুন্দর’ গানটির সুরের অন্তর্গত প্রবল ঝোঁকটি অনুভব করে গায়কীতে কিঞ্চিৎ শিল্পীসুলভ স্বাধিকার চেয়ে তিনি পাননি। আশা যদি জানতেন যে সে গানটির সুর আগাগোড়াই ধার করা তবে কি তিনি রেকর্ড-কোম্পানির ট্রেনারের কাছে সুরের অধিকারের দাবিতে, আরেকটু বেশি সওয়াল করতেন? (শান্তিনিকেতন-সংগীতভবনের যন্ত্রসংগীতের অধ্যাপক সুশীলকুমার ভঞ্জ চৌধুরীর তৈরি করা সেতারের একটি গতের সুরে রবীন্দ্রনাথ শুধু কথা বসিয়ে দিয়েছেন ‘এসো শ্যামল সুন্দর…মঞ্জীর রুণু রুণু’-গানটির (পৃ. ৭২১-৭২২, গীতবিতানের জগত, সুভাষ চৌধুরী, প্যাপিরাস, কলকাতা)।
সাক্ষাৎকারটিতে আশা ভোঁসলের সারকথাটি ছিল—যারা গাইতে জানে, তাদের জন্য নজরুলসংগীত; আর যারা গাইতে জানে না, তাদের জন্য রবীন্দ্রসংগীত। কথাটিকে কেবল গায়িকার ব্যক্তিগত ক্ষোভের অভিব্যক্তি হিসেবেই নিতে হবে। বড়জোর তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে নজরুল সঙ্গীতে গায়কগায়িকার শৈল্পিক অভিব্যক্তি অন্তরীণ নয়। (নজরুলের গানে রূপকারের শৈল্পিক অভিব্যক্তি-যে অন্তরীণ নয়, সেকথাটি কবি ১৯৩১ সালে কলকাতার ডি. এম. লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত তাঁর নিজের-করা নজরুল-স্বরলিপি গ্রন্থে কার্ফা তালের মান্দ্ ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি’র স্বরলিপির পাদটীকায় লিখে গিয়েছেন—‘উল্লিখিত অন্তরাগুলিকে প্রথম অন্তরার সুরেই গাহিতে হইবে; তবে প্রথম অন্তরার “জ্বালা” কথাটির উপর গজলের সুরেই কাজের যে “চং”-এর নিদর্শন দেওয়া হইল, অপরাপর অন্তরায় বাক্যবিশেষের উপর আর্টিস্ট পৃথক পৃথকভাবে সুরের কাজের সৃষ্টি করিয়া গানের একঘেয়েমি ভাব দূর করিবেন, এই আশায় অন্য অন্তরাগুলির কেবল ছন্দ ভাগ করিয়া দেওয়া হইবে)।’
শ্রীমতী ভোঁসলের বক্তব্যের অপর অংশটি ছিল, যে গাইতে জানে তার শিল্পীসত্তার স্বতঃস্ফূর্ততায় রবীন্দ্রসংগীতের শত বন্ধন অবশ্যই অন্তরায়। (যে-অন্তরায়হেতু ১৯৫২ সালে মহাজাতিসদনের এক অনুষ্ঠানে সংগীতগুণী দিলীপকুমার রায় বারবার অনুরুদ্ধ হয়েও রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে অস্বীকৃতি জানান—গুরুদেবের গানে রূপকারের স্বাধীনতা নেই বলে। এতে আশাভঙ্গ হয়েছিল শ্রীরায়ের গায়কীর তদানীন্তন ভক্ত তরুণ কবি শঙ্খ ঘোষের, যিনি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতে সেই ভারতবিখ্যাত গায়কের ‘সুরের গতিভঙ্গি’ প্রয়োগ ও ‘সুরের আর্কিটেকচার’ অঙ্কন উপভোগ করতে। পৃ. ১০৪, দিলীপকুমার রায়/স্মৃতি-বিস্মৃতির শতবর্ষ, ১৯৯৭, কলকাতা)। আশা ভোঁসলে তাঁর সাক্ষাৎকার শেষ করেন এই বলে—‘আর যে গাইতে জানে না তার কোনো অসুবিধাই হয় না (রবীন্দ্রসংগীত গাইতে), বাঁধা গতে গেয়ে গেলেই চলে’ (রবীন্দ্রনাথের ভাষায় অজন্তার চিত্রের ওপর দাগা বুলানোর মতো প্রাপ্ত ‘সুরের ওপর দাগা বুলিয়ে’—অর্থাৎ হিন্দুস্তানী সংগীতের ওস্তাদ অঘোর চক্রবর্তী ও রাধিকা গোস্বামীর মতো ‘কেবলমাত্র গাইয়ে অর্থাৎ সুর-আবৃত্তিকার’ হয়ে)।
আসলে পণ্ডিতগণের হেলাফেলা থেকে বাঁচাতে হলে জনগণের নজরুলকে পাণ্ডিত্যের মেলা থেকে বের করে ফেলা প্রয়োজন। অপরিহার্য সে-কাজটা অবশ্য মহাকালই করে ফেলেছে সময়ের যথাপরিসরে। নজরুলকে বসিয়ে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের পাশে, বাংলাগানের খাসমহলে—দেওয়ান-ই-খাসে। এঁরা যেন সংগীতসাম্রাজ্যের রাজা-উজির। বাকিদের বসিয়েছে আমমহলে—দেওয়ান-ই-আমে। তাঁরা যেন রাজদরবারের আমির-ওমরাহ। দেখা যাচ্ছে যে, বাংলা গানের ভুবনে ‘পঞ্চপ্রদীপে’র বহুল আলোচিত আসরটি বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায়নি। তাই আজ কেবল প্রথম এবং শেষ প্রদীপকেই প্রজ্বলন্ত দেখা যায় গানের আসরে, জয়ন্তীর উৎসবে। বাংলাদেশে বাকি তিন ‘প্রদীপ’-এর গানকে বলা হয় ‘তিন কবি’র গান, যদিও তাঁরাও মহান।
শেষকথাটি হল: নজরুলের গান বহুশাখী, যার প্রতিটি শাখাকেই মহত্তম ভাবা যেতে পারে—গণজাগরণী, গজলধর্মী, হিন্দুয়ানী ভক্তিমূলক, মুসলমানী ভক্তিমূলক, ধ্রুপদী আধুনিক, রাগসুররঞ্জিত লোকসংগীত, এবং রাগপ্রধানসংগীত। ভাবের, শব্দের, সুরের, ছন্দের, মেজাজের, পরিবেশের বহুমাত্রিকতায় বাংলার সংগীতভুবনে কাজী নজরুল ইসলাম এক স্বয়ম্ভর সংগীতসভার নাম।
(সৌজন্যে: আবদুশ শাকুর, আর্টসবিডিনিউজ২৪)
শব্দের আয়নায় রুদ্রের রক্তাক্ত মুখ
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
ভাষার কিষান চোখ মেলে চেয়ে দেখি,
চারিপাশে ঘোর অসম জীবন,- শব্দ-শ্রমিক/ র. ম. শহিদুল্লাহ
একাত্তর পরবর্তীকালে বাংলাদেশের কবিতায় গুরুত্বপূর্ণদের একজন অথচ কম বিজ্ঞাপিত কবি মহাত্মা রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। বাংলা সাহিত্যে ভুলবুঝা কবিও বলা যাবে তাকে। শুধু একাত্তরই বা বলি কেন। বাংলা কবিতার বিদ্রোহীধারায় নজরুল, সুকান্ত, দিনেশ দাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পর তার মত কণ্ঠস্বর আর খুঁজে পাওয়া যায় নাই।
‘আমি সেই পোড়া ভিত ভেঙে জেগে উঠেছি জীবনে,
আমি সেই কালো ঘোড়ার লাগাম ধ’রে আছি টেনে।
বুকের ভাষাকে সাজিয়ে রনের সজ্জায়,
আমি বুনে দিই শব্দ-প্রেরনা মানুষের লোহু মজ্জায় ॥ -শব্দ-শ্রমিক
যদিও খুব সহজেই নজরুলের কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয় আমাদের উপরোক্ত উচ্চারণ। তবুও শহিদুল্লাহর সমস্ত কবিতার আদিসত্য লুকিয়ে আছে এই লাইনে ‘ভাষার কিষান চোখ মেলে চেয়ে দেখি/ চারিপাশে ঘোর অসম জীবন।
তিনি ঘোষণা করেন ‘আমি কবি নই–শব্দ-শ্রমিক।’ সত্যিকার অর্থে রুদ্রের কবিতাকর্মকে নি:সন্দেহে শব্দশ্রম বলা যাবে। মহাত্মা জা পল সার্ত্র আত্মজীবনীর নাম রেখেছিলেন ‘শব্দ’। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। মানুষের জীবন আসলে ভাষা ছাড়া কিছু নয়। সেই ভাষা দাঁড়িয়ে থাকে শব্দের ওপর সুতরাং আত্মজীবনীর নাম এরচেয়ে সত্য আর কি হতে পারে!’ কথাটা হেয়ালির মত শোনালেও সত্য। মানুষ তার সমস্ত অভিজ্ঞতা অর্জন ও প্রকাশ করে ভাষার মাধ্যমে। এমনকি মুক মানুষেরাও যেই ইশারায় পরস্পরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে তাকেও ভাষা বলা যায়। কিন্তু এই ভাষাই আবার দেখার ভিন্নতার কারণে তার চরিত্র বদলায়। যেমন অর্থনৈতিক কারণে সমাজে মানুষের শ্রেণিবিভাজন ঘটে তেমনি শ্রেণিবিভাজনের কারণে ভাষাও তার শ্রেণিচরিত্র নেয়। আলাদা পোষাক পরে।
কিন্তু রুদ্র ‘ভাষার কিষান চোখ’ বলে আমাদের কাছে প্রথমেই নিজের পরিচয় লিপিবদ্ধ করছেন। কেবল মাত্র এই ভাষার কিষান চোখের চারিত্রিক কারণে তিনি ‘চারিপাশে ঘোর অসম জীবন’ দেখতে পেয়েছেন। তিনি আরো বৃহৎ পরিসরে নিজেকে স্থাপন করে যাচাই করছেন নিজেকে
সমতার নামে ক্ষমতাকে কোরে রপ্ত
আমি জানি কারা জীবনে ছড়ায় পুঁজ, পোকা, বিষ তপ্ত
জানি আমাদের কারা ধুতুরার ফুলে অন্ধ করেছে অবেলায়
ছুঁড়ে দিয়ে গেছে নষ্ট নগ্ন বেদনায়
সুতরাং ভাষার লাগাম তিনি ধরতে পেরেছিলেন। শব্দকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন চেতনার হাতুড়ি পেটানোর মতই। রচনা করতে পেরেছিলেন ‘ইশতেহারে’র মত কবিতা।
কার্ল মার্কস দুনিয়ার মজদুরের জন্য এত আহাজারি, এত গণিত, এত পরিসংখ্যান ও যুদ্ধের ডাক দিলেও দুনিয়ার সমস্ত মজদুর মার্কসবাদি নয়। হয়তো তারা মার্কসবাদ বুঝেনও না। তবুও মার্কস তাদের মুক্তির ও রাজত্বের বাসনাই করে গেছেন সমগ্র জীবন তার লেখনী ও চিন্তার মাধ্যমে। নিজের অজান্তেই তারা মার্কসবাদি। অথচ মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট করে মার্কসবাদ অধ্যায়ন করতে হয়। কারণ হিসাবে রুদ্র বলবেন ‘পরান সে ভুলে পূর্ন।’
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার সাথে যাদের পরিচয় ঘটেছে তারা অবগত আছেন মার্কসবাদের সাথে রুদ্রের কবিতার ভাব কত গভীর। নির্যাতিত গণমানুষের দীর্ঘশ্বাস কীভাবে রক্তাক্ত করে দিয়ে যায় রুদ্রের মুখ। ’ইশতেহার’ কবিতায় তিনি ধরতে চেয়েছেন কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর পুরাটাই। মানবজাতির এক ধারাবাহিক অর্থনৈতিক বিকাশকে যেমনি তিনি এই কবিতায় ধরেছেন তেমনি পুঁজিবাদের সঙ্কট ও এ থেকে বেরিয়ে নতুন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দিয়ে তিনি শেষ করেন তার অমর কবিতা ইশতেহার। এই ধরনের কবিতা বাংলাদেশি সাহিত্যে এই প্রথম দেখলাম আমরা। ১১৯ লাইনের এই দীর্ঘ কবিতাটি সত্যিকার অর্থেই বাংলা কবিতার জগতে মাইলফলক।
রুদ্রের কবিতা বাংলাদেশের আজন্ম রক্তাক্ত ইতিহাসের স্মারক বললেও অত্যুক্তি হয় না। একাত্তরের যুদ্ধের সময় তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র। তার বাবাকে ধরে নিয়ে গেছিল পাকিস্তানি হানাদারেরা। ১৯৭৭ সালেই তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেন
এই রক্তমাখা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো
জীর্ন জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
…. .. .. .. .. .. .. .. ..
এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী
স্বাধীনতা একি তবে নষ্ট জন্ম?
কবিতাকে অনেক দিন ধরেই আলাদা কিসিমের মাল হিসাবে চালানো হয়েছে। তার উপর আরোপন করা হয়েছে কুমারিত্ব, পবিত্রতা। বলা হয়েছে কবিতার ভাষা এক সান্ধ্যভাষা। এখনোব্দি বাংলাদেশি কবিরা সেসব সান্ধ্যভাষায় আলোআধারির কবিতা লেখার চেষ্টা করে চলেছেন। কবিতাকে বহু আগেই বিশেষ করে তিরিশি আধুনিকতাকে বহু আগেই নিরাশ করেছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তার বিষয় গণমুখি, ভাষা গতিশীল, সহজবোধ্য, শব্দ বিচিত্রগামী। সেই হিসাবে রুদ্র নিজেই পরিহার করেন তথাকথিত আধুনিকতার নাগপাশ। তিনি বলেন,
এখন কবিতা খাপখোলা তলোয়ার
এখন কবিতা মেদহীন ঋজু দেহ।
কবিতা এখন স্বপ্নের প্ররোচনা
কবিতা এখন বিশ্বাসী হাতিয়ার ॥
সাহিত্যের ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যায়, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের মত কবিতাও একটা প্রকাশ ভঙ্গি। জীবন থেকে আলাদা হয়ে, ছিন্ন হয়ে কোনো প্রকাশভঙ্গিই বাঁচতে পারে না। কিন্তু যুগে যুগে দেখা গেছে কবিদের ভেতর লূম্পেন প্রলেতারিয়েতের ভিড়। তারা স্লোগান দিয়েছে সাহিত্যের কোনো দায় নাই। শিল্পের জন্য শিল্প জাতীয় স্লোগান। যা মূলত পরদেশি এজন্ডা ও আত্মপ্রতারণায় ভরা। রুদ্র তাদের লক্ষ্য করে লেখেন ‘নপুংশক কবিদের প্রতি’।
সহস্র মৃত্যুর মধ্যে গেয়ে ওঠো রমন সঙ্গীত,
জ্বলন্ত ক্ষুধার রাজ্যে স্বপ্নে দ্যাখো পুস্পের পেখম।
রাজপথে গুলিবিদ্ধ লাশ রেখে হোটেলের ঘরে
জ’মে ওঠে তোমাদের লাস্যময় কবিতা উৎসব।
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
জীবন দেখতে যাও টার্মিনালে, খানকি পাড়ায়,
বেশ্যার নাভির নিচে খুঁজে ফেরো শিল্পের আরক–
অথচ সে-জীবনের জন্যে কোনো পক্ষপাত নেই,
সেই কষ্টের বিপক্ষে কোনো বাক্য নেই তোমাদের। -নপুংশক কবিদের প্রতি।
তিরিশের দশক থেকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত আধুনিক কবিতা বলয়ের চরম প্রভাব রয়েছে বাংলা কবিতার জগতে। সেটা উভয় বঙ্গের ক্ষেত্রেই সত্য। যার মোহময় প্রভাব আরও বহুদিন ধরে প্রবাহিত হতে থাকবে। বুদ্ধদেব বসু থেকে শুরু করে সুনীল, শক্তি, শামসুর রাহমান হয়ে প্রবাহিত ধারাটি চলেছে শিল্পের দোহাই দিয়ে। যাদের সম্পর্কে চমৎকার বিশ্লেষণ ওঠে এসেছে এই কবিতায়।
রুদ্র আগাগোড়াই প্রতিশ্রুতিশীল কবি। গণমানুষের প্রতি, মানবতার পক্ষে, গণমুক্তির পথে। কবিতায় সমাজের সবস্তরেই প্রায় হাতড়ে বেড়িয়েছেন তিনি। সমাজ চালনার সমস্ত সুক্ষাতিসুক্ষ বিষয়াষয় উঠে এসেছে তার কবিতায়।
এখানে একটা কথা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা। আমরা রুদ্রকে যতটুকু না কবি হিসাবে জানতে চেয়েছি তারচে বেশি জেনেছি পর্ণ লেখক তসলিমা নাসরিনের স্মৃতিকথায়। যেখানে রুদ্রের কবিতাশক্তিকে বাদ দিয়ে তাকে বানানো হয়েছে একজন যৌনদানব, প্লেবয়। তসলিমার রুদ্র আর কবিতার রুদ্র এক নয়। কবিতার রুদ্রকে তসলিমার স্মৃতিকথায় সামান্য টুকুও পাওয়া যায় নাই। তসলিমা নাসরিন রুদ্রের অন্তর্জগত স্পর্শও করতে পারেন নাই। জানতেও পারেন নাই সেখানে কি ঘটে চলেছে। যার রক্তাক্ত সাক্ষী হয়ে আছে রুদ্রের প্রতিটি কবিতা।
৭১ সালে রুদ্র নবম শ্রেণির ছাত্র। তার বাবাকে পাক হানাদার ধরে নিয়া যাবার পর রুদ্র যুদ্ধে যাবার জন্য তৎপর হয়ে উঠেন। কিন্তু প্রথম সন্তান হিসাবে রুদ্রকে যুদ্ধে যেতে দেয় নাই। কিন্তু রুদ্র আজীবন যুদ্ধের মাঠ ছাড়ে নাই। কারণ যুদ্ধ কখনোই শেষ হয় নাই। সেই অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধই আজীবন চালিয়ে গেলেন কবিতায়, জীবন যাপনে। সমগ্র জীবন ধরে তিনি বিভিন্ন পাঠাগার আন্দোলন, সংস্কৃতি সংগঠন, কবিতা পরিষদ, স্বৈরাচার বিরোধী মিছিল মিটিং, বিদ্রোহী কবিতা সংকলন ইত্যাদি করেছেন। কখনো কর্পোরেটের গোলামী করা খায়েশ তার হয় নাই। যদিও আমরা জানি অনেক দারিদ্র্যতাপূর্ণ দিনাদি তিনি কাটিয়েছেন।
দুনিয়ার মজদুরেরা নির্যাতিত। কিন্তু সবসময় নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরাই মজদুরদের সংগঠিত করেন। দুনিয়ার সমস্ত বিপ্লবী নেতারাই মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। গণমানুষের তথা মজদুরদের সাথে তাদের সংযোগের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে সংস্কৃতি। যা বিপ্লবের সাকো তৈরি করে। বন্ধন তৈরি করে মজদুরদের ভেতর। সেই সংস্কৃতির সেতু তৈরির চেষ্টাই ছিল রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনের ঠিকানা। নিজের জীবন সম্পর্কে প্রায় আগাগোড়া উদাসীন এই কবি সত্যিকার অর্থে এক মহান বিদ্বজ্জনের জীবনই কাটিয়ে গেছেন। তিনি কোনো পুরষ্কারের তোয়াক্কা করেন নাই। সেই অর্থে অজস্র বাংলাদেশি গতানুগতিক কবিদের মত ছিলেন না তিনি। রুদ্র বাংলার গণমানুষকে বুঝতেন। তিনি বুঝেছিলেন প্রগতির পথে ধর্মান্ধতাও বাধা হয়ে দাড়িয়ে আছে। যাকে কার্ল মার্কস বলেছিলেন আফিম। কিন্তু রুদ্র বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন
একদার অন্ধকারে ধর্ম এনে দিয়েছিলো আলো,
আজ তার কংকালের হাড় আর পচা মাংশগুলো
ফেরি কোরে ফেরে কিছু স্বার্থান্বেষী ফাউল মানুষ
সৃষ্টির অজানা অংশ পুর্ন করে গালগল্প দিয়ে।
আফিম তবুও ভালো, ধর্ম সে তো হেমলক বিষ। -ধর্মান্ধের ধর্ম নেই, আছে লোভ, ঘৃন্য চতুরতা।
ধর্ম সম্পর্কে তিনি আরো প্রশ্ন তোলেন পরলৌকিক মুলোসহ অনেক কবিতায়। তবে তিনি সমস্ত ধর্মাধর্মের উর্ধ্বে অন্য এক পরিচয়ের কথাও বলেন।
আমরা অনার্য- আজ এই কথা বলুক সবাই
বাঙালি না বাংলাদেশি, হিন্দু না বৌদ্ধ মুসলমান
বন্ধ হোক এইসব অর্থহীন তর্কের প্যাঁচাল।
আমরা অনার্য আজ এই কথা বলুক সবাই– আমরা অনার্য
‘অনার্য’ শব্দটা আমরা শোষিতের প্রতিশব্দ হিসাবে নিতে পারি। মার্কসবাদেও জাতীয়তাবাদ, ধর্মান্ধতার কোনো স্থান নাই। পৃথিবীতে মূলত দুইটা জাতি শোষক ও শোষিত, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া। শোষক বা পুঁজিবাদিরা মূলত সংখ্যালঘু কিন্তু ক্ষমতাবান। দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষকে যারা দোহন করে। বেশির ভাগ মানুষের শ্রম যারা লুটে নেয়। বস্তুত শোষিত গণমানুষের পক্ষই ন্যায়। তাদের পক্ষেই জগতের কবি সাহিত্যিক দার্শনিকদের পক্ষপাতিত্ব।
অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বে সামরিক শাসন সা¤্রাজ্যবাদের সবচাইতে প্রিয় বিষয়। কারণ ভিয়েতনাম বিপ্লবের পর মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদিরা তাদের শোষণের কৌশল পরিবর্তন করে। তারা একেকটা গরীব দেশে সরাসরি শোষন শাসনের বদলা সেই দেশেই তাদের লোকজন আর বাহিনী তৈরি করে সাম্রাজ্যবাদি আগ্রাসন চালানোর মনস্থির করে। তারই ফলশ্রুতি হিসাবে একদিকে এনজিও সংস্কৃতির জন্ম অন্যদিকে বলা হয় দুনিয়ার সমস্ত সেনা বাহিনীই মার্কিন সেনাবাহিনী। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। একাত্তরের পর রক্ষীবাহিনী ও মুজিববাহিনীর গণহত্যা, সপরিবারে মুজিব হত্যা, অজস্র সামরিক ক্যু, কর্ণেল তাহেরসহ অনেক সামরিক বিপ্লবীর ফাঁসি, জিয়ার ক্ষমতাদখল, জিয়া হত্যা, এরশাদের ক্ষমতাদখল থেকে শুরু করে সসস্ত্র বাহিনীর ভেতর অনেক হত্যা সংগঠিত হয়েছে। যার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জড়িত ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। একাত্তরের পর আরো বহুবার রক্তাক্ত হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি। এখনো হচ্ছে। এখনতো সশস্ত্র বাহিনী পরিণত হয়েছে ভাড়াটে খুনীতে। তা এড়ায় নাই রুদ্রের সচেতন কবি মানসও।
দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো– কোন পক্ষে যাবে?
রাইফেল তাক কোরে আছো মানুষের দিকে।
সঙ্গিন উঁচিয়ে আছো ধূর্ত নেকড়ের মত।
পায়ে বুট, সুরক্ষিত হেলমেটে ঢেকে আছো মাথা।
সশস্ত্র তোমার হাত,সংগঠিত, কে তোমাকে ছোঁয়।
… .. .. .. .. .. .. ..
সীমান্ত রক্ষার নামে তৈরি করা হয়েছে তোমাকে
সার্বভৌমত্বের নামে অস্ত্র দেয়া হয়েছে তোমাকে
শৃংখলা রক্ষার নামে তৈরি করা হয়েছে তোমাকে
আইন রক্ষার নামে অস্ত্র দেয়া হয়েছে তোমাকে
সীমান্ত রক্ষাও নয়, সার্বভৌমত্বও নয়, শুধুমাত্র পুঁজি
শুধুমাত্র পুঁজিবাদ রক্ষাই এখন তোমাদের মৌল কাজ।
.. .. .. .. .. .. .
দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো– কোন পক্ষে যাবে?
একদিকে বিত্তবান,
অন্যদিকে বিত্তহীন ক্ষুধার্ত মানুষ।
একদিকে পুঁজিবাদ,
অন্যদিকে সাম্যবাদী শান্তির সমাজ।
ইতিহাস সাক্ষী দ্যাখো, অনিবার্য এ লড়াই কোন পক্ষে যাবে? সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি
লেলিন তার রাষ্ট্র নামক বক্তৃতায় বলেছিলেন, রাষ্ট্র হচ্ছে এক শ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণিকে শোষণ করবার যন্ত্র। আর সশস্ত্র বাহিনী হচ্ছে রাষ্ট্রের অপরিহার্য স্তম্ভ। যাদের ব্যবহার করা হয়ে শোষিত জনগণের বিরুদ্ধে। সেই সশস্ত্র বাহিনীকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তিনি এই কবিতায়। এতদিন বেঁচে থাকলে তিনি ক্রসফায়ার সম্পর্কেও সোচ্ছার হতেন তাতে সন্দেহ নাই।
রুদ্র যে প্রচ- রাজনীতি সচেতন, সমাজ মনস্ক কবি ছিলেন শুধু তাই না। তিনি কবিতার অনেক ব্যকরণ সচেতন হয়েও কবিতা লিখেছেন। যাকে আমরা বলতে পারি ছন্দ, অনুপ্রাস ইত্যাদি নিয়াও অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন তিনি। তার কবিতার ভেতর বাংলা কবিতার স্বীকৃত মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত তিন ধরনের ছন্দেরই দেখা মেলে। আর বিভিন্ন অনুপ্রাসের দোলায় কবিতায় সৃষ্টি করেছেন জোয়ার। তবে কিছু কিছু জায়গায় তিনি ‘কমা’র বদলে ইংরাজি ফুলস্টপ ও ব্যবহার করেন। হয়তো নতুনত্বে খাতিরে। কিন্তু এতে ভাষা আগ্রাসন নিয়া তার চেতনা সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হয়।
রুদ্রের যাপিত সমাজ ও রাষ্ট্রের খুব কাছে আমরা এখনো বাস করি। এখনো রুদ্রের রক্তাক্ত বেদনাই আমাদের বাস্তবতা। যেই গণমুক্তি ও শোষনহীন সমাজের কথা রুদ্র তার কবিতাজুড়ে বয়ান করে গেছেন। যে সমস্ত বাধাবিঘ্নের চলচ্চিত্র রুদ্র আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। আর সেসব সমাধানের যেসব পথ তিনি বাতলে দিয়েছেন তাতে মনে হয় জাতি হিসাবে আমাদের অন্যতম সংস্কৃতির সেতুর নাম রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তার কবিতা পথ দেখাবে গণমানুষের কবিতাকে। যাদের কবিতা বারংবার ক্রমশ নতুন দিশা নিয়া হাজির হবে রুগ্ন, শোষিত, বঞ্চিত, পীড়িত মানুষের কাছে, রুদ্রের কবিতা তাদের মধ্যে অন্যতম।
(জাহেদ সরওয়ার, আর্টসবিডিনিউজ২৪)
চারিপাশে ঘোর অসম জীবন,- শব্দ-শ্রমিক/ র. ম. শহিদুল্লাহ
একাত্তর পরবর্তীকালে বাংলাদেশের কবিতায় গুরুত্বপূর্ণদের একজন অথচ কম বিজ্ঞাপিত কবি মহাত্মা রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। বাংলা সাহিত্যে ভুলবুঝা কবিও বলা যাবে তাকে। শুধু একাত্তরই বা বলি কেন। বাংলা কবিতার বিদ্রোহীধারায় নজরুল, সুকান্ত, দিনেশ দাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পর তার মত কণ্ঠস্বর আর খুঁজে পাওয়া যায় নাই।
‘আমি সেই পোড়া ভিত ভেঙে জেগে উঠেছি জীবনে,
আমি সেই কালো ঘোড়ার লাগাম ধ’রে আছি টেনে।
বুকের ভাষাকে সাজিয়ে রনের সজ্জায়,
আমি বুনে দিই শব্দ-প্রেরনা মানুষের লোহু মজ্জায় ॥ -শব্দ-শ্রমিক
যদিও খুব সহজেই নজরুলের কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয় আমাদের উপরোক্ত উচ্চারণ। তবুও শহিদুল্লাহর সমস্ত কবিতার আদিসত্য লুকিয়ে আছে এই লাইনে ‘ভাষার কিষান চোখ মেলে চেয়ে দেখি/ চারিপাশে ঘোর অসম জীবন।
তিনি ঘোষণা করেন ‘আমি কবি নই–শব্দ-শ্রমিক।’ সত্যিকার অর্থে রুদ্রের কবিতাকর্মকে নি:সন্দেহে শব্দশ্রম বলা যাবে। মহাত্মা জা পল সার্ত্র আত্মজীবনীর নাম রেখেছিলেন ‘শব্দ’। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। মানুষের জীবন আসলে ভাষা ছাড়া কিছু নয়। সেই ভাষা দাঁড়িয়ে থাকে শব্দের ওপর সুতরাং আত্মজীবনীর নাম এরচেয়ে সত্য আর কি হতে পারে!’ কথাটা হেয়ালির মত শোনালেও সত্য। মানুষ তার সমস্ত অভিজ্ঞতা অর্জন ও প্রকাশ করে ভাষার মাধ্যমে। এমনকি মুক মানুষেরাও যেই ইশারায় পরস্পরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে তাকেও ভাষা বলা যায়। কিন্তু এই ভাষাই আবার দেখার ভিন্নতার কারণে তার চরিত্র বদলায়। যেমন অর্থনৈতিক কারণে সমাজে মানুষের শ্রেণিবিভাজন ঘটে তেমনি শ্রেণিবিভাজনের কারণে ভাষাও তার শ্রেণিচরিত্র নেয়। আলাদা পোষাক পরে।
কিন্তু রুদ্র ‘ভাষার কিষান চোখ’ বলে আমাদের কাছে প্রথমেই নিজের পরিচয় লিপিবদ্ধ করছেন। কেবল মাত্র এই ভাষার কিষান চোখের চারিত্রিক কারণে তিনি ‘চারিপাশে ঘোর অসম জীবন’ দেখতে পেয়েছেন। তিনি আরো বৃহৎ পরিসরে নিজেকে স্থাপন করে যাচাই করছেন নিজেকে
সমতার নামে ক্ষমতাকে কোরে রপ্ত
আমি জানি কারা জীবনে ছড়ায় পুঁজ, পোকা, বিষ তপ্ত
জানি আমাদের কারা ধুতুরার ফুলে অন্ধ করেছে অবেলায়
ছুঁড়ে দিয়ে গেছে নষ্ট নগ্ন বেদনায়
সুতরাং ভাষার লাগাম তিনি ধরতে পেরেছিলেন। শব্দকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন চেতনার হাতুড়ি পেটানোর মতই। রচনা করতে পেরেছিলেন ‘ইশতেহারে’র মত কবিতা।
কার্ল মার্কস দুনিয়ার মজদুরের জন্য এত আহাজারি, এত গণিত, এত পরিসংখ্যান ও যুদ্ধের ডাক দিলেও দুনিয়ার সমস্ত মজদুর মার্কসবাদি নয়। হয়তো তারা মার্কসবাদ বুঝেনও না। তবুও মার্কস তাদের মুক্তির ও রাজত্বের বাসনাই করে গেছেন সমগ্র জীবন তার লেখনী ও চিন্তার মাধ্যমে। নিজের অজান্তেই তারা মার্কসবাদি। অথচ মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট করে মার্কসবাদ অধ্যায়ন করতে হয়। কারণ হিসাবে রুদ্র বলবেন ‘পরান সে ভুলে পূর্ন।’
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার সাথে যাদের পরিচয় ঘটেছে তারা অবগত আছেন মার্কসবাদের সাথে রুদ্রের কবিতার ভাব কত গভীর। নির্যাতিত গণমানুষের দীর্ঘশ্বাস কীভাবে রক্তাক্ত করে দিয়ে যায় রুদ্রের মুখ। ’ইশতেহার’ কবিতায় তিনি ধরতে চেয়েছেন কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর পুরাটাই। মানবজাতির এক ধারাবাহিক অর্থনৈতিক বিকাশকে যেমনি তিনি এই কবিতায় ধরেছেন তেমনি পুঁজিবাদের সঙ্কট ও এ থেকে বেরিয়ে নতুন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দিয়ে তিনি শেষ করেন তার অমর কবিতা ইশতেহার। এই ধরনের কবিতা বাংলাদেশি সাহিত্যে এই প্রথম দেখলাম আমরা। ১১৯ লাইনের এই দীর্ঘ কবিতাটি সত্যিকার অর্থেই বাংলা কবিতার জগতে মাইলফলক।
রুদ্রের কবিতা বাংলাদেশের আজন্ম রক্তাক্ত ইতিহাসের স্মারক বললেও অত্যুক্তি হয় না। একাত্তরের যুদ্ধের সময় তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র। তার বাবাকে ধরে নিয়ে গেছিল পাকিস্তানি হানাদারেরা। ১৯৭৭ সালেই তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেন
এই রক্তমাখা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো
জীর্ন জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
…. .. .. .. .. .. .. .. ..
এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী
স্বাধীনতা একি তবে নষ্ট জন্ম?
কবিতাকে অনেক দিন ধরেই আলাদা কিসিমের মাল হিসাবে চালানো হয়েছে। তার উপর আরোপন করা হয়েছে কুমারিত্ব, পবিত্রতা। বলা হয়েছে কবিতার ভাষা এক সান্ধ্যভাষা। এখনোব্দি বাংলাদেশি কবিরা সেসব সান্ধ্যভাষায় আলোআধারির কবিতা লেখার চেষ্টা করে চলেছেন। কবিতাকে বহু আগেই বিশেষ করে তিরিশি আধুনিকতাকে বহু আগেই নিরাশ করেছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তার বিষয় গণমুখি, ভাষা গতিশীল, সহজবোধ্য, শব্দ বিচিত্রগামী। সেই হিসাবে রুদ্র নিজেই পরিহার করেন তথাকথিত আধুনিকতার নাগপাশ। তিনি বলেন,
এখন কবিতা খাপখোলা তলোয়ার
এখন কবিতা মেদহীন ঋজু দেহ।
কবিতা এখন স্বপ্নের প্ররোচনা
কবিতা এখন বিশ্বাসী হাতিয়ার ॥
সাহিত্যের ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যায়, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের মত কবিতাও একটা প্রকাশ ভঙ্গি। জীবন থেকে আলাদা হয়ে, ছিন্ন হয়ে কোনো প্রকাশভঙ্গিই বাঁচতে পারে না। কিন্তু যুগে যুগে দেখা গেছে কবিদের ভেতর লূম্পেন প্রলেতারিয়েতের ভিড়। তারা স্লোগান দিয়েছে সাহিত্যের কোনো দায় নাই। শিল্পের জন্য শিল্প জাতীয় স্লোগান। যা মূলত পরদেশি এজন্ডা ও আত্মপ্রতারণায় ভরা। রুদ্র তাদের লক্ষ্য করে লেখেন ‘নপুংশক কবিদের প্রতি’।
সহস্র মৃত্যুর মধ্যে গেয়ে ওঠো রমন সঙ্গীত,
জ্বলন্ত ক্ষুধার রাজ্যে স্বপ্নে দ্যাখো পুস্পের পেখম।
রাজপথে গুলিবিদ্ধ লাশ রেখে হোটেলের ঘরে
জ’মে ওঠে তোমাদের লাস্যময় কবিতা উৎসব।
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
জীবন দেখতে যাও টার্মিনালে, খানকি পাড়ায়,
বেশ্যার নাভির নিচে খুঁজে ফেরো শিল্পের আরক–
অথচ সে-জীবনের জন্যে কোনো পক্ষপাত নেই,
সেই কষ্টের বিপক্ষে কোনো বাক্য নেই তোমাদের। -নপুংশক কবিদের প্রতি।
তিরিশের দশক থেকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত আধুনিক কবিতা বলয়ের চরম প্রভাব রয়েছে বাংলা কবিতার জগতে। সেটা উভয় বঙ্গের ক্ষেত্রেই সত্য। যার মোহময় প্রভাব আরও বহুদিন ধরে প্রবাহিত হতে থাকবে। বুদ্ধদেব বসু থেকে শুরু করে সুনীল, শক্তি, শামসুর রাহমান হয়ে প্রবাহিত ধারাটি চলেছে শিল্পের দোহাই দিয়ে। যাদের সম্পর্কে চমৎকার বিশ্লেষণ ওঠে এসেছে এই কবিতায়।
রুদ্র আগাগোড়াই প্রতিশ্রুতিশীল কবি। গণমানুষের প্রতি, মানবতার পক্ষে, গণমুক্তির পথে। কবিতায় সমাজের সবস্তরেই প্রায় হাতড়ে বেড়িয়েছেন তিনি। সমাজ চালনার সমস্ত সুক্ষাতিসুক্ষ বিষয়াষয় উঠে এসেছে তার কবিতায়।
এখানে একটা কথা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা। আমরা রুদ্রকে যতটুকু না কবি হিসাবে জানতে চেয়েছি তারচে বেশি জেনেছি পর্ণ লেখক তসলিমা নাসরিনের স্মৃতিকথায়। যেখানে রুদ্রের কবিতাশক্তিকে বাদ দিয়ে তাকে বানানো হয়েছে একজন যৌনদানব, প্লেবয়। তসলিমার রুদ্র আর কবিতার রুদ্র এক নয়। কবিতার রুদ্রকে তসলিমার স্মৃতিকথায় সামান্য টুকুও পাওয়া যায় নাই। তসলিমা নাসরিন রুদ্রের অন্তর্জগত স্পর্শও করতে পারেন নাই। জানতেও পারেন নাই সেখানে কি ঘটে চলেছে। যার রক্তাক্ত সাক্ষী হয়ে আছে রুদ্রের প্রতিটি কবিতা।
৭১ সালে রুদ্র নবম শ্রেণির ছাত্র। তার বাবাকে পাক হানাদার ধরে নিয়া যাবার পর রুদ্র যুদ্ধে যাবার জন্য তৎপর হয়ে উঠেন। কিন্তু প্রথম সন্তান হিসাবে রুদ্রকে যুদ্ধে যেতে দেয় নাই। কিন্তু রুদ্র আজীবন যুদ্ধের মাঠ ছাড়ে নাই। কারণ যুদ্ধ কখনোই শেষ হয় নাই। সেই অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধই আজীবন চালিয়ে গেলেন কবিতায়, জীবন যাপনে। সমগ্র জীবন ধরে তিনি বিভিন্ন পাঠাগার আন্দোলন, সংস্কৃতি সংগঠন, কবিতা পরিষদ, স্বৈরাচার বিরোধী মিছিল মিটিং, বিদ্রোহী কবিতা সংকলন ইত্যাদি করেছেন। কখনো কর্পোরেটের গোলামী করা খায়েশ তার হয় নাই। যদিও আমরা জানি অনেক দারিদ্র্যতাপূর্ণ দিনাদি তিনি কাটিয়েছেন।
দুনিয়ার মজদুরেরা নির্যাতিত। কিন্তু সবসময় নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরাই মজদুরদের সংগঠিত করেন। দুনিয়ার সমস্ত বিপ্লবী নেতারাই মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। গণমানুষের তথা মজদুরদের সাথে তাদের সংযোগের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে সংস্কৃতি। যা বিপ্লবের সাকো তৈরি করে। বন্ধন তৈরি করে মজদুরদের ভেতর। সেই সংস্কৃতির সেতু তৈরির চেষ্টাই ছিল রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনের ঠিকানা। নিজের জীবন সম্পর্কে প্রায় আগাগোড়া উদাসীন এই কবি সত্যিকার অর্থে এক মহান বিদ্বজ্জনের জীবনই কাটিয়ে গেছেন। তিনি কোনো পুরষ্কারের তোয়াক্কা করেন নাই। সেই অর্থে অজস্র বাংলাদেশি গতানুগতিক কবিদের মত ছিলেন না তিনি। রুদ্র বাংলার গণমানুষকে বুঝতেন। তিনি বুঝেছিলেন প্রগতির পথে ধর্মান্ধতাও বাধা হয়ে দাড়িয়ে আছে। যাকে কার্ল মার্কস বলেছিলেন আফিম। কিন্তু রুদ্র বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন
একদার অন্ধকারে ধর্ম এনে দিয়েছিলো আলো,
আজ তার কংকালের হাড় আর পচা মাংশগুলো
ফেরি কোরে ফেরে কিছু স্বার্থান্বেষী ফাউল মানুষ
সৃষ্টির অজানা অংশ পুর্ন করে গালগল্প দিয়ে।
আফিম তবুও ভালো, ধর্ম সে তো হেমলক বিষ। -ধর্মান্ধের ধর্ম নেই, আছে লোভ, ঘৃন্য চতুরতা।
ধর্ম সম্পর্কে তিনি আরো প্রশ্ন তোলেন পরলৌকিক মুলোসহ অনেক কবিতায়। তবে তিনি সমস্ত ধর্মাধর্মের উর্ধ্বে অন্য এক পরিচয়ের কথাও বলেন।
আমরা অনার্য- আজ এই কথা বলুক সবাই
বাঙালি না বাংলাদেশি, হিন্দু না বৌদ্ধ মুসলমান
বন্ধ হোক এইসব অর্থহীন তর্কের প্যাঁচাল।
আমরা অনার্য আজ এই কথা বলুক সবাই– আমরা অনার্য
‘অনার্য’ শব্দটা আমরা শোষিতের প্রতিশব্দ হিসাবে নিতে পারি। মার্কসবাদেও জাতীয়তাবাদ, ধর্মান্ধতার কোনো স্থান নাই। পৃথিবীতে মূলত দুইটা জাতি শোষক ও শোষিত, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া। শোষক বা পুঁজিবাদিরা মূলত সংখ্যালঘু কিন্তু ক্ষমতাবান। দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষকে যারা দোহন করে। বেশির ভাগ মানুষের শ্রম যারা লুটে নেয়। বস্তুত শোষিত গণমানুষের পক্ষই ন্যায়। তাদের পক্ষেই জগতের কবি সাহিত্যিক দার্শনিকদের পক্ষপাতিত্ব।
অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বে সামরিক শাসন সা¤্রাজ্যবাদের সবচাইতে প্রিয় বিষয়। কারণ ভিয়েতনাম বিপ্লবের পর মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদিরা তাদের শোষণের কৌশল পরিবর্তন করে। তারা একেকটা গরীব দেশে সরাসরি শোষন শাসনের বদলা সেই দেশেই তাদের লোকজন আর বাহিনী তৈরি করে সাম্রাজ্যবাদি আগ্রাসন চালানোর মনস্থির করে। তারই ফলশ্রুতি হিসাবে একদিকে এনজিও সংস্কৃতির জন্ম অন্যদিকে বলা হয় দুনিয়ার সমস্ত সেনা বাহিনীই মার্কিন সেনাবাহিনী। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। একাত্তরের পর রক্ষীবাহিনী ও মুজিববাহিনীর গণহত্যা, সপরিবারে মুজিব হত্যা, অজস্র সামরিক ক্যু, কর্ণেল তাহেরসহ অনেক সামরিক বিপ্লবীর ফাঁসি, জিয়ার ক্ষমতাদখল, জিয়া হত্যা, এরশাদের ক্ষমতাদখল থেকে শুরু করে সসস্ত্র বাহিনীর ভেতর অনেক হত্যা সংগঠিত হয়েছে। যার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জড়িত ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। একাত্তরের পর আরো বহুবার রক্তাক্ত হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি। এখনো হচ্ছে। এখনতো সশস্ত্র বাহিনী পরিণত হয়েছে ভাড়াটে খুনীতে। তা এড়ায় নাই রুদ্রের সচেতন কবি মানসও।
দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো– কোন পক্ষে যাবে?
রাইফেল তাক কোরে আছো মানুষের দিকে।
সঙ্গিন উঁচিয়ে আছো ধূর্ত নেকড়ের মত।
পায়ে বুট, সুরক্ষিত হেলমেটে ঢেকে আছো মাথা।
সশস্ত্র তোমার হাত,সংগঠিত, কে তোমাকে ছোঁয়।
… .. .. .. .. .. .. ..
সীমান্ত রক্ষার নামে তৈরি করা হয়েছে তোমাকে
সার্বভৌমত্বের নামে অস্ত্র দেয়া হয়েছে তোমাকে
শৃংখলা রক্ষার নামে তৈরি করা হয়েছে তোমাকে
আইন রক্ষার নামে অস্ত্র দেয়া হয়েছে তোমাকে
সীমান্ত রক্ষাও নয়, সার্বভৌমত্বও নয়, শুধুমাত্র পুঁজি
শুধুমাত্র পুঁজিবাদ রক্ষাই এখন তোমাদের মৌল কাজ।
.. .. .. .. .. .. .
দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো– কোন পক্ষে যাবে?
একদিকে বিত্তবান,
অন্যদিকে বিত্তহীন ক্ষুধার্ত মানুষ।
একদিকে পুঁজিবাদ,
অন্যদিকে সাম্যবাদী শান্তির সমাজ।
ইতিহাস সাক্ষী দ্যাখো, অনিবার্য এ লড়াই কোন পক্ষে যাবে? সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি
লেলিন তার রাষ্ট্র নামক বক্তৃতায় বলেছিলেন, রাষ্ট্র হচ্ছে এক শ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণিকে শোষণ করবার যন্ত্র। আর সশস্ত্র বাহিনী হচ্ছে রাষ্ট্রের অপরিহার্য স্তম্ভ। যাদের ব্যবহার করা হয়ে শোষিত জনগণের বিরুদ্ধে। সেই সশস্ত্র বাহিনীকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তিনি এই কবিতায়। এতদিন বেঁচে থাকলে তিনি ক্রসফায়ার সম্পর্কেও সোচ্ছার হতেন তাতে সন্দেহ নাই।
রুদ্র যে প্রচ- রাজনীতি সচেতন, সমাজ মনস্ক কবি ছিলেন শুধু তাই না। তিনি কবিতার অনেক ব্যকরণ সচেতন হয়েও কবিতা লিখেছেন। যাকে আমরা বলতে পারি ছন্দ, অনুপ্রাস ইত্যাদি নিয়াও অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন তিনি। তার কবিতার ভেতর বাংলা কবিতার স্বীকৃত মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত তিন ধরনের ছন্দেরই দেখা মেলে। আর বিভিন্ন অনুপ্রাসের দোলায় কবিতায় সৃষ্টি করেছেন জোয়ার। তবে কিছু কিছু জায়গায় তিনি ‘কমা’র বদলে ইংরাজি ফুলস্টপ ও ব্যবহার করেন। হয়তো নতুনত্বে খাতিরে। কিন্তু এতে ভাষা আগ্রাসন নিয়া তার চেতনা সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হয়।
রুদ্রের যাপিত সমাজ ও রাষ্ট্রের খুব কাছে আমরা এখনো বাস করি। এখনো রুদ্রের রক্তাক্ত বেদনাই আমাদের বাস্তবতা। যেই গণমুক্তি ও শোষনহীন সমাজের কথা রুদ্র তার কবিতাজুড়ে বয়ান করে গেছেন। যে সমস্ত বাধাবিঘ্নের চলচ্চিত্র রুদ্র আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। আর সেসব সমাধানের যেসব পথ তিনি বাতলে দিয়েছেন তাতে মনে হয় জাতি হিসাবে আমাদের অন্যতম সংস্কৃতির সেতুর নাম রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তার কবিতা পথ দেখাবে গণমানুষের কবিতাকে। যাদের কবিতা বারংবার ক্রমশ নতুন দিশা নিয়া হাজির হবে রুগ্ন, শোষিত, বঞ্চিত, পীড়িত মানুষের কাছে, রুদ্রের কবিতা তাদের মধ্যে অন্যতম।
(জাহেদ সরওয়ার, আর্টসবিডিনিউজ২৪)