বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে আবু হাসান শাহরিয়ার (জ.১৯৫৯) সত্তর দশকের কবি। কবিতাচর্চার পাশাপাশি তিনি পরিচ্ছন্ন সম্পাদক হিসেবেও সমকালের তরুণ লিখিয়েদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। আকণ্ঠ আধুনিকতায় নিমজ্জিত আবু হাসান শাহরিয়ার কাব্যপ্রকরণে ও বিষয় নির্বাচনের স্বতন্ত্র পথে সত্তরের দশকের অনেক কবির ভিড়েও নিজের আলাদা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবিদের কবিমানস একই সঙ্গে বহুবর্ণিল এবং বিভিন্নমুখী। এ সময়ের কবিদের রচনায় আছে— হতাশা ক্লান্তি অবসাদ নৈঃসঙ্গ্যচেতনা ও সংশয়, পাশাপাশি তাঁদের কণ্ঠে তীব্র প্রতিবাদ এবং বিপন্ন পৃথিবীর বিপরীতে সুখী-সমৃদ্ধ নবতর প্রতিবেশ পৃথিবী নির্মাণের আকাঙ্ক্ষাও উচ্চকিত। এ প্রসঙ্গে বিশ্বজিৎ ঘোষের মন্তব্য স্মরণীয় :
‘সমাজবাস্তবতা ও ব্যক্তিক সংবেদনার মিথস্ক্রিয়ায় সত্তরের কবিতায়, কিংবা বলি সত্তরে আবির্ভূত কবিদের সৃষ্টিতে, প্রধান হয়ে উঠল— মুক্তিযুদ্ধের গৌরব আর সঙ্ঘশক্তির উত্তাপ ফুরিয়ে যেতে-না-যেতেই— ব্যক্তির আত্মপ্রক্ষেপ আমিত্ব চেতনা ও অতল-অসীম নৈঃসঙ্গ্যবেদনা। বিচ্ছিন্নতার দুর্ভর যন্ত্রণা ও নৈঃসঙ্গ্যের দুর্মোচ্য অভিশাপে বিপর্যস্ত সত্তর দশকী কবিমানস পৌনঃপুনিকভাবে সংক্রামিত হয়েছে অবিশ্বাস সংশয় আর অনন্বয়ের মরুময়তায়; অনাশ্রয়ী এই পৃথিবীতে সম্মিলিতভাবে তাঁরা সন্তরণ কেটেছে অতলান্ত একাকিত্ব-অর্ণবে। তবে ব্যর্থতাবোধ ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় বিপন্ন হয়েও এই দশকের কবিরাই আবার কখনো-বা ব্যক্তিক দায়বদ্ধতা এবং সামাজিক প্রেরণায় জেগে উঠেছে সপ্রাণ সত্তায়; আন্তঃমানবিক সম্পর্কবন্ধনে ঋদ্ধ হয়ে উচ্চারণ করেছে বিচ্ছিন্নতা-বিভঙ্গতা-অনন্বয় থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার কথা।’
আবু হাসান শাহরিয়ার সমকালের সংশয় হতাশা স্বপ্নভঙ্গের বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত হলেও ‘আন্তঃমানবিক সম্পর্কবন্ধনে ঋদ্ধ’ হয়েই কাব্যচরণে শেষ পর্যন্ত আশার কথা মুক্তির কথা বলেন। তিনি ‘অন্তহীন মায়াবী ভ্রমণ’ (১৯৮৬) কাব্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেন কবিতার জগতে এবং তাঁর পাঠকের সামনে মেলে ধরেন ‘অব্যর্থ আঙুল’ (১৯৯০)। আবু হাসান শাহরিয়ার কবিতায় আত্মমগ্ন ধ্যানে বিপন্ন সময়ের স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে বিপর্যস্ত মানুষকে শুনিয়েছেন মুক্তির কথা দেখিয়েছেন বিস্তীর্ণ আলোময় পথ। এসব বিষয় তিনি কবিতার পঙক্তিমালায় প্রথাগত নির্মাণকলার বিপ্রতীপে ভিন্নতর এক নান্দনিক সৌকর্যে বিন্যস্ত করেন।
বাংলা কবিতা অনেক আগেই পদ্যের (অন্ত্যমিলযুক্ত) গত্বাঁধা ছক ভেঙে গদ্যের বিস্তৃত আঙিনায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে। গদ্যঢঙে বাংলা কবিতার শরীর নির্মাণ একালে আর নতুন কোনো বিষয় নয়। আবু হাসান শাহরিয়ার কীভাবে গদ্যে কাব্যশরীরে শব্দবিন্যাসরীতিতে নান্দনিক শ্রীবৃদ্ধি করেন তা ‘এ মহাকাব্যের যুগ অর্ঘ্য মানি বাল্মীকির পায়’, ‘যার জন্য জেগে থাকা, সে ঘুমায় চন্দনের খাটে’, ‘প্রেমে না এঁটুলি হলে টান পড়ে রসের ভাঁড়ারে’, ‘তোমার বাঙ্ময় ঠোঁটে টিপসই দিয়ে যেতে আসি’ এবং ‘আমার বাড়িতে আজে কলেজপুড়ুয়া এক প্রেমের কবিতা’ প্রভৃতি ধরা পড়েছে। এ কবিতাগুলোর নামকরণ যেমন গদ্যগন্ধী তেমনি অভ্যন্তর সজ্জাও গদ্যময়। কবিতার শরীরে শব্দবিন্যাসের ঢঙ গদ্যের। তাঁর গদ্যরীতির কবিতা সমকালের অন্যদের চেয়ে আলাদা এবং বিশিষ্টতার দাবিদার। কেননা আবু হাসান শাহরিয়ার অসামান্য দক্ষতায় কবিতার শব্দবিন্যাসে গদ্যভঙ্গিতে যতিচিহ্নের ব্যবহার করেও কাব্যভাষাকে কবিতার ছন্দে-তালে দোলাতে পারেন। উপরন্তু তাঁর কাব্যভাষায় কথোপকথনের অসাধারণ সাবলীলতাও বিমুগ্ধ করে পাঠককে। তাঁর কবিতায় কথোপকথন যেন জলের তরঙ্গের মতো নেচে চলে। কবিতাগুলো দৃশ্যত গদ্য মনে হলেও এ পাঁচটি কবিতাই অন্তর কাব্যের জারক রসে জারিত। গদ্যভাষা ভঙ্গির অন্তরালে ফল্গুধারার ন্যায় এসব কবিতায় চিরায়ত ছন্দের তরঙ্গ প্রবহমান। প্রসঙ্গত বলা দরকার নামকরণেও কবি এখানে সচেতনভাবে গদ্যঢঙ ব্যবহারের পাশাপাশি প্রতীকায়ন পরিহার করেছেন। দৈনিক পত্রিকার ‘হেড লাইন’ বা শিরোনাম যেমন বিষয়বস্তুর অভ্যন্তর সম্পর্কে মূল তথ্য প্রকাশ করে তেমনি শাহরিয়ারের কবিতার নামকরণও সংবাদপত্রের ‘হেড লাইন’ সদৃশ অন্তর্গত তথ্য উদ্ঘাটনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে মাত্র। বলাবাহুল্য, কবিতার নামকরণ সাধারণত প্রতীকধর্মী হয়ে থাকে কিন্তু তিনি প্রতীকায়নের প্রচলপ্রথা ভেঙে কবিতার অন্তরস্থ তথ্যকে নামের মধ্য দিয়েই প্রকাশে সচেষ্ট হয়েছেন। কবিতার নামকরণের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি অভিনব মনে হলেও লিটল ম্যাগাজিন কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিখিয়েদের রচনায় গদ্যঢঙের এ জাতীয় নামকরণের বিষয়টি নতুন নয়; তবে তাঁদের কাব্যভাষার মতোই কবিতার নামকরণও সাধারণত জটিল শব্দবিন্যাসের মাধ্যমে ঘটে বলে সেই নামকরণ আদৌ কবিতার অন্তরস্থ তথ্য বা তত্ত্বের পরিচায়ক কি না__তা উদ্ধার করা বেশ মুশকিল। অথচ আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতায় গদ্যঢঙের দীর্ঘ নামকরণের সঙ্গে কবিতার অভ্যন্তরীণ তথ্য বা তত্ত্ব প্রকাশের সম্পর্কটি ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেকোনো পাঠক প্রথম দর্শনে কবিতাগুলোকে গদ্য বলে ভুল করতে পারে কিন্তু পাঠের সময় ঠিকই তিনি উপলব্ধি করেন আসলে এগুলো কবিতা, তবে রিদিমক বিন্যাস প্রকৌশল অভিনব প্রক্রিয়ায় ঋদ্ধ।
আবু হাসান শাহরিয়ারের এ কবিতাগুলোর প্রকরণ বা টেকনিক অভিনব সে কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। কাব্যশরীর নির্মাণে কবি এখানে টেকনিকের ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিষয়বস্তু নির্বাচনেও তরতাজা সমকালীন বাস্তবতাকে উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ‘এ মহাকাব্যের যুগ অর্ঘ্য মানি বাল্মীকির পায়’ কবিতায় সমকালীন বৈশ্বিক বাস্তবতার প্রেক্ষপট ও প্রতিবেশ পৃথিবীর ভাষ্য রচনা করেছেন কবি। এ কবিতায় ক্লিনটন-মণিকার যৌন কেলেঙ্কারী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উৎকট যৌনাচারের নিরেট সত্য ব্যক্ত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক বেশি খবর আমরা পাই না। তারপরও সেখানে সুন্দরী মণিকারা যেভাবে বিশ্বের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপ্রধানে অচরিতার্থ যৌন লালসার শিকারে পরিণত হয় একইভাবে বাংলাদেশের পারুল বোনেরাও নিরাপদ নয়। একই সময় এ দেশে ‘পাশের বাড়ির শিশু কন্যাটি বলাৎকার’ পশ্চিমা বিশ্বের কাছেও আমাদের মাথা নিচু করে দেয়। আর তাই কবি মনে করেন পারুলের চিৎকার আর ডাকাডাকিতে ‘সাত ভাই জাগিবে না আর।’ এ কবিতায় শুধু সমকালীন যৌনজীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রেক্ষাপটই শুধু নয় কবিতাটির শেষে ইরাক ধ্বংসের তাণ্ডবলীলাও অসাধারণ দক্ষতায় কবি প্রকাশ করেছেন। ধর্ষণের মতো ভয়াবহ রোগাক্রান্ত এ বিশ্বে আরও ভয়ানক রূপে ‘অতঃপর আসিতেছে বুশের সার্কাস। শোনো হে গর্জন, ওই ডাকিতেছে পেন্টাগনি বাঘ।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মারণাস্ত্রের আঘাতে ইতোমধ্যে ইরাকের অবকাঠামো প্রাচীন মানবসভ্যতার ইতিহাস সর্বোপরি বিশ্ববিবেক ধুলোয় মিশে গেছে। বিশ্ববাসী তাকিয়ে দেখেছে বিশ্বমোড়লের ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটনের অসীম ক্ষমতার দাপট ও বলবীর্য। তবে আপামর সাধারণ জনতা মানবতাবিরোধী ‘বুশচক্রে’র এই তাণ্ডবলীলার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছে। পৃথিবীতে এখনো অনেক মানুষ আছেন যাঁরা বেঁচে থাকার আশ্রয় মানবতার নিভু নিভু প্রদীপখানি নিভে যেতে দিতে চান না। তাঁরা জীবনের শঙ্কা মাথায় নিয়েও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন।
আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘যার জন্য জেগে থাকা, সে ঘুমায় চন্দনের খাটে’ কবিতায় আরও নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হয় পাঠক। এখানে কবি জানিয়েছেন, সাহিত্যপড়ুয়া ছাত্রীর ঘরে শাড়ির পাহাড় আছে কিন্তু তার ঘরে রবীন্দ্রনাথ নজরুল কিংবা জীবনানন্দ দাশ নেই। সমকালের প্রেক্ষাপটে জ্ঞানচর্চার এ চিত্র বাংলাদেশের বাস্তবতায় ষোলআনা সঠিক। সাহিত্যের ছাত্রীর ঘরে যদি গ্রন্থের বদলে শাড়ির স্তূপ জমে তাহলে অন্য পাঁচজন সাধারণ শিক্ষার্থীর কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এঁরা (রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ) যদি আমাদের ঘরে মনে পাঠে না থাকেন তাহলে মানবতা ধ্বংসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস শক্তি খুব শিগগিরই বাঙালি জাতির নিঃশেষিত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘তোমার বাঙ্ময় ঠোঁটে টিপসই দিয়ে যেতে আসি’ কবিতায়ও সভ্যতা ধ্বংসের অন্যতম কারণ হিসেবে কবি যুদ্ধকে চিহ্নিত ও দায়ী করেছেন। এখানে কবিকণ্ঠে হতাশার সুর ধ্বনিত হয়েছে। কারণ, প্রতিনিয়ত যুদ্ধমনস্ক হিংসা আর হানাহানির প্রতিবেশ পৃথিবী দেখে কবি যথেষ্ট ক্লান্তি অনুভব করেছেন। তিনি ভাবতে বাধ্য হয়েছেন : ‘পৃথিবী ফুরিয়ে যাবে, মানুষের যুদ্ধ ফুরোবে না। মনসা বেঁধেছে ঘর বিষধর মানুষের মনে।’ আজকের পৃথিবীতে সাপ কোনো বিষধর প্রাণী নয়, বৈজ্ঞানিক উন্নতি আর আবিষ্কার ক্ষমতালোভী মানুষকে করেছে সাপের চেয়েও বিষধর। কেননা সাপের ছোবলে বা বিষে একজন অথবা দুইজন মানুষ মারা যায় কিন্তু মানুষের বিষময় আবিষ্কার একটি মাত্র পারমাণবিক বোমার আঘাতে লক্ষ-কোটি অথবা শহরসুদ্ধ মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে নিমিষেই। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি আনবিক বোমার আঘাতে মুহূর্তে বিনাশ হয়েছে। ইরাক-আফগানিস্তানে বোমার আঘাতে মৃত্যু ঘটেছে অসংখ্য মানুষের। প্যালেস্টাইনে একে. ফোরটি সেভেনের বুলেটে মানুষ মরছে পাখির মতো। আবু হাসান শাহরিয়ার তাই ভাবছেন— কবিতার ওঝা দিয়ে মানুষের মনের এ বিষ নিষ্ক্রিয় হবে কি? আবু হাসান শাহরিয়ার ‘প্রেমে না এঁটুলি হলে টান পড়ে রসের ভাঁড়ারে’ এবং ‘আমার বাড়িতে আসে কলেজপুড়ুয়া এক প্রেমের কবিতা’য় সমকালের প্রেম যৌনাচার এবং ‘ডটকম’ নির্ভর সংস্কৃতির কথা ব্যক্ত করেছেন শিল্পিত দক্ষতায়। এখানে তিনি সমকালের বাস্তবতায় প্রেম ও যৌনতাকে মূল্যায়ন করেছেন।
আলোচ্য পাঁচটি কবিতার সবগুলোতেই সমকালীন প্রতিবেশ পৃথিবীর মানবসভ্যতা এবং মানুষের জীবনাচরণের নানাদিক প্রতিফলিত হয়েছে। কবিতার বিষয়-উপকরণ নির্বাচনে আবু হাসান শাহরিয়ারের সমকালীনতা এবং কাব্যশরীর নির্মাণে প্রথাগত রীতির বাইরে নতুনত্বের সন্ধান বাংলাদেশের সত্তরের কবিতায় নিঃসন্দেহে স্বতন্ত্র সংযোজন। সংক্ষিপ্ত এ আলোচনার পরিণামে বলা দরকার, কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের গদ্যময় কাব্যপ্রকরণ ভবিষ্যত বাংলা কবিতার বাঁক পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী দ্যোতক। ইতোমধ্যে আশি ও নব্বই দশকের মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করে শূন্য দশকের বাংলা কবিতায় গদ্যঢঙই অধিক প্রাধান্য লাভ করেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
(অনুপম হাসান)
বেলার কবি এই অবেলায়
শামসুর রাহমান
এটা কি কবির মহিমা না ট্র্যাজেডি যে নিজের সমাধিলিপি তাঁকেই লিখতে হয়? ‘আমাকে যেতেই হবে যদি, তবে আমি যীশুর মতন নগ্ন পদে চলে যেতে চাই।’ বাংলাদেশের কবিতার আধুনিকতা আর রাজনৈতিক স্বাধীনতার চেতনা হরিহর আত্মা হয়ে উঠেছিল শামসুর রাহমানের মধ্যে। তাঁর কবিতার ধারাবাহিক বিকাশ আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনী যেন সমান্তরালভাবে বয়ে গেছে। তিনি বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের উত্থানবেলার কাব্যিক প্রতিনিধি। বাংলাদেশের কাব্য ও বিদ্রোহের পরম্পরাকে ধারণ করে নিয়েছিলেন শামসুর রাহমান। ষাটের দশকেই শুরু হয় তাঁর কবি-প্রতিষ্ঠার যাত্রা। প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে বলে তিনি শুরু করেছিলেন। এমন করে বলা আজ চল হিসেবে চালু। কিন্তু তাঁর সময়ের শুরুতে এটা নতুনই ছিল। তিনি বাংলা কবিতাকে ব্যক্তিমনের নিজস্ব অনুভবে রঞ্জিত করা শুরু করলেন। তরুণ শামসুর রাহমান ষাটের দশক থেকেই মধ্যবিত্ত জীবনের আনন্দ আর বিষাদের রূপকার হয়ে উঠতে থাকেন। আধুনিক নাগরিক আবহে পুষ্ট তাঁর কবিতা। ঢাকা নগরের অন্তরাত্মাও যেন তাঁর মধ্য দিয়ে কথা বলে ওঠে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হয়েও এই কবিই কিনা, তাঁর সময়ের সব রাজনৈতিক আলোড়নে সাড়া দেন। কেবল বাংলাদেশের কবিতাতেই নয়, উভয় বাংলার কবিতায় তিনি একলাই এক স্তম্ভ। শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদ মিলিয়ে বাংলাদেশের নতুন কবিতা এখনো কেশবতীর দুটি বেণির মতোই দুই ধারায় প্রবাহিত। একজন যেন অন্যজনের প্রতিস্বর। শামসুর রাহমান নজরুলের মতোই রোমান্টিক, কিন্তু অতটা উচ্ছ্বসিত নন। তিনি জীবনানন্দ দাশের মতোই আলাদা, কিন্তু অতটা সামগ্রিকতাবাদী নন। তাঁর কবিতা ব্যক্তিমনের নির্জন প্রদেশে উঁকি দেয়, আবার জনসভায়ও সাবলীল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তার চেতনার মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করে। সেই অভ্যুত্থানের শহীদ আসাদকে নিয়ে লেখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতা। ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো, কিংবা সূর্যাস্তের/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/ উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়...আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বসে তিনি লেখেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি কবিতা, ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। সেই কবিতাগুলো আজ স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশ। এ রকম করে দিনে দিনে লিখেছেন, ‘ফিরিয়ে দাও ঘাতক কাঁটা/ এবার আমি গোলাপ নেব’। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেন শহীদ হওয়ার পরে লিখলেন, ‘বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে’। আমাদের একেকটি রাজনৈতিক যুগ ভাষার খোঁজে বারবার শামসুর রাহমানের আশ্রয় নিয়েছে। একজন কবির জন্য এ এক বিরাট প্রাপ্তি। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের সব বাঁক ও মোড় ফেরায় শামসুর রাহমান সাড়া দিয়েছেন সপ্রাণতার সঙ্গে। তাঁকে ততটা রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ কবি ভাবা হয় না। অথচ কবিতার সঙ্গে রাজনীতির এ রকম অকপট যোগাযোগে তিনিই দিশারি। তাঁর কবিতার রোমান্টিক শরীরের মধ্যে সংগ্রামী মেজাজের এক উষ্ণ ধমনি সর্বদাই প্রবাহিত ছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন ও গণ-আদালত গঠনের উদ্যোগে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৬৬। গদ্য-পদ্য মিলিয়ে তাঁর মোট গ্রন্থের সংখ্যা এক শ ছুঁই ছুঁই। তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে। এরপর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রৌদ্রকরোটিতে, নিরালোকে দিব্যরথ, বিধ্বস্ত নীলিমা, বন্দি শিবির থেকে, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, ইকারুসের আকাশ, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ প্রভৃতি গ্রন্থ। বেশ কিছু কিশোরপাঠ্য গ্রন্থেরও রচয়িতা তিনি। কবি শামসুর রাহমানের জন্ম ১৯২৯ সালে, ঢাকার মাহুতটুলীতে। বাল্যকাল থেকে প্রবীণ বয়স পর্যন্ত থেকেছেন পুরান ঢাকার অশোক লেনের পৈতৃক গৃহে। পেশাগত জীবনের শুরু ১৯৫৭ সালে দ্য মর্নিং নিউজ-এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ সময় একই পেশায় কাটিয়েছেন। সম্পাদনা করেছেন জাতীয় দৈনিক দৈনিক বাংলা। সাহিত্যে কৃতিত্বের স্বীকৃতিতে পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭) এবং স্বাধীনতা দিবস পদক (১৯৯১)। ভারতের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানসূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ইংরেজিসহ একাধিক বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা। আধুনিক বাংলা কবিতাকে পাঠকপ্রিয়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে বিশাল ভূমিকা। আমৃত্যু তিনি ছিলেন কবি, আমৃত্যু তিনি ছিলেন দায়বদ্ধ এক নাগরিক। এই সরব ভূমিকার কারণে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তি একাধিকবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছে। আজ কবি শামসুর রাহমানের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি লিখেছিলেন, ‘কেউ কি এখন এই অবেলায় আমার দিকে বাড়িয়ে দেবে হাত’। আধুনিক বাংলাদেশের কবিতার ধারার একদিকে তিনি, অন্যদিকটা সামনের দিকে খুলে দিচ্ছে। হাত বাড়ানোই আছে; ধরবার জন্য তিনি আর জেগে নেই।
(ফারুক ওয়াসিফ)
কবি ও প্রেম
রফিক আজাদ
তুমি যে সব ভুল করতে সেগুলো খুবই মারাত্মক ছিল । তোমার কথায় ছির গেঁয়ো টান, অনেকগুলো শব্দের ভুল উচ্চারণঃ ‘প্রমথ চৌধুরী‘কে তুমি বলতে ’প্রথম চৌধুরী’; ’জনৈক’ উচ্চারণ করতে গিয়ে সর্বদাই ‘জৈনিক’ বলে ফেলতে। এম্নি বহুতর ভয়াবহ ভুলে-ভরা ছিলো তোমার ব্যক্তিগত অভিধান। কিন্তু সে সময়, সেই সুদুর কৈশোরে ঐ মারাত্মক ভুলগুলো তোমার বড় বেশী ভালোবেসেছিলুম। তোমার পরীক্ষার খাতায় সর্বদাই সাধু ও চলতির দূষণীয় মিশ্রণ ঘটাতে। ভাষা-ব্যবহারে তুমি বরাবরই খুব অমনযোগী ছিলে। বেশ ভালো হাবাগোবা-গোছের লাজুক ও অবনতমুখী মেয়ে ছিলে তুমি। ‘শোকাভিভূত’ বলতে গিয়ে ব’লে ফেলতে ’শোকভুত’। তোমার উচ্চারণের ত্রুটি, বাক্যমধ্যস্থিত শব্দের ভুল ব্যবহারে আমি তখন এক ধরণের মজাই পেতুম।
বিশ বছর পর আজ তোমার বক্তৃতা শুনলাম। বিষয়ঃ ‘নারী স্বাধীনতা’। এতো সুন্দর, স্পষ্ট উচ্চারণে তোমার বক্তব্য রাখলে, যে, দেখে অবাক ও ব্যথিত হলুম । আমার বুকের মধ্যে জেঁকে বসা একটি পাথর বিশ বছর পর নিঃশব্দে নেমে গ্যালো ।