|
|
কবি নজরুলের রসবোধ
কাজী নজরুল এসেছেন সিরাজগঞ্জে। ইসমাইল হোসেন সিরাজীর প্রতি কবির ছিল অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও বিনয় মিশ্রিত ভালোবাসা।
সিরাজীর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কবি কাঁদলেন, খোদার কাছে মাগফেরাত চাইলেন। বেদনাবিধুর কণ্ঠে তিনি উপস্থিত লোকদেরকে শোনালেন, সিরাজী সাহেব আমাকে যে আদর করেছিলেন, তা আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ পাওয়া। এমন আদর আমাকে এই বাংলার আর কেউ করে নাই। এই সিরাজগঞ্জ থেকে তিনি আমার জন্য মানি অর্ডার করে সেকালে দশটি টাকা পাঠিয়েছিলেন, বলেছিলেন, একটি কলম কিনে নিও. আমার কাছে এর বেশী এখন নেই, থাকলে তোমায় পাঠিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।’ কথাগুলো বলার সময় বিদ্রোহী কবির চোখে অশ্রু ছলছল করছিল।
সফরের তৃতীয় দিন কবি খেতে বসেছেন আসাদউদ্দৌলা সিরাজীর ঘরে। সবার পাত্রে ইলিশ ভাজা পরিবেশন করছেন তিনি। কবির পাত্রেও একখানা দিয়েছিলেন, কবি সেটি খেয়ে কেবল শেষ করছিলেন, তখনই একজন আরও কিছু ইলিশভাজা তার প্লেটে দিতে যাচ্ছিলেন, রসিক কবি নজরুল তাকে বাধা দিয়ে হো হো করে বলে উঠলেন, আরে আরে করছ কী? শেষকালে আমাকে বিড়াল কামড়াবে তো?
উপস্থিত সবাই কবির কথাটা বুঝতে পারল না। গিয়াসুদ্দীন নামে একজন জিজ্ঞেস করলেন, মানে?
কবি বলতে লাগলেন তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে, আরে বুঝলেন না! ইলিশ মাছের গন্ধ মুখে লালা ঝরায়, বিড়াল মাতাল হয়ে যায় এর ঘ্রাণে, বেশী খেলে কি আর রক্ষে আছে, সারা দেহ থেকে গন্ধ ছুটবে আর সে গন্ধ পেয়ে বিড়াল তেড়ে আসবে।
এমন ব্যাখ্যা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ। আয়োজকরা কবির পাতে দই ঢেলে দিচ্ছেন। একটু দই মুখে দিয়ে কবি অদ্ভুত ভঙ্গিতে চোখ কপালে তুলে আসাদউদ্দৌলার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি হে! তুমি কি এই দই তেতুঁল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলে নাকি? সবাই আবারও হাসতে হাসতে কাত হয়ে গেল। টক দইয়ের জন্য মেজবানকে এভাবে শাসানো কবি নজরুল ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব ছিল?
দই খাওয়া শেষ। পান জর্দা মুখে দিয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে গা এলিয়ে শুয়ে আছিন কবি নজরুল। এমন সময় এক লোক এল কবিকে সালাম করতে। দরজায় দাড়িঁয়ে সে বেশ জোরে আসসালামু আলাইকুম বলল। কবি তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, আরে, দুর্গা দাসবাবুর মুখে আসসালামু আলাইকুম যে!, উপস্থিত সবাই কবির এমন আজব কথা শুনে আগন্তুকের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখে, লোকটি সত্যিই বাংলা নাট্যমঞ্চের বিখ্যাত নট দুর্গা দাসের মতো সুদর্শন। আগত লোকটি বিনীত ভাবে বললেন, আমি বন্দোপধ্যায় নই, সৈয়দ। এই তো রায়পুরায় আমার বাড়ী। একজন অচেনা মানুষকে এমন ভড়কে দিতে কবির আকস্মিক মন্তব্যে আবার হো হো করে হেসে গড়াল ঘরশুদ্ধ সব মানুষ।
বন্ধু শৈলেনের কাছে এসে তার কাছে কবি চা চাইলেন এই বলে, তুমি তো অনেক টাকা পাবে আমার কাছে, হিসেব করে রেখো, আপাতত দু পেয়ালা চা দাও।
শৈলেন জিজ্ঞেস করে, দু পেয়ালা কেন?
কবি বলে চলেছেন, আরে, লাখ পেয়ালা চা না খেরে চারাক হয় না। লাখ পেয়ালা হতেক আমার এখনও দু পেয়ালা বাকী আছে। বন্ধুর কাছে থেকে চা আদায় করে নিতে এমন অদ্ভুত মন্তব্য ছিল কবির নিত্য অভ্যাস।
কবি নজরুলের পত্রিকা ধুমকেতুর অফিসে সারাক্ষণ চলত হাসি আনন্দের বন্যা। সেখানে সবাইকে চা দেয়া হতো মাটির ভাঁড়ে। এর কারণ কী?
কবি যখন চায়ে চুমুক দিতে দিতে তার কোন হাসির কথা মনে পড়ে যায় কিংবা কোন রসিক বন্ধুকে এই মাত্র অফিসে ঢুকতে দেখেন, অমনি দে গরুর গা ধুইয়ে বলে চায়ের পেয়ালা ছুড়ে মারতেন, মাটির পেয়ালা ভেঙে চা ছিটকে পড়তো কাগজে, মেঝেতে, মাদুরে, কারো গায়ে। হাসতে হাসতে ক্লান্ত হতো কবির সঙ্গীরা, তবু থামতেন না কবি।
গোপীনাথ নামে একজন ধুমকেতুর অফিসে এসে এসব আজব কান্ড দেখে কবিকে জিজ্ঞেস করে বসল, আপনাদের মনে এত আনন্দ আসে কোত্থেকে?
এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে কবি আবারও বলে উঠেন, দে গরুর গা ধুইয়ে, শোন, আনন্দ কোত্থেকে জাগে, তার উত্তর নেই, কিন্তু নিরানন্দ কেন হবে, তার উত্তর শুনতে চাই তোমার কাছে।
গোপীনাথ জবাব দেয়, দেশ পরাধীন, সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সবাই। এমন জ্বালার মধ্যে আনন্দ জাগে কীভাবে? প্রতিটি ইংরেজ আমাদের শত্রু, তারা বুক ফুলিয়ে হাঁটবে আর আমরা হাসব, গাইব?
ভরাট গলায় নজরুল তাকে বুঝালেন, প্রতিটি ইংরেজ নয়, সমগ্র ইংরেজ সমাজ আমাদের শত্রু, এ শত্রুদের ভাসিয়ে দিতে হলে চাই প্রাণবন্যা, এরই আবাদ করছি আমরা এখানে।’ গোপীনাথ চুপ হয়ে শুনে ভাবুক হয়ে যায় কবির জবাব শুনে।
সৌজন্যে: গুঞ্জন
সিরাজীর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কবি কাঁদলেন, খোদার কাছে মাগফেরাত চাইলেন। বেদনাবিধুর কণ্ঠে তিনি উপস্থিত লোকদেরকে শোনালেন, সিরাজী সাহেব আমাকে যে আদর করেছিলেন, তা আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ পাওয়া। এমন আদর আমাকে এই বাংলার আর কেউ করে নাই। এই সিরাজগঞ্জ থেকে তিনি আমার জন্য মানি অর্ডার করে সেকালে দশটি টাকা পাঠিয়েছিলেন, বলেছিলেন, একটি কলম কিনে নিও. আমার কাছে এর বেশী এখন নেই, থাকলে তোমায় পাঠিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।’ কথাগুলো বলার সময় বিদ্রোহী কবির চোখে অশ্রু ছলছল করছিল।
সফরের তৃতীয় দিন কবি খেতে বসেছেন আসাদউদ্দৌলা সিরাজীর ঘরে। সবার পাত্রে ইলিশ ভাজা পরিবেশন করছেন তিনি। কবির পাত্রেও একখানা দিয়েছিলেন, কবি সেটি খেয়ে কেবল শেষ করছিলেন, তখনই একজন আরও কিছু ইলিশভাজা তার প্লেটে দিতে যাচ্ছিলেন, রসিক কবি নজরুল তাকে বাধা দিয়ে হো হো করে বলে উঠলেন, আরে আরে করছ কী? শেষকালে আমাকে বিড়াল কামড়াবে তো?
উপস্থিত সবাই কবির কথাটা বুঝতে পারল না। গিয়াসুদ্দীন নামে একজন জিজ্ঞেস করলেন, মানে?
কবি বলতে লাগলেন তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে, আরে বুঝলেন না! ইলিশ মাছের গন্ধ মুখে লালা ঝরায়, বিড়াল মাতাল হয়ে যায় এর ঘ্রাণে, বেশী খেলে কি আর রক্ষে আছে, সারা দেহ থেকে গন্ধ ছুটবে আর সে গন্ধ পেয়ে বিড়াল তেড়ে আসবে।
এমন ব্যাখ্যা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ। আয়োজকরা কবির পাতে দই ঢেলে দিচ্ছেন। একটু দই মুখে দিয়ে কবি অদ্ভুত ভঙ্গিতে চোখ কপালে তুলে আসাদউদ্দৌলার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি হে! তুমি কি এই দই তেতুঁল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলে নাকি? সবাই আবারও হাসতে হাসতে কাত হয়ে গেল। টক দইয়ের জন্য মেজবানকে এভাবে শাসানো কবি নজরুল ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব ছিল?
দই খাওয়া শেষ। পান জর্দা মুখে দিয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে গা এলিয়ে শুয়ে আছিন কবি নজরুল। এমন সময় এক লোক এল কবিকে সালাম করতে। দরজায় দাড়িঁয়ে সে বেশ জোরে আসসালামু আলাইকুম বলল। কবি তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, আরে, দুর্গা দাসবাবুর মুখে আসসালামু আলাইকুম যে!, উপস্থিত সবাই কবির এমন আজব কথা শুনে আগন্তুকের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখে, লোকটি সত্যিই বাংলা নাট্যমঞ্চের বিখ্যাত নট দুর্গা দাসের মতো সুদর্শন। আগত লোকটি বিনীত ভাবে বললেন, আমি বন্দোপধ্যায় নই, সৈয়দ। এই তো রায়পুরায় আমার বাড়ী। একজন অচেনা মানুষকে এমন ভড়কে দিতে কবির আকস্মিক মন্তব্যে আবার হো হো করে হেসে গড়াল ঘরশুদ্ধ সব মানুষ।
বন্ধু শৈলেনের কাছে এসে তার কাছে কবি চা চাইলেন এই বলে, তুমি তো অনেক টাকা পাবে আমার কাছে, হিসেব করে রেখো, আপাতত দু পেয়ালা চা দাও।
শৈলেন জিজ্ঞেস করে, দু পেয়ালা কেন?
কবি বলে চলেছেন, আরে, লাখ পেয়ালা চা না খেরে চারাক হয় না। লাখ পেয়ালা হতেক আমার এখনও দু পেয়ালা বাকী আছে। বন্ধুর কাছে থেকে চা আদায় করে নিতে এমন অদ্ভুত মন্তব্য ছিল কবির নিত্য অভ্যাস।
কবি নজরুলের পত্রিকা ধুমকেতুর অফিসে সারাক্ষণ চলত হাসি আনন্দের বন্যা। সেখানে সবাইকে চা দেয়া হতো মাটির ভাঁড়ে। এর কারণ কী?
কবি যখন চায়ে চুমুক দিতে দিতে তার কোন হাসির কথা মনে পড়ে যায় কিংবা কোন রসিক বন্ধুকে এই মাত্র অফিসে ঢুকতে দেখেন, অমনি দে গরুর গা ধুইয়ে বলে চায়ের পেয়ালা ছুড়ে মারতেন, মাটির পেয়ালা ভেঙে চা ছিটকে পড়তো কাগজে, মেঝেতে, মাদুরে, কারো গায়ে। হাসতে হাসতে ক্লান্ত হতো কবির সঙ্গীরা, তবু থামতেন না কবি।
গোপীনাথ নামে একজন ধুমকেতুর অফিসে এসে এসব আজব কান্ড দেখে কবিকে জিজ্ঞেস করে বসল, আপনাদের মনে এত আনন্দ আসে কোত্থেকে?
এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে কবি আবারও বলে উঠেন, দে গরুর গা ধুইয়ে, শোন, আনন্দ কোত্থেকে জাগে, তার উত্তর নেই, কিন্তু নিরানন্দ কেন হবে, তার উত্তর শুনতে চাই তোমার কাছে।
গোপীনাথ জবাব দেয়, দেশ পরাধীন, সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সবাই। এমন জ্বালার মধ্যে আনন্দ জাগে কীভাবে? প্রতিটি ইংরেজ আমাদের শত্রু, তারা বুক ফুলিয়ে হাঁটবে আর আমরা হাসব, গাইব?
ভরাট গলায় নজরুল তাকে বুঝালেন, প্রতিটি ইংরেজ নয়, সমগ্র ইংরেজ সমাজ আমাদের শত্রু, এ শত্রুদের ভাসিয়ে দিতে হলে চাই প্রাণবন্যা, এরই আবাদ করছি আমরা এখানে।’ গোপীনাথ চুপ হয়ে শুনে ভাবুক হয়ে যায় কবির জবাব শুনে।
সৌজন্যে: গুঞ্জন
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়
হুমায়ূন স্যারের স্বপ্নের নূহাশপল্লী
হুমায়ূন আহমেদ স্যারের লেখনির সাথে আমার পরিচয় ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা আজ আর মনে নেই। সবগুলো উপন্যাসও পড়া সম্ভব হয়নি আমার । তবে বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর অনেকগুলো উপন্যাস আমি পড়েছি । আমার যতটুকু মনে পড়ে ছোটবেলায় বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে প্রচারিত তাঁর লেখা ’এইসব দিনরাত্রি; এবং ‘বহুব্রীহি’ নাটকগুলো দেখেছিলাম প্রায় সকল পর্ব , তারপর “অয়োময়” । স্যারের ব্যাপক পরিচিতি বোধ হয় সেই নাটকগুলো থেকে (একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত) । লেখালেখির পাশাপাশি স্যার নাটক নির্মাণ ও চিত্র পরিচালনায় আসেন। তাছাড়া সেদিন প্রথমআলো পত্রিকায় দেখলাম স্যার ছবিও আকঁতেন। হুমায়ূন স্যারের যে গুণটি আমাকে সব সময় আকর্ষণ করতো তা হলো স্যার এতো বিষদভাবে আমাদের জীবনকে পর্যবেক্ষণ করতেন যা সত্যি অভাবনীয়। তাছাড়া বিজ্ঞানের যুগেও পরাবস্তব ঘটনা নিয়ে আমাদের কৌতুহলের অন্ত নেই আর তাঁর লেখনিতে এসব বিষয়গুলো ছিল অনেক ব্যাপক । মানুষের মনোস্তাত্তিক বিষয়গুলো খুব সুক্ষভাবে উপস্থাপন করেছেন তাঁর সৃষ্টিতে। বহুদিন আগে আমি একটি উপন্যাস পড়ছিলাম (উপন্যাসটির নাম আজ আমার মনে নেই)। উপন্যাসের এক জায়গায় এসে আমি থমকে গেলাম খুব সাধারণ কয়েকটি লাইন পড়ে। এক রোগী বিছানায় শুয়ে আছে । যেহেুতু রোগীদের কোন কাজ থাকেনা বিছানায় শুয়ে থাকা ছাড়া তখন তারা কতো অদ্ভুত কল্পনা করে । এক মোটা নার্স ও একেবারে হ্যাংলা পাতলা এক ডাক্তার যখন রোগীকে নিয়মিত চেকআপ করতে কেবিনে ডুকলেন তখন রোগী কল্পনা করছে মোটা নার্সটি ইংরেজী “o" সংখ্যা এবং ডাক্তারটি ইংরেজী "1" সংখ্যা এবং দুজনে মিলে হচ্ছে ইংরেজী "10" সংখ্যা। 10 সংখ্যার সাথে যদিও কোন সংযোগ নেই রোগীর কিন্তু তারপরেও এরকম কত অদ্ভুত কল্পনা যে মানুষ করতে পারে তা আমি স্যারের অনেক উপন্যাসে দেখেছি। আর তাঁর বেশীরভাগ উপন্যাস, নাটক বা চলচ্চিত্রে যে কাজটি তিনি সব সময় করে গেছেন তা হলো - তিনি কোন না কোন চরিত্রের মাধ্যমে আমরা সাধারণ মানুষের জন্য কোন না কোন ম্যাসেজ রেখে গেছেন। একটা উপন্যাস পড়লাম কয়েকদিন আগে । উপন্যাসে এক জায়গায় দেখা যাচ্ছে একজন রিক্সাচালক বলছে মেয়ে মানুষ খারাপ কারণ ওদের জন্য এ পৃথিবীতে আসতে হয়েছে মানুষকে । তখনই উপন্যাসের মুল চরিত্রের মাধ্যমে লেখক বলছেন, যে মেয়েদের জন্য আমরা এ পৃথিবীতে এসেছি স্বর্গ থেকে সুতরাং সে মেয়েরাই পারে আমাদের স্বর্গে ফিরিয়ে নিতে। আসলে এরকম হাজার হাজার মুল্যবান কথা তিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেছেন তাঁর সকল রচনার মাঝে।
স্যারের নির্মিত অনেকগুলো হাস্যরসাত্মক নাটক দেখেছি আমি। তাছাড়া কয়েকটি ছায়াছবি দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে। ”শ্রাবণ মেঘের দিন”, “আগুনের পরশমনি” ও “শ্যামল ছায়া” আমার অনেক ভালো লাগা ছায়াছবির মধ্যে অন্যতম। রঙরসিকতায় পূর্ণ তাঁর নাটকগুলোর মাঝেও ছিল আমাদের জন্য কিছু না কিছু মূল্যবান কথা যা আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। “চোর” নাটকে দেখেছিলাম একটি ছোট মেয়ে ভাত খাচ্ছে এবং কিছু ভাত প্লেটের বাহিরে পড়েছে তখন তার মা এসে বলছে, ”ভাত ফেলছিস কেন, জানিস না একটা ভাতের সাথে ৭০ জন্য ফেরেস্তা থাকেন।” আমি অবাক হলাম এই ভেবে যে, প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের অনেক খুটিনাটি কথা বা ঘটনাও স্যারের দৃষ্টি এড়ায়নি, উঠে এসেছে তাঁর সৃষ্টিতে। স্যার নিজেও বলেছেন যে, তিনি চেষ্টা করেছেন তাঁর নাটক, চলচ্চিত্র বা উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি আমাদের সামাজিক ব্যাধিগুলোকে সারাতে। নিছক আনন্দ দেয়ার জন্য যেসব নাটক নির্মাণ করেছেন সেগুলো সম্পর্কে তিনি বলেও দিয়েছিলেন যে এসব নাটকে কোন ম্যাসেজ নেই শুধু’ই আনন্দ দেয়ার জন্য নির্মাণ করা এসব নাটক - এরকমই একটি নাটক “ যমুনার জল দেখতে কালা” । তিনিই বাংলাদেশের নাটকে কৃত্তিমতা দূর করেছিলেন; যোগ করেছিলেন বাস্তবতার সংলাপ। আর তাই বাংলা নাটক-সিনেমার পুরোটা জুড়েই উড়ে বেড়াবেন তিনি। তাঁর এই উড়ে বেড়ানো চলবে শত বছর-সহস্র বছর; ঠিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কবি নজরুল আর জীবনানন্দের পথ ধরে।
ঔপন্যাসিক হিসাবে তিনি কতটা খ্যাতিমান এবং সফল তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না । কিন্তু চিত্রপরিচালনায়ও যে তিনি সমভাবে সুনিপুণ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তা বলা বাহুল্য। চিত্রপরিচালক সত্যজিত রায়ের সাথে তাঁর তুলনা করার দুঃসাহস আমার নেই কিন্তু একটি কথা আমি না বলে থাকতে পারছিনা । আমি তাঁর চিত্র পরিচালনার মাঝে সত্যজিৎ রায়ের ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। প্রতি বৎসর দুই বংলায় শত শত চলচ্চিত্র মুক্তি পাচ্ছে। এ সকল চলচ্চিত্র শুধুই ব্যবসার জন্য। কিন্তু হুমায়ূন স্যার চিত্র নির্মাণ করেছেন শিল্পীর হিসাবে সৃষ্টির জন্য যা সত্যজিৎ রায় করতেন। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবি আগুনের পরশমনি এমনভাবে তৈরী করেছেন যে, ছায়াছবি দেখার সময় মনে হয়েছে যে আমরা একাত্তরের সে উত্তাল সময়ে ফিরে গিয়েছি এবং ছবিটি ঐ সময় চিত্রায়ন করা ; এতো সুক্ষভাবে তিনি ঐ সময়টাকে ধরে রেখেছিলেন । আমি যদিও কোন চলচ্চিত্র সমালোচক নই তাই হয়তো জানিনা কারিগরি দিক থেকে তাঁর ছবিগুলো কতটুকু সফল হয়েছে কিন্তু সাধারণ দর্শক হিসাবে আমার কাছে তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্র পারফেক্ট মনে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্র আগুনের পরশমনি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ঢল নেমেছিল। মাসের পর মাস ধরে এই চলচ্চিত্রটি বক্স অফিস দখল করে রেখেছিল। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল এই ছবিটি। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র 'শ্যামল ছায়া' বিদেশী ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তাঁর অন্য কীর্তি 'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'দুই দুয়ারী','চন্দ্রকথা' প্রভৃতি চলচ্চিত্রগুলি কেবল সুধীজনের প্রশংসাই পায়নি, মধ্যবিত্ত দর্শকদেরও হলমুখী করেছে বহুদিন পর।
আসলে হুমায়ূন স্যারকে কেন ভালো লাগে এ প্রশ্নের উত্তর সামান্য কিছু লিখে দেয়া সম্ভব নয় । তাঁর কর্মময় জীবনের প্রতিটি বিষয় ছিল অনুকরণীয়। গাজীপুর জেলার অদূরে গজারী আর শালবৃক্ষে ঘেরা ঘন অরণ্যের ভিতর তাঁরই স্বপ্নের একটি বাস্তবরূপ “নুহাশ পল্লী”। ৪০ বিঘা জমির উপরে তৈরী এ নুহাশ পল্লী যেন এক স্বপ্নপুরী। ছবির মতো সাজিয়েছেন জায়গাটিকে তিনি। নানা জাতের গাছপালা ও পশুপাখিদের উপস্থিতিতে মুখর নুহাশ পল্লী যেন কোন শিল্পীর আঁকা একটি ল্যান্ডস্কেপ। তাঁর খুবই প্রিয় জায়গা ছিল এটি এবং তাঁর বেশীর ভাগ নাটকের চিত্রায়ন হযেছে সেখানে। তিনি পূর্ণিমা পছন্দ করতেন খুব এমনটি তাঁর লেখা থেকে জানা যায়। জানা গেছে তিনি না’কি প্রায়েই পূর্ণিমার সময় সপরিবারে নুহাশ পল্লীতে অবস্থান করতেন এবং জোৎস্না রাত উপভোগ করতেন । নুহাশ পল্লীর বিশেষত্ব হচ্ছে তিনি সেখানে প্রায় ৩০০ প্রজাতির ঔষধি গাছ লাগিয়েছেন এবং উদ্দেশ্য একটাই ছিল - যদি তা মানুষের উপকারে লাগে। তাঁকে যেন নূহাশ পল্লীতে দাফন করা হয় এমনি শেষ ইচ্ছা না’কি তিনি মৃত্যুর আগে করে গেছেন।
৬৪ বছর বয়স খুব বেশী নয়। তুলনামুলকভাবে খুব কম সময়ে তিনি চলে গেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন এক বিশাল শুন্যতা বাংলা সাহিত্য জগৎে যে শুন্যতা আর কখনো পূরণ হবে না । বিষাদবিধূর তাঁর এ যাওয়া মেনে নেয়া কষ্টকর কারণ আমরা এভাবে চাইনি । তারপরেও প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে চলে যেতে হবে বলে তিনি চলে গেছেন আর রেখে গেছেন আমাদের জন্য অজস্র কথা আর বাণীর সম্ভার। আমাদের স্মৃতি জুড়ে তিনি থাকবেন আজীবন। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটি কবিতার শেষ দু’টি লাইন এ মুহুর্তে মনে পড়লো আমার -
”চলে যাওয়া মানেই নয় বন্ধন ছিন্ন করা আর্দ্র রজনী।
চলে গেলে আমারো অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না থাকা জুড়ে। “
তিনি চলে গেলেও যা রেখে গেছেন পেছনে তাতেই তাঁর না থাকা জুড়ে তিনি থাকবেন আরো গভীরভাবে, আমাদের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। নন্দিত নরকে নয় নন্দিত স্বর্গে হোক তাঁর স্থান এ কামনা করছি সব সময়।
(মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন)
স্যারের নির্মিত অনেকগুলো হাস্যরসাত্মক নাটক দেখেছি আমি। তাছাড়া কয়েকটি ছায়াছবি দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে। ”শ্রাবণ মেঘের দিন”, “আগুনের পরশমনি” ও “শ্যামল ছায়া” আমার অনেক ভালো লাগা ছায়াছবির মধ্যে অন্যতম। রঙরসিকতায় পূর্ণ তাঁর নাটকগুলোর মাঝেও ছিল আমাদের জন্য কিছু না কিছু মূল্যবান কথা যা আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। “চোর” নাটকে দেখেছিলাম একটি ছোট মেয়ে ভাত খাচ্ছে এবং কিছু ভাত প্লেটের বাহিরে পড়েছে তখন তার মা এসে বলছে, ”ভাত ফেলছিস কেন, জানিস না একটা ভাতের সাথে ৭০ জন্য ফেরেস্তা থাকেন।” আমি অবাক হলাম এই ভেবে যে, প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের অনেক খুটিনাটি কথা বা ঘটনাও স্যারের দৃষ্টি এড়ায়নি, উঠে এসেছে তাঁর সৃষ্টিতে। স্যার নিজেও বলেছেন যে, তিনি চেষ্টা করেছেন তাঁর নাটক, চলচ্চিত্র বা উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি আমাদের সামাজিক ব্যাধিগুলোকে সারাতে। নিছক আনন্দ দেয়ার জন্য যেসব নাটক নির্মাণ করেছেন সেগুলো সম্পর্কে তিনি বলেও দিয়েছিলেন যে এসব নাটকে কোন ম্যাসেজ নেই শুধু’ই আনন্দ দেয়ার জন্য নির্মাণ করা এসব নাটক - এরকমই একটি নাটক “ যমুনার জল দেখতে কালা” । তিনিই বাংলাদেশের নাটকে কৃত্তিমতা দূর করেছিলেন; যোগ করেছিলেন বাস্তবতার সংলাপ। আর তাই বাংলা নাটক-সিনেমার পুরোটা জুড়েই উড়ে বেড়াবেন তিনি। তাঁর এই উড়ে বেড়ানো চলবে শত বছর-সহস্র বছর; ঠিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কবি নজরুল আর জীবনানন্দের পথ ধরে।
ঔপন্যাসিক হিসাবে তিনি কতটা খ্যাতিমান এবং সফল তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না । কিন্তু চিত্রপরিচালনায়ও যে তিনি সমভাবে সুনিপুণ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তা বলা বাহুল্য। চিত্রপরিচালক সত্যজিত রায়ের সাথে তাঁর তুলনা করার দুঃসাহস আমার নেই কিন্তু একটি কথা আমি না বলে থাকতে পারছিনা । আমি তাঁর চিত্র পরিচালনার মাঝে সত্যজিৎ রায়ের ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। প্রতি বৎসর দুই বংলায় শত শত চলচ্চিত্র মুক্তি পাচ্ছে। এ সকল চলচ্চিত্র শুধুই ব্যবসার জন্য। কিন্তু হুমায়ূন স্যার চিত্র নির্মাণ করেছেন শিল্পীর হিসাবে সৃষ্টির জন্য যা সত্যজিৎ রায় করতেন। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবি আগুনের পরশমনি এমনভাবে তৈরী করেছেন যে, ছায়াছবি দেখার সময় মনে হয়েছে যে আমরা একাত্তরের সে উত্তাল সময়ে ফিরে গিয়েছি এবং ছবিটি ঐ সময় চিত্রায়ন করা ; এতো সুক্ষভাবে তিনি ঐ সময়টাকে ধরে রেখেছিলেন । আমি যদিও কোন চলচ্চিত্র সমালোচক নই তাই হয়তো জানিনা কারিগরি দিক থেকে তাঁর ছবিগুলো কতটুকু সফল হয়েছে কিন্তু সাধারণ দর্শক হিসাবে আমার কাছে তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্র পারফেক্ট মনে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্র আগুনের পরশমনি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ঢল নেমেছিল। মাসের পর মাস ধরে এই চলচ্চিত্রটি বক্স অফিস দখল করে রেখেছিল। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল এই ছবিটি। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র 'শ্যামল ছায়া' বিদেশী ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তাঁর অন্য কীর্তি 'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'দুই দুয়ারী','চন্দ্রকথা' প্রভৃতি চলচ্চিত্রগুলি কেবল সুধীজনের প্রশংসাই পায়নি, মধ্যবিত্ত দর্শকদেরও হলমুখী করেছে বহুদিন পর।
আসলে হুমায়ূন স্যারকে কেন ভালো লাগে এ প্রশ্নের উত্তর সামান্য কিছু লিখে দেয়া সম্ভব নয় । তাঁর কর্মময় জীবনের প্রতিটি বিষয় ছিল অনুকরণীয়। গাজীপুর জেলার অদূরে গজারী আর শালবৃক্ষে ঘেরা ঘন অরণ্যের ভিতর তাঁরই স্বপ্নের একটি বাস্তবরূপ “নুহাশ পল্লী”। ৪০ বিঘা জমির উপরে তৈরী এ নুহাশ পল্লী যেন এক স্বপ্নপুরী। ছবির মতো সাজিয়েছেন জায়গাটিকে তিনি। নানা জাতের গাছপালা ও পশুপাখিদের উপস্থিতিতে মুখর নুহাশ পল্লী যেন কোন শিল্পীর আঁকা একটি ল্যান্ডস্কেপ। তাঁর খুবই প্রিয় জায়গা ছিল এটি এবং তাঁর বেশীর ভাগ নাটকের চিত্রায়ন হযেছে সেখানে। তিনি পূর্ণিমা পছন্দ করতেন খুব এমনটি তাঁর লেখা থেকে জানা যায়। জানা গেছে তিনি না’কি প্রায়েই পূর্ণিমার সময় সপরিবারে নুহাশ পল্লীতে অবস্থান করতেন এবং জোৎস্না রাত উপভোগ করতেন । নুহাশ পল্লীর বিশেষত্ব হচ্ছে তিনি সেখানে প্রায় ৩০০ প্রজাতির ঔষধি গাছ লাগিয়েছেন এবং উদ্দেশ্য একটাই ছিল - যদি তা মানুষের উপকারে লাগে। তাঁকে যেন নূহাশ পল্লীতে দাফন করা হয় এমনি শেষ ইচ্ছা না’কি তিনি মৃত্যুর আগে করে গেছেন।
৬৪ বছর বয়স খুব বেশী নয়। তুলনামুলকভাবে খুব কম সময়ে তিনি চলে গেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন এক বিশাল শুন্যতা বাংলা সাহিত্য জগৎে যে শুন্যতা আর কখনো পূরণ হবে না । বিষাদবিধূর তাঁর এ যাওয়া মেনে নেয়া কষ্টকর কারণ আমরা এভাবে চাইনি । তারপরেও প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে চলে যেতে হবে বলে তিনি চলে গেছেন আর রেখে গেছেন আমাদের জন্য অজস্র কথা আর বাণীর সম্ভার। আমাদের স্মৃতি জুড়ে তিনি থাকবেন আজীবন। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটি কবিতার শেষ দু’টি লাইন এ মুহুর্তে মনে পড়লো আমার -
”চলে যাওয়া মানেই নয় বন্ধন ছিন্ন করা আর্দ্র রজনী।
চলে গেলে আমারো অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না থাকা জুড়ে। “
তিনি চলে গেলেও যা রেখে গেছেন পেছনে তাতেই তাঁর না থাকা জুড়ে তিনি থাকবেন আরো গভীরভাবে, আমাদের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। নন্দিত নরকে নয় নন্দিত স্বর্গে হোক তাঁর স্থান এ কামনা করছি সব সময়।
(মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন)