|
কবি ও প্রেম
কবিদের দৃষ্টিতে প্রেম প্রসঙ্গে এবারে কবি আবু হাসান শাহরিয়ার-এর চিন্তাভাবনা উদ্ধৃত করা হলো -
যদিও বোধের সঙ্গে মনের নিবিড় বসবাস, তথাপি কখনো কখনো বোধ হয়ে উঠে প্রমত্ত এক নদী । অথবা তুমুল বর্ষণ । তখন বানভাসি মনের যে দুরবস্থা - তারই নাম হয়তো প্রেম। এক জীবনে একজন মানুষ এক বা একাধিকবার এই অবস্থার মুখোমুখী হতে পারে । তবে নির্বোধদের কথা আলাদা । বোধের তীব্রতাকে আমি ‘কষ্টানন্দ’ নামে চিনি। আনন্দের চেয়ে কষ্টের তীক্ষ্ণতাই সেখানে প্রকট। এ বিষয়ে জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত পঙক্তিদ্বয়ের তুলনা হয়না - ‘........ কে হায় হৃদয় খুঁড়ে/বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ এই বেদনাকে ঘটা করে জাগাতে হয় না । যখন তার ঘুম ভাঙবার, আপনা থেকেই ভাঙে সে ঘুম । তখন জীবনের আর সব আয়োজন মিথ্যে হয়ে যায়। সব পথে এসে জড়ো হয় এক নতুন পথের নান্দীমুখে । সেই পথের নারী আমার একজনাই । শত-সহস্র নারীকে জড়ো করে আমি একমাত্র নারীটিকে গড়তে চাই । আবার তাকেই বিভক্ত করি শত-সহস্রে । এর কোনও শুরু ও শেষ নেই - অনিঃশেষ পথে সে এক নিরন্তর ভ্রমণ । জীবনের বারো ভাজা, তেরো ভাজা ছত্রিশ ভাজা পথের সঙ্গে এর তুলনা অচল । আর তাই বোধের প্রতিবেশী হয়েও মন তার কখনো নাগাল পায় না । প্রথাসিদ্ধ মন সমাজমনস্কতার দায়ে সব দরজা-জানালা সপাটে বন্ধ করে দিতে পারে । বোধ তা পারে না । পারে না বলেই বোধে যারা ছিল যারা আছে যারা আসন্ন - তাদের সবার কাছে আমি আজন্ম ঋণী । হয় তো বা ঋণখেলাপীও। আদ্যোপান্ত তুমি আমার বহুল পাঠে মুখস্থ এক কাব্যগ্রন্থ - তোমার প্রতি পঙক্তি আমি পাঠ করেছি মগ্ন হয়ে । বই কখনো ধার দিতে নেই, জেনেও আমি দিয়েছিলাম - খুইয়েছি তাই । ছিঁচকে পাঠক হলেও তোমার গ্রন্থস্বত্ব এখন তারই । বই চোরা কি কাব্যরসিক ? ছন্দ জানে ? বই অনেকের বাতিক, ঘরে সাজিয়ে রাখে- নাকি তেমন হদ্দ নবিশ ? চোরের ঘরে ধুলোয় মলিন বুকশেলফে কেমন আছো ? চোর কি জানে, চোর কি জানতো, আমি তোমায় মুখস্থ পাই আদ্যোপান্ত ? (চলবে) আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই ...কাজী নজরুল ইসলাম
'ফুল যদি কোথাও ফোটে, আলো যদি কোথাও হাসে, সেখানে আমার গান গাওয়া শোভা পায়, গান গাই। সেই আলো, সেই ফুল পেয়েছিলাম এবার চট্টলায়, তাই গেয়েছি গান।' চট্টগ্রামকে নিয়ে ১৯২৬ সালে এই আবেগ উদ্বেলিত চিঠি লিখেছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সেটি ছিল কবির প্রথম চট্টগ্রাম আগমন। সেই আগমন কবিকে দিয়েছিল সীমাহীন আনন্দ। যার প্রকাশ দেখা যায় কবি হাবিবুল্লাহ বাহারের বোন কবি শামসুনন্নাহারকে লেখা কবির এই চিঠিতে।
১৯২৬ সালে কবির সেই আগমনে চট্টগ্রামের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজে কবিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, সংবর্ধনা দেওয়া হয় জেএমসেন স্কুলে। সেই সময়ে তিনি যান আন্দরকিল্লা জামে মসজিদে, যেখানে কবিকে উপাধি দেওয়া হয় মালিক-উশ-শোআরা বা কবি সম্রাট। ১৯২৬ ও ১৯২৯ সালে কবি মুসলিম হলে দু'বার বক্তৃতা দেন। এখানে কবিকে মুসলমানদের নেতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এবং ১৯২৬ সালেই চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পাহাড় দেখে কবি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গান 'আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই...'। এসব জায়গার কোথাও কবির স্মৃতির কোনো অস্তিত্ব নেই। চট্টগ্রামে কবি বার বার এলেও কবিকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি এখানে। চট্টগ্রামে একমাত্র কাজটি হয়েছে কবির নামে দেশের প্রথম সড়ক নামকরণ। সিডিএ ভবন থেকে ফিরিঙ্গি বাজারের ভেতর দিয়ে কর্ণফুলী নদী হয়ে সদরঘাট পর্যন্ত এই সড়কের নাম কাজী নজরুল ইসলাম সড়ক। এই পথ দিয়েই কবি কর্ণফুলীতে গিয়েছিলেন এবং লিখেছিলেন একটি দীর্ঘ কবিতা 'কর্ণফুলী'। 'ওগো ও কর্ণফুলী/ তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কান-ফুল খুলি?' সেবার চট্টগ্রাম এসে কবি প্রথম রাত্রিযাপন করেন ডিসি হিলের ডাক বাংলোতে। কবি আসেন বন্ধু হাবিবুল্লাহ বাহারের আমন্ত্রণে। কিন্তু কবির স্মৃতিঘেরা সেই বাংলো ১৯৯৯ সালে ভেঙে গড়ে তোলা হয়েছে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ কামাল উদ্দীন বলেন, '২০০৩ সাল থেকে আমরা ডিসি হিলে জাতীয় কবির নামে 'নজরুল স্কয়ার' করার আন্দোলন করে আসছি। যা ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হলেও সরকারিভাবে এখনো মানা হচ্ছে না। এটা সবার জন্য অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। তাছাড়া জাতীয়ভাবে এখনো নজরুলকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু হয়নি। নজরুলের জন্মবার্ষিকী আসছে। কিন্তু এই চট্টগ্রামে বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। এ কাজে সরকারের সহযোগিতাও অনেক বেশি প্রয়োজন।' কামাল উদ্দীন আরো বলেন, 'আমরা সীতাকুণ্ড ইকো পার্ককে কবি নজরুল ইকো পার্ক করার দাবি জানাচ্ছি দীর্ঘদিন ধরে। এছাড়া পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে কবির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য স্মৃতিফলক করতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা কামনা করছি।' দ্বিতীয়বার কবি চট্টগ্রাম এসে ১৯২৯ সালে প্রায় মাসখানেক অবস্থান করেন। তখন তিনি কাট্টলী চৌধুরী পরিবার, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, আজিজ মঞ্জিল, ফতেয়াবাদ আলম পরিবার, সন্দ্বীপে কমরেড মোজাফফর আহমদের বাড়িতে বেড়াতে যান। সন্দ্বীপের কাহিনী নিয়ে কবি রচনা করেন তাঁর 'মধুমালা' নাটকটি। তৃতীয়বার আসেন ১১৩২ সাল মতান্তরে ১৯৩৩ সালে। সেসময় কবি যোগদান করেন রাউজান তরুণ কনফারেন্স ও শিক্ষা সম্মিলনীতে। এবং এখানেই প্রথম দর্শকরা টিকেট কেটে কবিকে দেখতে আসেন। অনুষ্ঠান শেষে কবি রাত কাটান জলিল নগরের হাজী বাড়িতে। যে বাড়িটি কবির স্মৃতির সম্মানার্থে এখনো অবিকৃত রেখে দিয়েছেন বাড়ির উত্তরসূরিরা। কবির স্মৃতিঘেরা অন্যতম অংশ চট্টগ্রামে আজিজ মঞ্জিল। যার বর্তমান অবস্থান হকার্স মার্কেট, তামাকুমণ্ডি লেন। এখানে বসেই তিনি রচনা করেন 'বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি', 'সিন্ধু হিন্দোল'। কিন্তু এই আজিজ মঞ্জিল ভেঙে সেখানে এখন নির্মিত হয়েছে আজিজ মার্কেট। এছাড়া চট্টগ্রামে কবি আরো লিখেছেন চক্রবাক, শীতের সিন্ধু, শিশু যাদুকর, সাতভাই চম্পার অধিকাংশ কবিতা, তোমায় কোলে তুলে আমি নামিলাম জলেসহ ইত্যাদি স্মরণীয় গান ও কবিতা। ............ শিউলী শবনম (সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ) নোবেলবিজয়ী ল্য ক্লেজিওধরুন, আপনি আগামীকাল সাহিত্যের জন্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আপনি কী বলবেন?’ এরকমই এক প্রশ্ন করা হয়েছিল ল্য ক্লেজিওকে, ২০০১ সালে, লেবেল ফ্রান্স পত্রিকার পক্ষ থেকে। তার পুরো নাম জাঁ-মেরিয়ে গুস্তাভ ল্য ক্লেজিও। সাহিত্যের চটকদার বাণিজ্যিক বাজারে তার পরিচিতি তেমন উজ্জ্বল নয় তখনও। বিশেষত আমেরিকানরা পছন্দ করে না তাকে। তা সত্ত্বেও তার নাম ততদিনে সম্ভাব্য নোবেলবিজয়ীদের তালিকায়। সুতরাং প্রশ্নটি আগাম হলেও তার প্রাসঙ্গিকতা ছিল। এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন:‘...আমি নোবেল পুরস্কার পাব কিনা জানি না, কিন্তু এটা জানি জনসমক্ষে আমি কী বলতে পছন্দ করব। আমি যুদ্ধের কথা বলতে চাইব যা শিশুদের হত্যা করছে। এটা, আমার কাছে, আমাদের সময়কার সবচেয়ে মর্মান্তিক জিনিস। সাহিত্যও এই ট্রাজিডি সম্পর্কে জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং এটাকে কেন্দ্রীয় মঞ্চে ফিরিয়ে আনার অন্যতম মাধ্যম হতে পারে। ...আমাদের উচিত হবে সকল শিশুমূর্তির হূিপণ্ডের ওপর লাল দাগ এঁকে দেয়া এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে যে, প্রতিটি মুহূর্তে ফিলিস্তিন, দক্ষিণ আমেরিকা অথবা আফ্রিকার কোনোখানে বুলেটবিদ্ধ করে শিশু হত্যা করা হচ্ছে। লোকেরা এসব নিয়ে কখনো কথা বলে না!’ এর সাত বছরের মাথায় তিনি সত্যি-সত্যিই নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন। যাদের কথা কেউ লেখে না তাদের কথা লিখেই তিনি এই পুরস্কার জয় করেন। ল্য ক্লেজিও ২০০৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তারপর থেকে তিনি বিশ্বব্যাপী চর্চিত হচ্ছেন। কিন্তু তিনি কে? কোন দেশের মানুষ? এ-ও এক প্রশ্ন বটে। তাকে ফরাশী হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়, যদিও তাকে কোনও একটা বিশেষ দেশ বা জাতীয়তার সঙ্গে যুক্ত করা বেশ কঠিন, এবং বিভ্রান্তিকরও বটে। নিজের জাতীয়তার প্রশ্নে তিনি নিজেও, তার পাঠক-সমালোচকদের মতই, বেশ বিভ্রান্ত। তিনি বলেন: ‘আমি নিজেকে নির্বাসিত বলে বিবেচনা করি, কারণ, আমার পরিবার পুরোপুরি মরিশাসীয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আমরা মরিশাসীয় লোকসাহিত্য, খাদ্য, লৌকিক উপাখ্যান এবং সংস্কৃতি ভোগ করেছি। এটা খুবই মিশ্র সংস্কৃতি, ভারত, আফ্রিকা এবং ইয়োরোপের সংমিশ্রণ। আমি ফ্রান্সে জন্মেছি এবং বড় হয়েছি ফ্রান্সেই, সে দেশের সংস্কৃতির মধ্যে। আমি বড় হয়েছি নিজেকে এ কথা বলতে বলতে যে, এমন কোনো জায়গা আছে যা আমার সত্যিকারের মাতৃভূমি। একদিন সেখানে যাব আমি, এবং জানব কী রকম সেটা। সুতরাং, ফ্রান্সে, আমি সব সময় নিজেকে কিছুটা ‘বহিরাগত’ মনে করতাম। অন্য দিকে, আমি ফরাশী ভাষাকে ভালবাসতাম যা সম্ভবত আমার সত্যিকারের দেশ! কিন্তু একটা জাতি হিসেবে ফ্রান্সের চিন্তাকে, আমাকে অবশ্যই বলতে হবে যে, আমি কদাচিত্ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শনাক্ত করেছি।’ তার পরিচয়ের মত তার সাহিত্যকৃতিও ব্যতিক্রমী। নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করতে গিয়ে সুইডিশ একাডেমি তার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছে তা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য— ‘তিনি লেখক পরিবর্তমান আঙ্গিক, কাব্যিক অভিযাত্রা এবং ইন্দ্রিয়পরায়ণ উন্মাদনার।’ এরপর আরো যা বলা হয়েছে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা তার সম্পর্কে, সেটা হলো— ‘তিনি আধিপত্যবান সভ্যতার উর্ধে এবং নিচে অন্য এক সভ্যতার আবিষ্কারক।’ ল্য ক্লেজিও ফরাশী সাহিত্য-ভূমিতে এক অনন্য অবস্থান অধিকার করেছেন। একই সঙ্গে ফরাশী ও মরিশাসীয় সংস্কৃতির ধারক তিনি, বেড়ে উঠেছেন ফরাশী সংস্কৃতি এবং এ্যাংলো-স্যাক্সন সাহিত্যের সূক্ষ্ম সমঝদারদের মধ্যে, কিন্তু এই প্রচলিত ধারার সমর্থক হননি। এই বিদ্রোহী ঔপন্যাসিক তার অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন লঁত্রেমন্ত ও জোলার কাছ থেকে যেমন, তেমনই স্টিভেনসন ও জয়েসের কাছ থেকেও। তাকে সংজ্ঞায়িত করা, কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বিবেচনা করা, সব সময়ই কঠিন। তাকে অতীন্দ্রিয়বাদী, দার্শনিক, এবং এমনকি পরিবেশবাদী হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এ ব্যাপারে তার নিজের বক্তব্য হলো: ‘আপনি নিজে কী করেন নিজে তার বর্ণনা দেয়া কঠিন। আপনি যদি আমাকে আমার বইগুলোর মূল্যায়ন করতে বলেন তাহলে আমি বলব সেগুলো প্রায় আমারই মত। অন্য কথায়, আমি কী এবং আমি কিসে বিশ্বাস রাখি তার তুলনায় ভাব প্রকাশের ব্যাপারটা আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। যখন আমি লিখি আমি প্রথমত চেষ্টা করি প্রত্যেকটা দিন, প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে আমার সম্পর্ককে অনুবাদ করতে। আমরা একটা দুর্যোগপূর্ণ যুগে বাস করছি যেখানে ভাব এবং ভাবমূর্তির বিশৃঙ্খলার বোমা দ্বারা আমরা আক্রান্ত হচ্ছি। আজকাল সাহিত্যের ভূমিকা হচ্ছে সম্ভবত এই অরাজকতার প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করা। ...সার্ত্র-র যুগে যেমনটি করা হতো, আমরা তেমন দুঃসাহসিকভাবে এ কথা এখন আর বিশ্বাস করতে পারি না যে, উপন্যাস পৃথিবীটাকে বদলে দিতে পারে। আজকাল, লেখকরা কেবল পারে তাদের রাজনৈতিক দীনতার দলিল তৈরি করতে। যখন আপনি সার্ত্র, কামু, দস প্যাসস অথবা স্টেইনবেক পড়বেন তখন আপনি পরিষ্কার দেখতে পাবেন যে, এই মহান অঙ্গীকারবদ্ধ লেখকদের অসীম আস্থা ছিল মানব জাতির ভবিষ্যত এবং লিখিত জগতের শক্তির ওপর। আমার স্মরণ হয়, যখন আমার বয়স ছিল আঠার, আমি সার্ত্র, কামু এবং মরিয়াক-এর সম্পাদকীয় পড়তাম লা’এক্সপ্রেস-এ। সেগুলো ছিল অঙ্গীকারসম্পন্ন প্রবন্ধ যা পথ দেখাত। এখন কি কেউ প্রত্যয়ের সাথে এ কথা কল্পনা করতে পারে যে আমাদের জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান করে দিতে পারে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়? সমকালীন সাহিত্য হচ্ছে হতাশার সাহিত্য।’ ল্য ক্লেজিও-র লেখা একই সঙ্গে স্পষ্ট এবং গভীর, ইঙ্গিতময় এবং সংযমী, অতীতচারী এবং সমকালীন। তার প্রিয় দুজন লেখক হচ্ছেন স্টিভেনসন এবং জয়েস। বলা বাহুল্য যে, দুজনই নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন। ক্লেজিও-র নায়করাও প্রায়ই নিঃসঙ্গ, তারা আধুনিক জীবন ও প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে, অথবা নাগরিক প্রতিবেশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সত্ত্বেও এই ধীমান লেখক নিজেকে কেতা-দুরস্ত সাহিত্যিক চক্র থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। ১৯৬৫ সালে লেখা এক নিবন্ধে তিনি বলেন, ‘আমি এখনও নিশ্চিত নই লেখা ভাব প্রকাশের ভাল উপায় কিনা।’ ঔপন্যাসিক হিসেবে ল্য ক্লেজিও-র যাত্রা শুরু যৌবনের প্রারম্ভেই, মাত্র তেইশ বছর বয়সে। কিন্তু তার বিজয় যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০ সালে ডেজার্ট প্রকাশিত হবার পর। এই বইটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সুইডিশ একাডেমি বলেছে: ‘উত্তর আফ্রিকার মরুভূমির একটি লুপ্ত সংস্কৃতির চমত্কার ছবি এটা’। আধুনিক ও সমকালীন ফরাশী সাহিত্যিকদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই সেই সৌভাগ্যবান যার লেখা সবচেয়ে বেশি অনূদিত হয়েছে। তবে ইংরেজী পাঠকদের কাছে তিনি খুব বেশি পরিচিত ছিলেন না। সে কারণে নোবেল বিজেতা হিসেবে তার নাম ঘোষিত হওয়ায় প্রথমে অনেকেই, বিশেষত বৃটেন ও আমেরিকায়, দারুণ অবাক হয়েছেন। তার লেখার দুর্বোধ্যতা, নিরীক্ষাপ্রবণতা এবং অপরিচিত-অপাংক্তেয় বিষয়ভাবনার কারণে লেখকজীবনের শুরুতেই তিনি ‘আভা-গার্দে’ লেখকের পরিচয়ে অভিষিক্ত হন। তার লেখার বিষয় প্রায় সব সময়ই আন্তঃসাংস্কৃতিক। তিনি মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়ে বেড়ান সবখানে, যেখানে ইচ্ছা সেখানে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে, অবাধে, আর ভিন্ন ভিন্ন সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে আহরণ করেন বিষয়ভাবনা, ঘটনা, জীবনের নানা রকম ছবি ও প্রতীক, এবং সেগুলোকে মিশ্রিত করে গড়ে তোলেন নিজস্ব কীর্তি যা হয়ে ওঠে সব দিক থেকে স্বতন্ত্র পূর্বজ ও সমকালীন লেখকদের থেকে। ল্য ক্লেজিও-র জন্ম ১৯৪০ সালের ১৩ই এপ্রিল ফ্রান্সের নাইস-এ। তার পিতা একজন চিকিত্সক ছিলেন। তিনি মরিশাস-এ জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান এবং সেখান থেকে প্রথমে গায়ানা, তারপরে নাইজেরিয়া চলে যান। তিনি অনেক কাল আফ্রিকাতেই ছিলেন। এ কারণে পরিবারটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ল্য ক্লেজিও বেড়ে ওঠেন ফ্রান্সেই। তার শৈশব কাটে রকেবিলিয়ের নামক একটি ছোট্ট নিরিবিলি গ্রামে। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। আর ভালবাসতেন কমিক্স পড়তে। ১৯৪৭ সালে তিনি মা ও ভায়ের সঙ্গে নাইজেরিয়া পাড়ি দেন, মিলিত হন পিতার সঙ্গে। তার বিখ্যাত উপন্যাস অনিত্সায় তিনি তার এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন। সেখানে দেখানো হয়েছে একজন তরুণ তার মাকে নিয়ে আফ্রিকার উদ্দেশে নৌকা ভাসিয়েছে, লক্ষ্য তার পিতার কাছে যাওয়া, যিনি সেখানে তার নিজের স্বপ্ন নিয়ে মশগুল। তার স্কুলের লেখাপড়া নাইস-এই, সেখানে তার মা স্থায়ী হয়েছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। ১৯৫৭ সালে ল্য ক্লেজিও সাহিত্য ও দর্শনে ব্যাচেলর ডিগ্রী পান। তারপর তিনি ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটিতে এবং নাইস-এর ইন্সতিতুত দ্য’এতুদেস্ লিতারেয়ার্স-এ উচ্চতর শিক্ষা নেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি এইক্স-এন-প্রোভেন্স থেকে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। ল্য ক্লেজিও বিয়ে করেন ১৯৬০ সালে, রোজেলি পিকুমাল তার স্ত্রীর নাম। তিনি ছিলেন অর্ধেক ফরাশী অর্ধেক পোলিশ। তাদের এক কন্যা সন্তান হয়। এ বিয়ে অবশ্য টেকেনি। পরে তিনি আরেকটি বিয়ে করেন। সেই পক্ষেও তার একটি কন্যা সন্তান আছে। লেখক হিসেবে ল্য ক্লেজিও-র যাত্রা শুরু ১৯৬৩ সালে, লা প্রসেস-ভারবাল উপন্যাসের মাধ্যমে। এই বইটির জন্যে তিনি থিওফ্রাস্তে রেনদ্যঁ প্রাইজ পান। এই উপন্যাসের মূল থিম হচ্ছে সাধারণভাবে গৃহীত চিন্তাপদ্ধতি থেকে মনের চরমতম অবস্থায় উপনীত হওয়া। এর নায়ক এডাম পোলো একজন স্পর্শকাতর তরুণ, সে শহরে চারদিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ায়, অনেকটা রাস্তার কুকুরের মত। অনাগ্রহী জনতার সামনে উত্তেজক বক্তৃতা দেওয়ার পর তাকে শেষ পর্যন্ত একটি মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। আলবেয়ার কামু-র স্ট্রেঞ্জার এবং জাঁ পল সার্ত্র-র নেইসি-র সঙ্গে এই উপন্যাসের ভাবের তুলনা করা হয়। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত থাইল্যান্ডের বুদ্ধিস্ট ইউনিভার্সিটিতে, এবং তারপর একে একে বস্টন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস এবং ইউনিভার্সিটি অফ নিউ মেক্সিকোয় শিক্ষকতা করেন তিনি। ১৯৭৩ পর্যন্ত লা ক্লেজিও বসবাস করেন ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এবং মরিশাসে। ল্য ক্লেজিও-র উপন্যাসে ঘুরে ফিরে এসেছে সূর্য ও সমুদ্র, আলো এবং পানির দৃশ্যাবলী। তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকায় ছিলেন। সে সময় পানামায় এম্বেরা নামক এক বনবাসী রেড ইন্ডিয়ান গোত্রের সঙ্গে বাস করেন। এদের সম্পর্কে তিনি এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন: ‘এটা এমন এক অভিজ্ঞতা যা বদলে দিয়েছে আমার গোটা জীবনকে, বদলে দিয়েছে জগত ও শিল্প সম্পর্কে আমার ধারণা, অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার নিয়ম, আমার হাঁটা, খাওয়া, ঘুমানো, ভালবাসা, এমনকি আমার স্বপ্ন দেখার পদ্ধতিকেও।’ তার বইয়ের সংখ্যা সব মিলিয়ে (উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্পের সংকলন এবং অনুবাদ) মোটামুটি ত্রিশটি। এসব বইয়ে তার পরিবেশ বিষয়ক উদ্বেগ, পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী চিন্তার অসহনশীলতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, এ্যামেরিকান ইন্ডিয়ান জগতের প্রতি তার পক্ষপাত প্রতিফলিত হয়েছে। এখান থেকেই তিনি লাভ করেন সুইডিশ একাডেমী কথিত ‘আধিপত্যবান সভ্যতার উর্ধে এবং নিচে অন্য এক সভ্যতা’ আবিষ্কারেরর অনুপ্রেরণা। ল্য ক্লেজিও এমন একজন লেখক যিনি বলতে গেলে একজন পরিব্রাজক, সব সময় ভ্রমণের ওপরেই থাকেন তিনি। তার উপন্যাসের সেটিং নির্মাণে তার এইসব ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে তিনি দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার নির্যাস দিয়ে এঁকেছেন সংস্কৃতির সংঘর্ষ, বিশ্বায়নের অসামঞ্জস্যতা এবং পশ্চিমা যুক্তিবাদের আধিপত্যের চিত্র। তার ডেজার্ট (১৯৮০) উপন্যাসটি প্রিক্স পল মোরাঁদ পুরস্কার পায়। এতে তিনি দেখিয়েছেন সাহারা মরুভূমির একজন নোম্যাড তরুণী একজন বিখ্যাত ফটো মডেল হয়, কিন্তু সে তার সন্তান জন্ম দিতে ফিরে যায় মরুভূমিতে। দুটো সমান্তরাল কাহিনীর বুনোটের মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফরাশী ঔপনিবেশিকরা কীভাবে তুয়ারেগ জাতিকে নিষ্পেষণ করে। তার প্রথম দিককার উপন্যাসগুলোর স্টাইল ছিল খুবই নিরীক্ষাধর্মী, এবং বুদ্ধিবৃত্তিক। এগুলোয় আধুনিক পাশ্চাত্য নাগরিক সভ্যতার নগ্ন ছবি এঁকে তিনি দেখিয়েছেন এটা কতটা গণবিচ্ছিন্ন, আগ্রাসী এবং ভোগের কাছে জিম্মি। পাশ্চাত্য যুক্তিবাদের সীমাবদ্ধতা এবং প্রকৃতি, মানুষের আবেগ ও আধ্যাত্মিকতার বিপজ্জনক অবনয়ন নিয়ে সব সময় উদ্বিগ্ন তিনি। এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন: ‘পশ্চিমা সংস্কৃতি জমাট পাথরের মতো খুবই একঘেয়ে হয়ে পড়েছে। এটা সম্ভাব্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এর নাগরিক এবং প্রাযুক্তিক দিককে, এভাবে প্রতিরোধ করে ধার্মিকতা ও হূদয়ানুভূতির মত ভাবপ্রকাশের অন্যান্য রূপের উন্নয়নকে। যুক্তিবাদিতার নামে মানুষের পুরো অজ্ঞাত অংশকে আড়াল করে রাখা হয়।’ সভ্যতা ও সংস্কৃতির সন্ধানে তিনি অক্লান্ত্ম কর্মী। তিনি তার কাহিনী ও চরিত্রগুলোকে ব্যবহার করেন পশ্চিমা সংস্কৃতির সীমা ব্যাখ্যা করার কাজে। অধুনা, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া আবিষ্কার করার লক্ষ্যে তিনি তার নিজস্ব পারিবারিক ইতিহাসের দিকে নজর দিয়েছেন। এবং এইভাবে তিনি এমন এক সাহিত্যজগত নির্মাণ করেছেন যা তার একান্তই নিজস্ব।
............... নাজিব ওয়াদুদ (সৌজন্যেঃ Dhaka Time 24) |
পরাক্রমশালী রাশিয়া। রাশিয়ার সম্রাট বা জারের লোভ ছিল দেশটির ওপরে-১৮০৯ সালে তিনি দেশটি দখল করে বসলেন-ফিনল্যান্ড হয়ে দাঁড়াল রাশিয়ার একটি প্রদেশ বা গ্র্যান্ড ডাচি (Grand Duchy)। এর ফলে দেশটির সাংস্কৃতিক জীবনে সুইডিশ ভাষার প্রভাব খানিকটা কমে এবং অনগ্রসর ফিনিশ ভাষার প্রসার ও সমর্থন বাড়ে।
জারেরা বিশ্বাস করতেন যে রুশ ভাষা চাষাভুষের ভাষা-নতুন জয় করা রাজ্যে সেই ভাষা চাপিয়ে দেবার প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে রুশ ভাষায় এল যুগান্তকারী সৎ সাহিত্যের জোয়ার -গোগোল, চেকভ, দস্তয়েভষ্কি, তুর্গেনেভ ও অন্যান্য; তার কেন্দ্রে সংস্কৃতিমনা সেন্ট পিটার্সবুর্গ। ফিনল্যান্ড সেখান থেকে, পাথর ছোঁড়ার দূরত্বে, সমৃদ্ধ হল তার সাহিত্য ও সংস্কৃতিও।
॥২॥
১৮৯২ সালের এপ্রিল মাসে রাশিয়ার তৎকালীন রাজধানী সেন্ট পিটাসবার্গে এডিথ সোড়ারগ্রানের জন্ম। বাবা মাত্স্ এনজিনিয়ার, কর্মসূত্রে উত্তর ইয়োরোপের নানা শহর ঘুরে থিতু হয়েছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গে; মায়ের নাম হেলেনা হোমরুস। এডিথের বয়েস যখন কয়েক মাস, শহরে শুরু হল ভয়াবহ কলেরা মহামারী। মাত্স্ তার পরিবারকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন ষাট মাইল উত্তর পশ্চিমে ফিনল্যান্ড সীমান্ত পেরিয়ে রাইভোলা গ্রামে। নগন্য, দরিদ্র ধীবরপল্লী, কিন্তু চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য; অভিজাত রুশ মানুষেরা সেখানে খামারবাড়ি বা “দাচা” বানিয়ে গ্রীষ্মকালে ছুটি কাটাতে আসেন অরণ্য, হ্রদ, পশুপাখি ও পুষ্পের মাঝখানে। সেখানকার মানুষের ভাষা রুশ, সংস্কৃতি রুশ এবং গির্জাটিও রুশ অর্থডস্ক খ্রীষ্টধর্মের-পেঁয়াজের মতন অর্ধগোলাকৃতি গম্বুজ তার। এডিথের সংক্ষিপ্ত জীবনের একটা বড় অংশ কাটবে এই কাঠের বাড়িতে, তার বারান্দায় ব্যালকনিতে বা বড় বড় কাচের জানালার নিভৃতে বসে লেখা হবে তাঁর বিষন্ন, নিঃসঙ্গঁ কবিতাবলী-প্রিয় সঙ্গীঁ তাঁর হলুদ ও বাদামি রঙা বেড়াল “তত্তি”। কবির জীবনীকার লুপ দ্য ফানোর বর্ণনায়,” that air of neglect, that atmosphere of romantic decadence which have struck the few visitors to the place, and which were to mark the poetry of Edith Sodergran with such a strange hue.”
কবির যখন দশ বছর বয়েস, তাঁকে পাঠানো হল সেন্ট পিটার্সবার্গের নেভস্কি প্রসপেক্ট রাজপথে অবস্থিত এক অভিজাত জার্মান স্কুলে। সেখানে শিক্ষার মান যেমন উঁচু, তেমনি জোর দেওয়া হয় শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও নৃত্যের ওপরে। ছয় বছর এই স্কুলে পড়লেন তিনি, ছুটি কাটাতেন রাইডোনায়। স্কুলেই শুরু হল জার্মান ভাষায় নিয়মিত কবিতা রচনা। তাঁর মানসিক দৃষ্টিভঙ্গীঁ বৌদ্ধিক চিন্তাধারা এবং কাব্যভাবনা হয়ে দাঁড়ায় পুরোপুরি আন্তর্জাতিক।
১৯০৪ সালে মাত্স্ যক্ষারোগে আক্রান্ত হন, সংক্রামক অসুখের জন্যে তাঁকে বাকী জীবন কাটাতে হয় ফিনল্যান্ডের নুমেলা শহরের স্যানাটোরিয়অমে। স্কুল থেকে এডিথ তাকে দেখতে যেতেন নিয়মিত এবং পরিচর্যা করতেন তার। এডিথের কবিতায় ব্যাধি ও মৃত্যুর ছায়া নামে। গভীর যন্ত্রনায় মাত্সের মৃত্যু হয় ১৯০৭ সালে এবং দেড় বছর পরে এডিথ নিজেও আক্রন্ত হন সেই একই কালান্তক অসুখে। ওই একই স্যানাটোরিয়ামে স্থান হয় ষোড়শী এডিথের। এই সময়কার স্কুলে এবং স্যানাটোরিয়ামে রচিত কবিতাগুলি প্রকাশিত হবে তাঁর মৃত্যুর অনেক দশক পরে-শৈশবের কবিতা (১৯০৭-১৯০৯) শিরোনামে, প্রকাশ ১৯৬১।
কবির জীবনের বাকী অর্ধেক অংশ মৃত্যুর সঙ্গেঁ সংগ্রাম এবং বেঁচে থাকার জন্যে যুদ্ধ। পরবর্তী আড়াই বছরে তিনি পাঁচবার দীর্ঘ সময়ের জন্যে অন্তরীন থাকবেন নুমেলার স্যানটোরিয়ামে এবং সাময়িক ভাবে সুস্থ হলেই ফিরে আসবেন মায়ের কাছে রাইভোলায় তিনিই একমাত্র সন্তান। নুমেলার লোকজন তাঁকে জানতো কবি, পুস্তক-পাগল অথবা প্রায় উন্মাদ হিসেবে; শারীরিক যন্ত্রণার সঙ্গেঁ ছিল মানসিক অসুস্থতা। নুমেলায় একটি চমৎকার গ্রন্থাগারে ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বইপত্র-সেখানেই তিনি কাটাতেন তাঁর সুস্থতার প্রহরগুলি।
১৯১২ সালের জানুয়ারী মাসে মা, মেয়ে গেলেন সুইৎসারল্যান্ডের দাভোসে শহরে-তাঁর প্রিয় লেখক টোমাস মান (১৮৭৫-১৯৫৫) এর যাদু পাহাড় উপন্যাসটির পটভুমি। মানের স্ত্রী কাটিয়া ১৯১২ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর দাভোস শহরে স্যানাটোরিয়ামে চিকিৎসাধীন ছিলেন-তাঁর স্বামীকে লেখা দীর্ঘ চিঠিগুলিই যাদু পাহাড় উপন্যাসের রসদ। লেখক নিজে দাভোস শহরে গেছেন উপন্যাসটি লেখার অনেক দিন পরে।
॥৩॥
দাভোস শহরে স্বাস্থ্যের সমূহ উন্নতি হল এডিথের; সেখানকার এক বয়স্ক চিকিৎসকের প্রেমে পড়লেন তিনি; নুমেলাতেও একজন ডাক্তারকে তিনি বিবাহ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। দাভোসের গ্রন্থাগারে তিনি পাঠ করলেন ইংরেজি সাহিত্য-ডিকেন্স ও সুইনবার্ন, হুইটম্যান আর শেকসপিঅর; ইতালিয়ান ভাষা-শিখে পড়লেন দান্তে-তাঁর ইনফার্নের সঙ্গেঁ হুবহু মিল খুঁজে পেলেন তাঁর স্যানাটোরিয়ামের। এবং সুইডিশ ভাষায় নিজের কবিতা লেখার শুরু হল। ১৯১৩ সালের বসন্তে মিলান ও ফ্লোরেন্স কিছুদিন ঘুরে দেশে ফিরলেন মে মাসে। মূলতঃ রাইভোলায় বসবাস, মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্যে সেন্ট পিটার্সবার্গে। ১৯১৪ সালে বাধলো প্রথম মহাযুদ্ধ, ফিনল্যান্ড তাতে যোগ না দিলেও সেনাবাহিনীর নিয়মিত যাতায়াত রাইভোলা হয়ে রাশিয়ার পথে। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হল প্রথম কাব্যগ্রন্থ কবিতা তাঁর সময়ের থেকে বেশ কয়েক দশক এগিয়ে থাকা কাব্যভাবনা, যাঁর অনুপ্রেরনা র্যাঁবো, রিলকে এবং হুইটম্যান-ফিনল্যান্ডের গন্ডগ্রামে তাঁর প্রভাব হল সাংঘাতিক। হেলসিংকি শহরে প্রতিক্রিয়া অতোটা বিরুপ নয়, তবুও খুবই আঘাত পেলেন কবি। তার অভিঘাতে লিখতে বসলেন নতুন কবিতা।
১৯১৮ সালে প্রকাশিত হল দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ শরতের বীনা। তাঁর ভূমিকাটি নর্ডিক সাহিত্যে বিখ্যাত. ”My poems are to be taken as careless sketches. As to the contents, I let my instinct build, while my intellect watches. My self confidence comes from the fact that I have discovered my dimensions. It does not behoove me to make myself smaller than I am.” সমালোচনার ঝড় বইলো-গ্রন্থের ৩১টি কবিতাকে এক সমালোচক বর্ননা করলেন “৩১টি হাসির বড়ি” বলে; কবিতার সঙ্গেঁ তিনি যে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন তাঁর কবিসত্তাকে তা নিয়েও সমালোচকদের আপত্তি। নীটশের উদ্ধৃতি দিলেন এক সমালোচক, ”লেখক তাঁর মুখ বন্ধ রাখবেন, তাঁর রচনাই কথা বলবে তাঁর হয়ে।” কেবল ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও কবিতাপ্রেমী হেগার ওলসন (১৮৯৩-১৯৭৮) “দাগেনর্স প্রেস” সংবাদপত্রে একটি প্রবন্ধ লিখলেন গ্রন্থের কবিতাগুলির গুরুত্ব ও সম্ভাবনা বিষয়ে; সেই সঙ্গেঁ তিনি তিরস্কারও করলেন কবিকে কবিতাগুলি ব্যাখ্যা করার প্রচেস্টার জন্যে। সহানুভূতিশীল প্রবন্ধটি পড়ে অভিভূত হলেন এডিথ-দুজনে বন্ধুত্ব জমে উঠলো, প্রথমে চিঠিপত্রে পরে সাক্ষাতে। হেগারের প্রনোদনায় তিনি হেলসিংকি ও সেন্ট পির্টাসবার্গে গেলে ফিনল্যান্ড ও রাশিয়ার আধুনিক কবিদের সঙ্গেঁ পরিচয় ও আলাপ আলোচনা করতে। পরিচয় হল ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি (১৮৯৩-১৯৩০) এবং ইগর সেভেরিয়ালিন (১৮৮৭-১৯৪১) এর মতন মহীরূহদের সঙ্গেঁ।
এদিকে মার্চ, ১৯১৭ শুরু হয়ে গেছে বলশেভিক বিপ্লব; ফিনল্যান্ড তখন সাময়িক ভাবে স্বাধীনতা ঘোষনা করে, কিন্তু রাশিয়ায় বেধে যায় গৃহযুদ্ধ। রাইভোলা একে রাশিয়ার সীমান্তে এবং অন্যদিকে রাশিয়ার বাল্টিক নৌবাহিনীর ঘাঁট ক্রনস্টাড শিবিরের খুব নিকটে-ফলে যুদ্ধের আগুন জ্বললো সেখানেও। গ্রামটি থাকলো বিপ্লবী লালফৌজের দখলে, কিন্তু জারের বাহিনীর চোরাপোপ্তা আক্রমণ চললো, তারা জ্বালিয়ে দিলো ক্ষেতের ফসল-সেই অঞ্চলে তখন দীর্ঘ দুর্ভিক্ষ। পরিবারটির সংসার চালানোর সমস্ত খরচ আসতো সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে, বিপ্লবের ফলে তা গেল বন্ধ হয়ে। দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষেই তাঁদের দুর্যোগের সমাপ্তি নয়, মানসিক দুশ্চিন্তার ফলে আবার ফিরে এলো পুরানো অসুখ। মেরামতের অভাবে ভেঙে পড়তে থাকে বাড়িঘর; সংসার চালাতে আর চিকিৎসায় বিক্রি হয় ঘরের আসবাবপত্র, গয়নাগাঁটি আর দামী পোষাক।
দুর্বিসহ জীবনে তাঁর সবচেয়ে বড় ভরসা বন্ধু হেগার-দুজনে হয়ে উঠলেন এক সত্তা, আত্মার আত্মীয়। ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আরেকটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলেন তিনি এডিথের কবিতা বিষয়ে, তাতে কবির ওপরে নগ্ন, ঘৃন্য আক্রমনের যথোপযুক্ত সমালোচনা। দুজনে চিঠিপত্র আদান প্রদান চললো, সেই সঙ্গেঁ এডিথ পাঠালেন নতুন লেখা কবিতা। কিছুদিন পরে কবির আমন্তনে রাইভেলোর দাচায় তাঁর সঙ্গেঁ দেখা করতে এলেন হেগার এবং থাকলেন কয়েকদিন। গাড় হলেও অসম বন্ধুত্ব-একজন অসুস্থ, অসুখী, দরিদ্র, মৃত্যুর অপেক্ষায়; অন্যজন তরুনী, সম্ভাবনাময় লেখিকা, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। দুজনের চিঠিপত্রের সংকলন ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে ২০০০ সালে, গ্রন্থটির নাম-যে কবি সৃস্টি করেছেন নিজেকে-এডিথ সোভারগ্রানের নির্বাচিত চিঠিপত্র।
ফুরিয়ে যাবার আগে পরপর দুটি কাব্যগ্রন্থ-গোলাপের পূজাবেদী (১৯১৯) এবং ভবিষ্যতের ছায়া (১৯২০)। সমালোচকদের আক্রমন চললো অব্যাহত। হেগারের সহানুভূতিশীল আলোচনা পড়ে কবি চিঠি দিলেন, “Could it really be that I am coming to someone? Could we take each other’s kaud?” হেগার তাঁকে হেলসিংকিতে আমন্ত্রণ জানালে তিনি উত্তর দিলেন, “ঘুম নেই, শান্তি নেই, অর্থ নেই, যক্ষার রক্তপাত আছে।” কিন্তু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কবিতা লিখেছেন, পরনের নাইটগাউন বিক্রি করে কিনেছেন কবিতা লেখার কাগজ। মৃত্যুর পরে অগ্রন্থিত, অপ্রকাশিত কবিতাগুলি-যে ভূমি ভূমি নয় (১৯২৫)। তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে বেশ কয়েকবার। ব্রিটিশ কবি ডেভিড ম্যাকডাফ (১৯৪৫-) অনুবাদ করেছেন তাঁর কবিতা সমগ্র (প্রকাশক-ব্লাডেক্স বুকস, ১৯৮৪)। মার্কিন কবি স্যামুয়েল চার্টার্স (১৯২৯-) ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রবিবাদে দেশ ছেড়ে চলে যান সুইডেনে। ১৯৭৭ সালে তিনি আমরা নারী নামে এডিথ স্যোডেরগ্রানের কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করে ছিলেন। জন্মসূত্রে ফিনল্যান্ডের সুইডিশভাষী নাগরিক এবং গত চার দশক ক্যালিফোর্নিয়ার অধিবাসী, সাংবাদিক ও অনুবাদক স্টিনা কাচাদৌরিয়ান কবির নির্বাচিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছেন প্রেম ও নিঃসঙ্গঁতা নামে ১৯৮৫ সালে। সুইডিশ কবি গৌনিল ব্রাউন (১৯২৬-) ইংরেজি অনুবাদ করেছেন এডিথের নির্বাচিত কবিতার-আইকন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২০০১ সালে। সুব্রত এডিথের কবিতাগুলির বঙ্গানুবাদ করেছেন ডেভিড ম্যাকড্যাফের ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে।
॥৪॥
রাইভোলার খামারবাড়িতে বাস করতেন এডিথ-কন্বমুনির আশ্রমে শকুন্তলার মতন-সেখানে প্রতিটি বস্তুর একটি নাম ছিল, সব কিছুকে ভাবা হত জীবিত এবং তুচ্ছ পদার্থটিও তাঁর কাছে চরম প্রয়োজনীয়। কোন গাছের অসুখ করলে, তিনি তার পাশে একান্তে বসে নিবিড় কথোপকথন চালিয়ে যেতেন তার সঙ্গেঁ, উষ্ণ সাবান জলে ধুয়ে দিতেন তার শরীর। শুকনো ফুলকে গাছ থেকে তুলে সাদরে শেষ শয্যায় শুইয়ে দিতেন ঘাসের উপরে-সঠিক মর্যাদার সে মৃত্যু। হেঁটে বেড়াতেন তিনি-প্রতিটি গাছ, পাথর, ধুলিকনা তাঁর পরম প্রিয়। শারীরিক শক্তি ফুরিয়ে আসার সঙ্গেঁ সঙ্গেঁই হাঁটার বৃত্তটিও ছোট হয়ে আসে। অভিজাত, প্রাচীন ফ্যাশনের দামি পোষাকের অন্তরালে ক্ষীন থেকে ক্ষীনতর হয় শরীর, তার সঙ্গেঁ থাকে দুটি দীর্ঘ আয়ত চোখ আর ওষ্ঠের মৃদু হাসি। অন্তিম সময়ের অল্প কিছুদনি আগে এক সতীর্থ কবি দেখা করতে এসেছিলেন-সারা জীবন তিনি ভুলতে পারেন নি সেই দিনটির কথা-“ডাগর দুটি ধূসর রঙের চোখ, কালো গভীর, স্থির জলে পূর্নিমার আলো পড়লে যেমন লাগে; আর সেই স্বর্গীয় হাসি।”
শেষ দিনটি ঘনিয়ে এল ২৪ জুন ১৯২৩ মধ্যগ্রীষ্মের দীর্ঘতম দিন। সূর্যদেব ডুবলেন না সেদিন-সারারাত জেগে পাহারা দিলেন এই মহান কবিকে। খুব অল্প খরচে সমাধিস্থ করা হল তাঁকে-পরে লাল গ্রানিটের ফলকে লেখা হল এপিটাফ- তাঁর অন্তিম কবিতাটির প্রথম চার লাইন-
“দ্যাখো, হেথা অনন্তের তীরে শুয়ে নারী,
ভব নদী গম্ভীর বাহিনী,
মৃত্যুর অমোঘ ক্রীড়া বৃক্ষে, গুল্মে, তৃণে
এক সুর, সরল কাহিনী।”
শরতের স্লান বিল
শরতের স্লান বিল
কী ভারী স্বপ্ন দ্যাখো তুমি বারে-বারে
বসন্ত-সাদা দ্বীপ
ডুবেছে যা পারাবারে।
শরতের স্লান বিল,
লুকায় তোমার বীচি,
তোমার আয়না ভুলে যায় যত
শুভদিন হারিয়েছি।
শরতের স্লান বিল
উচু আকাশেরে হাল্কা, নীরব বহে,
ক্ষণেকের তরে জীবন-মরণ
ঘুম-ঘুম চোখে চুম্বন করে দোঁহে।
(Pale Lake of Autumn)
হেমন্ত
তোমার বাড়ির চারিধারে ন্যাড়া গাছ
হাওয়া আর রোদ কভু বোধ করে নি তো,
বড়-বড় পায়ে ন্যাড়া গাছগুলি যায়
জলের কিনারে, জলে হ’তে বিস্বিত।
শিশুটি খেলেছে হেমন্ত-কুয়াশায়,
ফুল হাতে নিয়ে মেয়েটি চলেছে একা,
দূরে যেইখানে শেষ হ’ল নীলাকাশ
রুপালি-সফেদ পাখিরা মেলেছে পাখা।
(Autumn)
কালো বা সাদা
সেতুদের নীচে নদীগুলি ব’য়ে যায়,
পথপাশে ফুল করে সব রোশনাই,
মাঠেদের কানে, ফিসফিস করে নু’য়ে-নু’য়ে পড়ে বন।
আমার জন্য উচুনিচু কিছু নাই,
অথবা কালো বা সাদা,
সেইদিন থেকে, যখন ধবল পোশাকের এক নারী
দেখেছি আমার প্রিয়ের বাহুতে বাঁধা।
(Black or White)
তারার ঝাঁক
রাত্রি এলে
আমি দাঁড়াই সিঁড়িতে আর শুনি
অযুত তারার গুনগুনুনি আমার বাগানটিতে
এবং আমি আঁধারে দাঁড়ানো।
ঐ খশল একটা তারা ঠুং ক’রে!
খালি-পায়ে হাঁটিস না রে ঘাসে;
বাগান ভ’রে আছে ভাঙা-কাচে।
(The Stars)
বুড়ো আংলো
খুদে বুড়োটি গ’নছে ব’সে ডিম।
প্রতিবারেই একটা ডিম কম।
তাকে তোদের সোনা দেখাস নে রে,
বন্ধুরা আমার।
(The Little Old Man)
ফেনা
জীবনের শ্যাম্পেনে
বুদ্বুদ করি পান
হাল্কা ফেনার মতো
শ্যাম্পেনের পরান …
শ্যাম্পেনের নয়ান-
আকাশ ইশারা হানে
শ্যাম্পেনের চরণ-
চলো তারাদের টানে
শ্যাম্পেন-ভূত, হাতে
গেলাস বিলাসে মাতে!
(Foam)
নিটশের সমাধিতে
পাকা শিকারিটা আজ মৃত…
আমি তার গোরটিকে ঢেকে দিই ফুলের ঝালরে….
ঠাণ্ডা পাথরটাকে চুমু খেয়ে বলি:
সুখের চোখের জলে ভেজা, দ্যাখো, এ তোমার প্রথম সন্তান।
একটু ঠাট্টাভরে বসি তোমার কবরে
গালে যেন চড় এক– যেমন দেখেছে স্বপ্নে, চাবু তারও চেয়ে।
হে অদ্ভুত পিত:!
তোমার সন্তানেরা করবে না তোমার মাথা হেট।
তারা আসছে সারা পৃথিবীর থেকে, দেবতার পদাঙ্ক মাড়িয়ে,
চোখ কচলে বলছে তারা : কোথায় এলাম?
না, সত্যিই … এ-ই মোকাম আমার,
এই ভগ্নদশা গোরে আমার পিতার…
ঈশ্বর- অনন্তদৃষ্টি রেখো এই জায়গার উপর।
(At Nietzsche’s Grave)
ষাঁড়
ষাঁড় কোথায়?
আমি লাল-কাপড় এই পালায়।
দেখি না খুন-টগবগ চোখ,
শুনি না দ্রুত এবং আগুনে নিশ্বাস,
কাঁপে কি ক্রুদ্ধ খুরের তলায় রিং-এর জমি?
না।
এ-ষাঁড়ের নাই কোনো শিং; সে যে
রয়েছে দাঁড়িয়ে আস্তাবলে,
চিবিয়ে যাচ্ছে শক্ত খড়।
পৎপৎ উড়ছে হাওয়ায় অনাহত কড়া-লাল কাপড়।
(The Bull)
শিল্পীর ভেংচি
খেলাতখানি-ছাড়া আমার আর-কিছু যে নেই,
আমার এ-লাল নির্ভীকতা-ছাড়া।
আমার এ-লাল নির্ভীকতা রয় অভিযানেই
ব্যস্ত, দিবারাত্রি বল্গাহারা।
বগোল-তলায় এই দোতারা, সম্বল আমার এ যে,
আমার তুখোড় দোতারা-বাদন;
আমার তুখোড় দোতারাটা পথে-পথে বেজে
রাঙায় মানুষ আর পশুদের মন।
এই উঁচু মাথাটি নইলে, আমার সবই মিছে,
এ-উত্তুঙ্গ গর্বটুকু হায়,
এ-উত্তুঙ্গ, গর্বটুকু নেয় বগোলের নীচে
দোতারাটা– এবং চ’লে যায়।
(Grimace d’ Artiste)
কুমারীর মৃত্যু
এই শুদ্ধা কুমারীর আত্মটি বোঝে নি কোনো ভুল,
সবই জানত নিজের বিষয়ে,
তদুপরি জানত সে তো অন্যদের আর সমুদ্রের বাবদেও।
দু’চোখ পিয়াল তার, ঠোট-দু’টি গুঞ্জাফল, হাতগুলি মোমের।
হাঁটু মুড়ে ঘুরে প’ড়ে গেল সে তো মাটিতে মিশিয়ে।
সে চ’লে যাবার পর, দেহটি যে বনে প’ড়ে রয়েছে তা জানল না তো কেউ….
খুঁজেছিল তারা তাকে সমুদ্রপারের কুমারীদের ভিতরে,
শুক্তির ভিতরকার নরম ঝিনুক নিয়ে গাইত যারা গান।
অনেক খুঁজেছে তারা তাকে যত মাতালের মেলে,
মাতত যারা কাজিয়ায় জমিদার-হেঁশেলের ছুরি-চাকু নিয়ে।
দোলনচাঁপার মাঠে তাকে তারা খুঁজেছে অনেক
যেখানে আগের রাত থেকে তার একপাটি চপ্পল ছিল প’ড়ে।
(The Death of the Maiden)
জ্যোতির্বলয়েরা
আমার শক্তি আছে। আমি ডরাই না তো কিছু।
আকাশ আমার কাছে হাল্কা খড়।
দুনিয়াটা ফানা হ’লে তবু-
আমি টিকে থাকব একেশ্বর।
ধরার ঝড়েভরা রাতের ‘পরে
আমার হাল্কা দিগন্তেরা ঠায়।
ভানুমতির থেকে বেরোও, জ্যোতির্বলয়েরা!
অনড়, আমার শক্তি অপেক্ষায়।
(The Fields of Light)
আমার নকল ফুলগুলি
নকল ফুলগুলি আমারঃ
তোমার ঘরে আমি পাঠিয়ে দেব,
আমার পিতলের সিংহগুলিকে
তোমার দরজায় বসাব।
বসব আমি নিজে সিঁড়িতে-
প্রাচ্য পৃথিবীর একটা হৃত মৌক্তিক
বিশাল শহরের ঝ’ড়ো সায়রে।
(My Artificial Flowers)
সৌরজগৎ পেরোতে হয়েছে আমার
পায়দল
সৌরজগৎ পেরোতে হয়েছে আমার
পয়লা সুতাটা খুঁজে পেতে গিয়ে আমার এ-লাল জামার।
নিজেকেও আমি দেখতে পাচ্ছি অবিকল।
আমার হৃদয় ঐ তো ঝুলছে মহাকাশে কোনোখানে,
ধুকপুকে মহাশূন্য কাঁপছে, ছুটতেছে বামে-ডানেঃ
ফুলকি-উল্কা কট্টর আরও কত-না হৃদয় পানে।
(On Foot I Had to Cross the Solar System)
হিমালয়ের ধাপে-ধাপে
হিমালয়ের ধাপে-ধাপে
মহান্ বিষ্ণু ব’সে
স্বপ্ন দেখে যায়
হিমালয়কে ঘিরে-রাখা অনন্ত প্রদোষে।
শ্বেত বস্ত্রে দাঁড়িয়ে কাঁপে
তীর্থযাত্রী, ক্ষুদ্র, এমন বেগুনি আভায়।
সর্বশক্তিমান, হরণ
করো আমার প্রাণ তোমার
এক-পলকের স্বপ্ন-লাগি, স্বামিন!
বারেক জানব তোমার ইচ্ছা–তারপর নাই হয়ে যাব আমি….
(On the Steps of the Himalayas)
মন্তর
কীভাবে গভীরতম হৃদয়ের থেকে আমি বলব তোমাদের?
দেবতারা কী করে তাদের শব্দগুলিকে সাজায়, তাল্কা, আর তবু অপ্রতিহত?
কী প্রকারে বললে পরে মানবিক দুর্বলতা করবে না মাজুল শব্দদের?
এবং আমার ইচ্ছা তোমাদের পাকড়ে ধরে যেন সাঁড়াশিতে
ব্যথা, ভীতি, বা প্রেমের মতো ….
আমার ইচ্ছার কাছে তোমাদের হীনবল ক’রে ফেলতে চাই।
আমি চাই ছিঁড়ে-ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফ্যালো তোমাদের হৃৎপিণ্ডগুলিকে,
শয়তানের অধিষ্ঠান হোক তোমাদের হাতে-পায়ে
বুনো ও অমানুষিক, আজীবন বিস্ফোরণময়।
পিশাচেরা,
কী - যে চাই তোমাদের চোখে রাখতে চোখ,
আমার চানুনিতে চাই আমার পুরেপাটা ভ’রে দিতে।
পিশাচেরা, আকাক্সিক্ষত: আমার ক্ষমতাবলে আমি বশ করব তোমাদের?
সেনালি চুলের টোপ তোমাদের সামনে ছুঁড়ে মারি দয়াহীন,
ফিনকি দিয়ে ছুটে যায় আমার রক্তের মোটা ধারা।
তোমরা কি আমার কাছে আসবে, ওগো পাতালের রক্তচোষারা?
(The Charm)
ট্যান্টালাস, ভরহ সুরাহি
এসব কবিতা নাকি? না, এরা চিরকুট শুধু, ছেঁড়া টুকরা-টাকরা,
নানা কেজো কাগজের স্লিপ।
ট্যান্টালাস, ভরহ সুরাহি।
অসম্ভব, ওগো অসম্ভব,
মরার সময় ছুঁড়ে ফেলে যাব আমার চুলের মালাখানি
তোমার অশেষ শূন্যতায়।
(Tantalus, Fill Your Beaker)
কী আমার মাতৃভূমি?
কী আমার মাতৃভূমি? সে কি বহু-দূর, তারা-খাচা
ফিনল্যান্ড? সে যা-ই হোক। চটাল তটের ‘পরে নিচু
পাথর গড়ায়। সেই ধুসর গ্র্যানিটে আমি ঠায়
এক স্থিরতায় যেন। হে স্থিরতা, গোলাপ ও লরেল
ছড়াও আমার পথে। আমি সেই গর্বিত দেবতা
তব দ্বারে। আমি সেই আশীর্ময় অতীত-বিজয়ী।
(What Is My Homeland?)
রূপান্তর
এ কী আশীর্বাদ এই প্রবল হাওয়ায়…..
শাশ্বতের অনন্ত চুম্বন…
কীভাবে রুফান্তরিত হয়েছে জীবন আর হ’য়ে গেছে স্থির,
ভ্রান্তি-জাগানিয়া-রুপে স্থির…
রূপকথার পয়মন্ত রাজকন্যা ওগো,
তোমার হৃদয়ে ঝড়ে তীব্রতর সমুদ্রের ঝড়ের চেয়েও।
এমন হৃদয় কেউ অকারণে বয় নাকি বুকে?
সময়, আমার গান শোনো!
পতিত আত্মারা গায় নরকে যখন এরকম,
কখনও স্বর্গের থেকে ফিরে আসে তার প্রতিধ্বনি।
না হৃদয়, তুমি যাচ্ছ অগ্নিবলয়ের মধ্যে দিয়ে!
আমার দৈবত রূপ–একে কি পারে না ভয় দেখাতে নিয়তি?
আমার হাতছানি পারে অবহেলা করতে খুদে ভাগ্যের ভূতেরা?
আমি যদি ডাকি তবে ভবিষ্যৎ না-এসে কি পারে?
(Metamorphosis)
হে মহান কন্দর্প
মহান কন্দর্প ওহে! তুমি শ্বাস টানো বিবাহের,
কিন্তু কী-প্রকার বিবাহের?
যবে হতে এ-পৃথিবী; কামনা বিবাহে সাধে দু’টি
শরীর; অশনিবাণ পশে নি কোনোই
মানবের ভালে।
ঐ যে ঝলক হানে বিজুলি-চাবুক,
অমিত ক্ষমতা এই অশনিবাণের,
আপন খেয়ালে হায় এ - অশনি মনুষ্যশিশুর শিরে ঝরে।
(Thou Great Eros)
বিজুলি
মেঘে-মোড়া ওগো সৌদামিনী,
যে-নীল বিজুলি দেখেই চিনি,
কবে মেঘ ফেড়ে হবে বাহির?
বাতেনি বিজুলি, হবে জাহির
শুচিকর, ভীম বজ্রসহ-
আমি স’য়ে চলি তব বিরহ।
ন্যাকড়ার মতো দেহটা শো’য়া
যেন কোনো বৈদ্যুতিক ছোঁয়ায়ঃ
চকমকি-দড় হ’য়ে সে পারে
নিজেও বিজুলি চমকাবারে।
(Lightning)
হুশিয়ারি
সকল ঐশ্বর্যের ঐশ্বর্য, আমার শরীর,
কেমন ক’রে জানো কত শক্তি তোমার তাঁবেয়?
আমার বাহু–এর দরকার আছে শতাব্দীর।
আমার বাহু– এর দরকার আছে শতাব্দীর।
আমার হাতে বিজুলি আছে, একদিন জলসাবে।
এর নীল-নীল আলোয় লোকের টাসকি লাগবে মনে।
আমি যাদের অন্যতম, তারাও প্রবল ঢের,
কিন্তু আমি সে-বর্ম যা খুঁজছে জগজ্জনে,
আমিই সে-বিচিটি, এবং সূত্র যোগাযোগের।
(Premonition)
সূর্য
আমি আনন্দময়।
ভোরের বেপরোয়া সূর্য, আমার মুখে জ্বলো, কপালে বুলিয়ে যাও ছোঁয়া।
না, তুমি এরই মধ্যে শুনেছ আমার গর্বিত হৃদয়ের উত্তর।
সূর্যের প্রতিটি আবর্তনে উদ্ধততর হৃদয় আমার।
যেন আমি সৌর পিরিচটিকে নিয়েছিলাম হাতের মুঠায়
তাকে গুঁড়িয়ে ফেলব ব’লে।
যেন পৃথিবীতে এক আকস্মিক অভ্যাগত আমি, পথচলতি ঢুকে পড়েছি চুপিসারে
এক সহসা বিদ্রুপ-বৃষ্টিতে একে জাগিয়ে তুলতে।
ওগো দুর্বিনীততম হৃদয়, বাহুগুলি মেলে ধরো সূর্যের দিকে,
হাঁটু গেড়ে বসো, আর তোমার বুকটাকে ছিঁড়ে সূর্য ঢুকে যাক– সূর্য।
(Sun)
শাহি বাগিচা
আমরা সবাই হাঘর বাউণ্ডুলে
আর আমরা ভাই-বোন।
বস্তা-পিঠে চলি আদুল-গায়ে,
কিন্তু আমাদের তুলনায় শাহ্জাদাদের কীইবা আছে ধন?
হাওয়ায় নিত্যি উড়ে আসে কতই কিমতি চিজ,
সোনার দরেও হয় না তাদের মূল্য নিরূপণ।
বয়স যত বাড়ে আমাদের
ততই পষ্টাপষ্টি বুঝি আমরা যে ভাই-বোন।
সৃষ্টিকে তো আমাদের আর কিছুই দেওয়ার নাই,
আমরা তাকে দিয়েছিলাম আত্মা-সবেধন।
আমার যদি থাকত নিজের এক শাহি বাগিচা
করতাম আমার ভাই-বোনদের সেথায় নিমন্ত্রণ।
প্রতিজনাই ফিরত একটা জবর তোফা-হাতে।
বেঘরেরা করত একটা গোত্রের পত্তন।
আমরা বেড়া তুলে দিতাম বাগানের চৌধারে
বাইরের সব ধমক যাতে ঢুকে প’ড়ে না করে গর্জন।
আমাদের ঐ নীরব বাগিচায়
পৃথিবীকে আমরা দিতাম নোতুন এক জীবন।
(The Great Garden)
বিজুলির সাধ
আমি এক বাজপাখি,
এ-ই আমি করি একরার।
কবি নয়,
কখনোই নয় কিছু-আর।
বলতেকি, ঘৃণা করি আর-সবকিছু।
বাজের ওড়ার পথে পাক খাওয়া-ছাড়া আমি কিছু বুঝি না তো।
কী ঘটনা ঘটে এই বাজের ওড়ায়?
সদা-অভিন্ন, শাশ্বত।
অধীর দোহদে এক বিজুলি আকাশ ফ্যালে চিরে
গোপন পিরিতি-ভরে, যেন জন্মাবে এক নয়া পৃথিবীরে।
(The Lightning’s Yearning)
(সৌজন্যেঃ আর্টসবিডিনিউজ২৪)
জারেরা বিশ্বাস করতেন যে রুশ ভাষা চাষাভুষের ভাষা-নতুন জয় করা রাজ্যে সেই ভাষা চাপিয়ে দেবার প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে রুশ ভাষায় এল যুগান্তকারী সৎ সাহিত্যের জোয়ার -গোগোল, চেকভ, দস্তয়েভষ্কি, তুর্গেনেভ ও অন্যান্য; তার কেন্দ্রে সংস্কৃতিমনা সেন্ট পিটার্সবুর্গ। ফিনল্যান্ড সেখান থেকে, পাথর ছোঁড়ার দূরত্বে, সমৃদ্ধ হল তার সাহিত্য ও সংস্কৃতিও।
॥২॥
১৮৯২ সালের এপ্রিল মাসে রাশিয়ার তৎকালীন রাজধানী সেন্ট পিটাসবার্গে এডিথ সোড়ারগ্রানের জন্ম। বাবা মাত্স্ এনজিনিয়ার, কর্মসূত্রে উত্তর ইয়োরোপের নানা শহর ঘুরে থিতু হয়েছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গে; মায়ের নাম হেলেনা হোমরুস। এডিথের বয়েস যখন কয়েক মাস, শহরে শুরু হল ভয়াবহ কলেরা মহামারী। মাত্স্ তার পরিবারকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন ষাট মাইল উত্তর পশ্চিমে ফিনল্যান্ড সীমান্ত পেরিয়ে রাইভোলা গ্রামে। নগন্য, দরিদ্র ধীবরপল্লী, কিন্তু চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য; অভিজাত রুশ মানুষেরা সেখানে খামারবাড়ি বা “দাচা” বানিয়ে গ্রীষ্মকালে ছুটি কাটাতে আসেন অরণ্য, হ্রদ, পশুপাখি ও পুষ্পের মাঝখানে। সেখানকার মানুষের ভাষা রুশ, সংস্কৃতি রুশ এবং গির্জাটিও রুশ অর্থডস্ক খ্রীষ্টধর্মের-পেঁয়াজের মতন অর্ধগোলাকৃতি গম্বুজ তার। এডিথের সংক্ষিপ্ত জীবনের একটা বড় অংশ কাটবে এই কাঠের বাড়িতে, তার বারান্দায় ব্যালকনিতে বা বড় বড় কাচের জানালার নিভৃতে বসে লেখা হবে তাঁর বিষন্ন, নিঃসঙ্গঁ কবিতাবলী-প্রিয় সঙ্গীঁ তাঁর হলুদ ও বাদামি রঙা বেড়াল “তত্তি”। কবির জীবনীকার লুপ দ্য ফানোর বর্ণনায়,” that air of neglect, that atmosphere of romantic decadence which have struck the few visitors to the place, and which were to mark the poetry of Edith Sodergran with such a strange hue.”
কবির যখন দশ বছর বয়েস, তাঁকে পাঠানো হল সেন্ট পিটার্সবার্গের নেভস্কি প্রসপেক্ট রাজপথে অবস্থিত এক অভিজাত জার্মান স্কুলে। সেখানে শিক্ষার মান যেমন উঁচু, তেমনি জোর দেওয়া হয় শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও নৃত্যের ওপরে। ছয় বছর এই স্কুলে পড়লেন তিনি, ছুটি কাটাতেন রাইডোনায়। স্কুলেই শুরু হল জার্মান ভাষায় নিয়মিত কবিতা রচনা। তাঁর মানসিক দৃষ্টিভঙ্গীঁ বৌদ্ধিক চিন্তাধারা এবং কাব্যভাবনা হয়ে দাঁড়ায় পুরোপুরি আন্তর্জাতিক।
১৯০৪ সালে মাত্স্ যক্ষারোগে আক্রান্ত হন, সংক্রামক অসুখের জন্যে তাঁকে বাকী জীবন কাটাতে হয় ফিনল্যান্ডের নুমেলা শহরের স্যানাটোরিয়অমে। স্কুল থেকে এডিথ তাকে দেখতে যেতেন নিয়মিত এবং পরিচর্যা করতেন তার। এডিথের কবিতায় ব্যাধি ও মৃত্যুর ছায়া নামে। গভীর যন্ত্রনায় মাত্সের মৃত্যু হয় ১৯০৭ সালে এবং দেড় বছর পরে এডিথ নিজেও আক্রন্ত হন সেই একই কালান্তক অসুখে। ওই একই স্যানাটোরিয়ামে স্থান হয় ষোড়শী এডিথের। এই সময়কার স্কুলে এবং স্যানাটোরিয়ামে রচিত কবিতাগুলি প্রকাশিত হবে তাঁর মৃত্যুর অনেক দশক পরে-শৈশবের কবিতা (১৯০৭-১৯০৯) শিরোনামে, প্রকাশ ১৯৬১।
কবির জীবনের বাকী অর্ধেক অংশ মৃত্যুর সঙ্গেঁ সংগ্রাম এবং বেঁচে থাকার জন্যে যুদ্ধ। পরবর্তী আড়াই বছরে তিনি পাঁচবার দীর্ঘ সময়ের জন্যে অন্তরীন থাকবেন নুমেলার স্যানটোরিয়ামে এবং সাময়িক ভাবে সুস্থ হলেই ফিরে আসবেন মায়ের কাছে রাইভোলায় তিনিই একমাত্র সন্তান। নুমেলার লোকজন তাঁকে জানতো কবি, পুস্তক-পাগল অথবা প্রায় উন্মাদ হিসেবে; শারীরিক যন্ত্রণার সঙ্গেঁ ছিল মানসিক অসুস্থতা। নুমেলায় একটি চমৎকার গ্রন্থাগারে ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বইপত্র-সেখানেই তিনি কাটাতেন তাঁর সুস্থতার প্রহরগুলি।
১৯১২ সালের জানুয়ারী মাসে মা, মেয়ে গেলেন সুইৎসারল্যান্ডের দাভোসে শহরে-তাঁর প্রিয় লেখক টোমাস মান (১৮৭৫-১৯৫৫) এর যাদু পাহাড় উপন্যাসটির পটভুমি। মানের স্ত্রী কাটিয়া ১৯১২ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর দাভোস শহরে স্যানাটোরিয়ামে চিকিৎসাধীন ছিলেন-তাঁর স্বামীকে লেখা দীর্ঘ চিঠিগুলিই যাদু পাহাড় উপন্যাসের রসদ। লেখক নিজে দাভোস শহরে গেছেন উপন্যাসটি লেখার অনেক দিন পরে।
॥৩॥
দাভোস শহরে স্বাস্থ্যের সমূহ উন্নতি হল এডিথের; সেখানকার এক বয়স্ক চিকিৎসকের প্রেমে পড়লেন তিনি; নুমেলাতেও একজন ডাক্তারকে তিনি বিবাহ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। দাভোসের গ্রন্থাগারে তিনি পাঠ করলেন ইংরেজি সাহিত্য-ডিকেন্স ও সুইনবার্ন, হুইটম্যান আর শেকসপিঅর; ইতালিয়ান ভাষা-শিখে পড়লেন দান্তে-তাঁর ইনফার্নের সঙ্গেঁ হুবহু মিল খুঁজে পেলেন তাঁর স্যানাটোরিয়ামের। এবং সুইডিশ ভাষায় নিজের কবিতা লেখার শুরু হল। ১৯১৩ সালের বসন্তে মিলান ও ফ্লোরেন্স কিছুদিন ঘুরে দেশে ফিরলেন মে মাসে। মূলতঃ রাইভোলায় বসবাস, মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্যে সেন্ট পিটার্সবার্গে। ১৯১৪ সালে বাধলো প্রথম মহাযুদ্ধ, ফিনল্যান্ড তাতে যোগ না দিলেও সেনাবাহিনীর নিয়মিত যাতায়াত রাইভোলা হয়ে রাশিয়ার পথে। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হল প্রথম কাব্যগ্রন্থ কবিতা তাঁর সময়ের থেকে বেশ কয়েক দশক এগিয়ে থাকা কাব্যভাবনা, যাঁর অনুপ্রেরনা র্যাঁবো, রিলকে এবং হুইটম্যান-ফিনল্যান্ডের গন্ডগ্রামে তাঁর প্রভাব হল সাংঘাতিক। হেলসিংকি শহরে প্রতিক্রিয়া অতোটা বিরুপ নয়, তবুও খুবই আঘাত পেলেন কবি। তার অভিঘাতে লিখতে বসলেন নতুন কবিতা।
১৯১৮ সালে প্রকাশিত হল দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ শরতের বীনা। তাঁর ভূমিকাটি নর্ডিক সাহিত্যে বিখ্যাত. ”My poems are to be taken as careless sketches. As to the contents, I let my instinct build, while my intellect watches. My self confidence comes from the fact that I have discovered my dimensions. It does not behoove me to make myself smaller than I am.” সমালোচনার ঝড় বইলো-গ্রন্থের ৩১টি কবিতাকে এক সমালোচক বর্ননা করলেন “৩১টি হাসির বড়ি” বলে; কবিতার সঙ্গেঁ তিনি যে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন তাঁর কবিসত্তাকে তা নিয়েও সমালোচকদের আপত্তি। নীটশের উদ্ধৃতি দিলেন এক সমালোচক, ”লেখক তাঁর মুখ বন্ধ রাখবেন, তাঁর রচনাই কথা বলবে তাঁর হয়ে।” কেবল ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও কবিতাপ্রেমী হেগার ওলসন (১৮৯৩-১৯৭৮) “দাগেনর্স প্রেস” সংবাদপত্রে একটি প্রবন্ধ লিখলেন গ্রন্থের কবিতাগুলির গুরুত্ব ও সম্ভাবনা বিষয়ে; সেই সঙ্গেঁ তিনি তিরস্কারও করলেন কবিকে কবিতাগুলি ব্যাখ্যা করার প্রচেস্টার জন্যে। সহানুভূতিশীল প্রবন্ধটি পড়ে অভিভূত হলেন এডিথ-দুজনে বন্ধুত্ব জমে উঠলো, প্রথমে চিঠিপত্রে পরে সাক্ষাতে। হেগারের প্রনোদনায় তিনি হেলসিংকি ও সেন্ট পির্টাসবার্গে গেলে ফিনল্যান্ড ও রাশিয়ার আধুনিক কবিদের সঙ্গেঁ পরিচয় ও আলাপ আলোচনা করতে। পরিচয় হল ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি (১৮৯৩-১৯৩০) এবং ইগর সেভেরিয়ালিন (১৮৮৭-১৯৪১) এর মতন মহীরূহদের সঙ্গেঁ।
এদিকে মার্চ, ১৯১৭ শুরু হয়ে গেছে বলশেভিক বিপ্লব; ফিনল্যান্ড তখন সাময়িক ভাবে স্বাধীনতা ঘোষনা করে, কিন্তু রাশিয়ায় বেধে যায় গৃহযুদ্ধ। রাইভোলা একে রাশিয়ার সীমান্তে এবং অন্যদিকে রাশিয়ার বাল্টিক নৌবাহিনীর ঘাঁট ক্রনস্টাড শিবিরের খুব নিকটে-ফলে যুদ্ধের আগুন জ্বললো সেখানেও। গ্রামটি থাকলো বিপ্লবী লালফৌজের দখলে, কিন্তু জারের বাহিনীর চোরাপোপ্তা আক্রমণ চললো, তারা জ্বালিয়ে দিলো ক্ষেতের ফসল-সেই অঞ্চলে তখন দীর্ঘ দুর্ভিক্ষ। পরিবারটির সংসার চালানোর সমস্ত খরচ আসতো সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে, বিপ্লবের ফলে তা গেল বন্ধ হয়ে। দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষেই তাঁদের দুর্যোগের সমাপ্তি নয়, মানসিক দুশ্চিন্তার ফলে আবার ফিরে এলো পুরানো অসুখ। মেরামতের অভাবে ভেঙে পড়তে থাকে বাড়িঘর; সংসার চালাতে আর চিকিৎসায় বিক্রি হয় ঘরের আসবাবপত্র, গয়নাগাঁটি আর দামী পোষাক।
দুর্বিসহ জীবনে তাঁর সবচেয়ে বড় ভরসা বন্ধু হেগার-দুজনে হয়ে উঠলেন এক সত্তা, আত্মার আত্মীয়। ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আরেকটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলেন তিনি এডিথের কবিতা বিষয়ে, তাতে কবির ওপরে নগ্ন, ঘৃন্য আক্রমনের যথোপযুক্ত সমালোচনা। দুজনে চিঠিপত্র আদান প্রদান চললো, সেই সঙ্গেঁ এডিথ পাঠালেন নতুন লেখা কবিতা। কিছুদিন পরে কবির আমন্তনে রাইভেলোর দাচায় তাঁর সঙ্গেঁ দেখা করতে এলেন হেগার এবং থাকলেন কয়েকদিন। গাড় হলেও অসম বন্ধুত্ব-একজন অসুস্থ, অসুখী, দরিদ্র, মৃত্যুর অপেক্ষায়; অন্যজন তরুনী, সম্ভাবনাময় লেখিকা, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। দুজনের চিঠিপত্রের সংকলন ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে ২০০০ সালে, গ্রন্থটির নাম-যে কবি সৃস্টি করেছেন নিজেকে-এডিথ সোভারগ্রানের নির্বাচিত চিঠিপত্র।
ফুরিয়ে যাবার আগে পরপর দুটি কাব্যগ্রন্থ-গোলাপের পূজাবেদী (১৯১৯) এবং ভবিষ্যতের ছায়া (১৯২০)। সমালোচকদের আক্রমন চললো অব্যাহত। হেগারের সহানুভূতিশীল আলোচনা পড়ে কবি চিঠি দিলেন, “Could it really be that I am coming to someone? Could we take each other’s kaud?” হেগার তাঁকে হেলসিংকিতে আমন্ত্রণ জানালে তিনি উত্তর দিলেন, “ঘুম নেই, শান্তি নেই, অর্থ নেই, যক্ষার রক্তপাত আছে।” কিন্তু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কবিতা লিখেছেন, পরনের নাইটগাউন বিক্রি করে কিনেছেন কবিতা লেখার কাগজ। মৃত্যুর পরে অগ্রন্থিত, অপ্রকাশিত কবিতাগুলি-যে ভূমি ভূমি নয় (১৯২৫)। তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে বেশ কয়েকবার। ব্রিটিশ কবি ডেভিড ম্যাকডাফ (১৯৪৫-) অনুবাদ করেছেন তাঁর কবিতা সমগ্র (প্রকাশক-ব্লাডেক্স বুকস, ১৯৮৪)। মার্কিন কবি স্যামুয়েল চার্টার্স (১৯২৯-) ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রবিবাদে দেশ ছেড়ে চলে যান সুইডেনে। ১৯৭৭ সালে তিনি আমরা নারী নামে এডিথ স্যোডেরগ্রানের কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করে ছিলেন। জন্মসূত্রে ফিনল্যান্ডের সুইডিশভাষী নাগরিক এবং গত চার দশক ক্যালিফোর্নিয়ার অধিবাসী, সাংবাদিক ও অনুবাদক স্টিনা কাচাদৌরিয়ান কবির নির্বাচিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছেন প্রেম ও নিঃসঙ্গঁতা নামে ১৯৮৫ সালে। সুইডিশ কবি গৌনিল ব্রাউন (১৯২৬-) ইংরেজি অনুবাদ করেছেন এডিথের নির্বাচিত কবিতার-আইকন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২০০১ সালে। সুব্রত এডিথের কবিতাগুলির বঙ্গানুবাদ করেছেন ডেভিড ম্যাকড্যাফের ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে।
॥৪॥
রাইভোলার খামারবাড়িতে বাস করতেন এডিথ-কন্বমুনির আশ্রমে শকুন্তলার মতন-সেখানে প্রতিটি বস্তুর একটি নাম ছিল, সব কিছুকে ভাবা হত জীবিত এবং তুচ্ছ পদার্থটিও তাঁর কাছে চরম প্রয়োজনীয়। কোন গাছের অসুখ করলে, তিনি তার পাশে একান্তে বসে নিবিড় কথোপকথন চালিয়ে যেতেন তার সঙ্গেঁ, উষ্ণ সাবান জলে ধুয়ে দিতেন তার শরীর। শুকনো ফুলকে গাছ থেকে তুলে সাদরে শেষ শয্যায় শুইয়ে দিতেন ঘাসের উপরে-সঠিক মর্যাদার সে মৃত্যু। হেঁটে বেড়াতেন তিনি-প্রতিটি গাছ, পাথর, ধুলিকনা তাঁর পরম প্রিয়। শারীরিক শক্তি ফুরিয়ে আসার সঙ্গেঁ সঙ্গেঁই হাঁটার বৃত্তটিও ছোট হয়ে আসে। অভিজাত, প্রাচীন ফ্যাশনের দামি পোষাকের অন্তরালে ক্ষীন থেকে ক্ষীনতর হয় শরীর, তার সঙ্গেঁ থাকে দুটি দীর্ঘ আয়ত চোখ আর ওষ্ঠের মৃদু হাসি। অন্তিম সময়ের অল্প কিছুদনি আগে এক সতীর্থ কবি দেখা করতে এসেছিলেন-সারা জীবন তিনি ভুলতে পারেন নি সেই দিনটির কথা-“ডাগর দুটি ধূসর রঙের চোখ, কালো গভীর, স্থির জলে পূর্নিমার আলো পড়লে যেমন লাগে; আর সেই স্বর্গীয় হাসি।”
শেষ দিনটি ঘনিয়ে এল ২৪ জুন ১৯২৩ মধ্যগ্রীষ্মের দীর্ঘতম দিন। সূর্যদেব ডুবলেন না সেদিন-সারারাত জেগে পাহারা দিলেন এই মহান কবিকে। খুব অল্প খরচে সমাধিস্থ করা হল তাঁকে-পরে লাল গ্রানিটের ফলকে লেখা হল এপিটাফ- তাঁর অন্তিম কবিতাটির প্রথম চার লাইন-
“দ্যাখো, হেথা অনন্তের তীরে শুয়ে নারী,
ভব নদী গম্ভীর বাহিনী,
মৃত্যুর অমোঘ ক্রীড়া বৃক্ষে, গুল্মে, তৃণে
এক সুর, সরল কাহিনী।”
শরতের স্লান বিল
শরতের স্লান বিল
কী ভারী স্বপ্ন দ্যাখো তুমি বারে-বারে
বসন্ত-সাদা দ্বীপ
ডুবেছে যা পারাবারে।
শরতের স্লান বিল,
লুকায় তোমার বীচি,
তোমার আয়না ভুলে যায় যত
শুভদিন হারিয়েছি।
শরতের স্লান বিল
উচু আকাশেরে হাল্কা, নীরব বহে,
ক্ষণেকের তরে জীবন-মরণ
ঘুম-ঘুম চোখে চুম্বন করে দোঁহে।
(Pale Lake of Autumn)
হেমন্ত
তোমার বাড়ির চারিধারে ন্যাড়া গাছ
হাওয়া আর রোদ কভু বোধ করে নি তো,
বড়-বড় পায়ে ন্যাড়া গাছগুলি যায়
জলের কিনারে, জলে হ’তে বিস্বিত।
শিশুটি খেলেছে হেমন্ত-কুয়াশায়,
ফুল হাতে নিয়ে মেয়েটি চলেছে একা,
দূরে যেইখানে শেষ হ’ল নীলাকাশ
রুপালি-সফেদ পাখিরা মেলেছে পাখা।
(Autumn)
কালো বা সাদা
সেতুদের নীচে নদীগুলি ব’য়ে যায়,
পথপাশে ফুল করে সব রোশনাই,
মাঠেদের কানে, ফিসফিস করে নু’য়ে-নু’য়ে পড়ে বন।
আমার জন্য উচুনিচু কিছু নাই,
অথবা কালো বা সাদা,
সেইদিন থেকে, যখন ধবল পোশাকের এক নারী
দেখেছি আমার প্রিয়ের বাহুতে বাঁধা।
(Black or White)
তারার ঝাঁক
রাত্রি এলে
আমি দাঁড়াই সিঁড়িতে আর শুনি
অযুত তারার গুনগুনুনি আমার বাগানটিতে
এবং আমি আঁধারে দাঁড়ানো।
ঐ খশল একটা তারা ঠুং ক’রে!
খালি-পায়ে হাঁটিস না রে ঘাসে;
বাগান ভ’রে আছে ভাঙা-কাচে।
(The Stars)
বুড়ো আংলো
খুদে বুড়োটি গ’নছে ব’সে ডিম।
প্রতিবারেই একটা ডিম কম।
তাকে তোদের সোনা দেখাস নে রে,
বন্ধুরা আমার।
(The Little Old Man)
ফেনা
জীবনের শ্যাম্পেনে
বুদ্বুদ করি পান
হাল্কা ফেনার মতো
শ্যাম্পেনের পরান …
শ্যাম্পেনের নয়ান-
আকাশ ইশারা হানে
শ্যাম্পেনের চরণ-
চলো তারাদের টানে
শ্যাম্পেন-ভূত, হাতে
গেলাস বিলাসে মাতে!
(Foam)
নিটশের সমাধিতে
পাকা শিকারিটা আজ মৃত…
আমি তার গোরটিকে ঢেকে দিই ফুলের ঝালরে….
ঠাণ্ডা পাথরটাকে চুমু খেয়ে বলি:
সুখের চোখের জলে ভেজা, দ্যাখো, এ তোমার প্রথম সন্তান।
একটু ঠাট্টাভরে বসি তোমার কবরে
গালে যেন চড় এক– যেমন দেখেছে স্বপ্নে, চাবু তারও চেয়ে।
হে অদ্ভুত পিত:!
তোমার সন্তানেরা করবে না তোমার মাথা হেট।
তারা আসছে সারা পৃথিবীর থেকে, দেবতার পদাঙ্ক মাড়িয়ে,
চোখ কচলে বলছে তারা : কোথায় এলাম?
না, সত্যিই … এ-ই মোকাম আমার,
এই ভগ্নদশা গোরে আমার পিতার…
ঈশ্বর- অনন্তদৃষ্টি রেখো এই জায়গার উপর।
(At Nietzsche’s Grave)
ষাঁড়
ষাঁড় কোথায়?
আমি লাল-কাপড় এই পালায়।
দেখি না খুন-টগবগ চোখ,
শুনি না দ্রুত এবং আগুনে নিশ্বাস,
কাঁপে কি ক্রুদ্ধ খুরের তলায় রিং-এর জমি?
না।
এ-ষাঁড়ের নাই কোনো শিং; সে যে
রয়েছে দাঁড়িয়ে আস্তাবলে,
চিবিয়ে যাচ্ছে শক্ত খড়।
পৎপৎ উড়ছে হাওয়ায় অনাহত কড়া-লাল কাপড়।
(The Bull)
শিল্পীর ভেংচি
খেলাতখানি-ছাড়া আমার আর-কিছু যে নেই,
আমার এ-লাল নির্ভীকতা-ছাড়া।
আমার এ-লাল নির্ভীকতা রয় অভিযানেই
ব্যস্ত, দিবারাত্রি বল্গাহারা।
বগোল-তলায় এই দোতারা, সম্বল আমার এ যে,
আমার তুখোড় দোতারা-বাদন;
আমার তুখোড় দোতারাটা পথে-পথে বেজে
রাঙায় মানুষ আর পশুদের মন।
এই উঁচু মাথাটি নইলে, আমার সবই মিছে,
এ-উত্তুঙ্গ গর্বটুকু হায়,
এ-উত্তুঙ্গ, গর্বটুকু নেয় বগোলের নীচে
দোতারাটা– এবং চ’লে যায়।
(Grimace d’ Artiste)
কুমারীর মৃত্যু
এই শুদ্ধা কুমারীর আত্মটি বোঝে নি কোনো ভুল,
সবই জানত নিজের বিষয়ে,
তদুপরি জানত সে তো অন্যদের আর সমুদ্রের বাবদেও।
দু’চোখ পিয়াল তার, ঠোট-দু’টি গুঞ্জাফল, হাতগুলি মোমের।
হাঁটু মুড়ে ঘুরে প’ড়ে গেল সে তো মাটিতে মিশিয়ে।
সে চ’লে যাবার পর, দেহটি যে বনে প’ড়ে রয়েছে তা জানল না তো কেউ….
খুঁজেছিল তারা তাকে সমুদ্রপারের কুমারীদের ভিতরে,
শুক্তির ভিতরকার নরম ঝিনুক নিয়ে গাইত যারা গান।
অনেক খুঁজেছে তারা তাকে যত মাতালের মেলে,
মাতত যারা কাজিয়ায় জমিদার-হেঁশেলের ছুরি-চাকু নিয়ে।
দোলনচাঁপার মাঠে তাকে তারা খুঁজেছে অনেক
যেখানে আগের রাত থেকে তার একপাটি চপ্পল ছিল প’ড়ে।
(The Death of the Maiden)
জ্যোতির্বলয়েরা
আমার শক্তি আছে। আমি ডরাই না তো কিছু।
আকাশ আমার কাছে হাল্কা খড়।
দুনিয়াটা ফানা হ’লে তবু-
আমি টিকে থাকব একেশ্বর।
ধরার ঝড়েভরা রাতের ‘পরে
আমার হাল্কা দিগন্তেরা ঠায়।
ভানুমতির থেকে বেরোও, জ্যোতির্বলয়েরা!
অনড়, আমার শক্তি অপেক্ষায়।
(The Fields of Light)
আমার নকল ফুলগুলি
নকল ফুলগুলি আমারঃ
তোমার ঘরে আমি পাঠিয়ে দেব,
আমার পিতলের সিংহগুলিকে
তোমার দরজায় বসাব।
বসব আমি নিজে সিঁড়িতে-
প্রাচ্য পৃথিবীর একটা হৃত মৌক্তিক
বিশাল শহরের ঝ’ড়ো সায়রে।
(My Artificial Flowers)
সৌরজগৎ পেরোতে হয়েছে আমার
পায়দল
সৌরজগৎ পেরোতে হয়েছে আমার
পয়লা সুতাটা খুঁজে পেতে গিয়ে আমার এ-লাল জামার।
নিজেকেও আমি দেখতে পাচ্ছি অবিকল।
আমার হৃদয় ঐ তো ঝুলছে মহাকাশে কোনোখানে,
ধুকপুকে মহাশূন্য কাঁপছে, ছুটতেছে বামে-ডানেঃ
ফুলকি-উল্কা কট্টর আরও কত-না হৃদয় পানে।
(On Foot I Had to Cross the Solar System)
হিমালয়ের ধাপে-ধাপে
হিমালয়ের ধাপে-ধাপে
মহান্ বিষ্ণু ব’সে
স্বপ্ন দেখে যায়
হিমালয়কে ঘিরে-রাখা অনন্ত প্রদোষে।
শ্বেত বস্ত্রে দাঁড়িয়ে কাঁপে
তীর্থযাত্রী, ক্ষুদ্র, এমন বেগুনি আভায়।
সর্বশক্তিমান, হরণ
করো আমার প্রাণ তোমার
এক-পলকের স্বপ্ন-লাগি, স্বামিন!
বারেক জানব তোমার ইচ্ছা–তারপর নাই হয়ে যাব আমি….
(On the Steps of the Himalayas)
মন্তর
কীভাবে গভীরতম হৃদয়ের থেকে আমি বলব তোমাদের?
দেবতারা কী করে তাদের শব্দগুলিকে সাজায়, তাল্কা, আর তবু অপ্রতিহত?
কী প্রকারে বললে পরে মানবিক দুর্বলতা করবে না মাজুল শব্দদের?
এবং আমার ইচ্ছা তোমাদের পাকড়ে ধরে যেন সাঁড়াশিতে
ব্যথা, ভীতি, বা প্রেমের মতো ….
আমার ইচ্ছার কাছে তোমাদের হীনবল ক’রে ফেলতে চাই।
আমি চাই ছিঁড়ে-ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফ্যালো তোমাদের হৃৎপিণ্ডগুলিকে,
শয়তানের অধিষ্ঠান হোক তোমাদের হাতে-পায়ে
বুনো ও অমানুষিক, আজীবন বিস্ফোরণময়।
পিশাচেরা,
কী - যে চাই তোমাদের চোখে রাখতে চোখ,
আমার চানুনিতে চাই আমার পুরেপাটা ভ’রে দিতে।
পিশাচেরা, আকাক্সিক্ষত: আমার ক্ষমতাবলে আমি বশ করব তোমাদের?
সেনালি চুলের টোপ তোমাদের সামনে ছুঁড়ে মারি দয়াহীন,
ফিনকি দিয়ে ছুটে যায় আমার রক্তের মোটা ধারা।
তোমরা কি আমার কাছে আসবে, ওগো পাতালের রক্তচোষারা?
(The Charm)
ট্যান্টালাস, ভরহ সুরাহি
এসব কবিতা নাকি? না, এরা চিরকুট শুধু, ছেঁড়া টুকরা-টাকরা,
নানা কেজো কাগজের স্লিপ।
ট্যান্টালাস, ভরহ সুরাহি।
অসম্ভব, ওগো অসম্ভব,
মরার সময় ছুঁড়ে ফেলে যাব আমার চুলের মালাখানি
তোমার অশেষ শূন্যতায়।
(Tantalus, Fill Your Beaker)
কী আমার মাতৃভূমি?
কী আমার মাতৃভূমি? সে কি বহু-দূর, তারা-খাচা
ফিনল্যান্ড? সে যা-ই হোক। চটাল তটের ‘পরে নিচু
পাথর গড়ায়। সেই ধুসর গ্র্যানিটে আমি ঠায়
এক স্থিরতায় যেন। হে স্থিরতা, গোলাপ ও লরেল
ছড়াও আমার পথে। আমি সেই গর্বিত দেবতা
তব দ্বারে। আমি সেই আশীর্ময় অতীত-বিজয়ী।
(What Is My Homeland?)
রূপান্তর
এ কী আশীর্বাদ এই প্রবল হাওয়ায়…..
শাশ্বতের অনন্ত চুম্বন…
কীভাবে রুফান্তরিত হয়েছে জীবন আর হ’য়ে গেছে স্থির,
ভ্রান্তি-জাগানিয়া-রুপে স্থির…
রূপকথার পয়মন্ত রাজকন্যা ওগো,
তোমার হৃদয়ে ঝড়ে তীব্রতর সমুদ্রের ঝড়ের চেয়েও।
এমন হৃদয় কেউ অকারণে বয় নাকি বুকে?
সময়, আমার গান শোনো!
পতিত আত্মারা গায় নরকে যখন এরকম,
কখনও স্বর্গের থেকে ফিরে আসে তার প্রতিধ্বনি।
না হৃদয়, তুমি যাচ্ছ অগ্নিবলয়ের মধ্যে দিয়ে!
আমার দৈবত রূপ–একে কি পারে না ভয় দেখাতে নিয়তি?
আমার হাতছানি পারে অবহেলা করতে খুদে ভাগ্যের ভূতেরা?
আমি যদি ডাকি তবে ভবিষ্যৎ না-এসে কি পারে?
(Metamorphosis)
হে মহান কন্দর্প
মহান কন্দর্প ওহে! তুমি শ্বাস টানো বিবাহের,
কিন্তু কী-প্রকার বিবাহের?
যবে হতে এ-পৃথিবী; কামনা বিবাহে সাধে দু’টি
শরীর; অশনিবাণ পশে নি কোনোই
মানবের ভালে।
ঐ যে ঝলক হানে বিজুলি-চাবুক,
অমিত ক্ষমতা এই অশনিবাণের,
আপন খেয়ালে হায় এ - অশনি মনুষ্যশিশুর শিরে ঝরে।
(Thou Great Eros)
বিজুলি
মেঘে-মোড়া ওগো সৌদামিনী,
যে-নীল বিজুলি দেখেই চিনি,
কবে মেঘ ফেড়ে হবে বাহির?
বাতেনি বিজুলি, হবে জাহির
শুচিকর, ভীম বজ্রসহ-
আমি স’য়ে চলি তব বিরহ।
ন্যাকড়ার মতো দেহটা শো’য়া
যেন কোনো বৈদ্যুতিক ছোঁয়ায়ঃ
চকমকি-দড় হ’য়ে সে পারে
নিজেও বিজুলি চমকাবারে।
(Lightning)
হুশিয়ারি
সকল ঐশ্বর্যের ঐশ্বর্য, আমার শরীর,
কেমন ক’রে জানো কত শক্তি তোমার তাঁবেয়?
আমার বাহু–এর দরকার আছে শতাব্দীর।
আমার বাহু– এর দরকার আছে শতাব্দীর।
আমার হাতে বিজুলি আছে, একদিন জলসাবে।
এর নীল-নীল আলোয় লোকের টাসকি লাগবে মনে।
আমি যাদের অন্যতম, তারাও প্রবল ঢের,
কিন্তু আমি সে-বর্ম যা খুঁজছে জগজ্জনে,
আমিই সে-বিচিটি, এবং সূত্র যোগাযোগের।
(Premonition)
সূর্য
আমি আনন্দময়।
ভোরের বেপরোয়া সূর্য, আমার মুখে জ্বলো, কপালে বুলিয়ে যাও ছোঁয়া।
না, তুমি এরই মধ্যে শুনেছ আমার গর্বিত হৃদয়ের উত্তর।
সূর্যের প্রতিটি আবর্তনে উদ্ধততর হৃদয় আমার।
যেন আমি সৌর পিরিচটিকে নিয়েছিলাম হাতের মুঠায়
তাকে গুঁড়িয়ে ফেলব ব’লে।
যেন পৃথিবীতে এক আকস্মিক অভ্যাগত আমি, পথচলতি ঢুকে পড়েছি চুপিসারে
এক সহসা বিদ্রুপ-বৃষ্টিতে একে জাগিয়ে তুলতে।
ওগো দুর্বিনীততম হৃদয়, বাহুগুলি মেলে ধরো সূর্যের দিকে,
হাঁটু গেড়ে বসো, আর তোমার বুকটাকে ছিঁড়ে সূর্য ঢুকে যাক– সূর্য।
(Sun)
শাহি বাগিচা
আমরা সবাই হাঘর বাউণ্ডুলে
আর আমরা ভাই-বোন।
বস্তা-পিঠে চলি আদুল-গায়ে,
কিন্তু আমাদের তুলনায় শাহ্জাদাদের কীইবা আছে ধন?
হাওয়ায় নিত্যি উড়ে আসে কতই কিমতি চিজ,
সোনার দরেও হয় না তাদের মূল্য নিরূপণ।
বয়স যত বাড়ে আমাদের
ততই পষ্টাপষ্টি বুঝি আমরা যে ভাই-বোন।
সৃষ্টিকে তো আমাদের আর কিছুই দেওয়ার নাই,
আমরা তাকে দিয়েছিলাম আত্মা-সবেধন।
আমার যদি থাকত নিজের এক শাহি বাগিচা
করতাম আমার ভাই-বোনদের সেথায় নিমন্ত্রণ।
প্রতিজনাই ফিরত একটা জবর তোফা-হাতে।
বেঘরেরা করত একটা গোত্রের পত্তন।
আমরা বেড়া তুলে দিতাম বাগানের চৌধারে
বাইরের সব ধমক যাতে ঢুকে প’ড়ে না করে গর্জন।
আমাদের ঐ নীরব বাগিচায়
পৃথিবীকে আমরা দিতাম নোতুন এক জীবন।
(The Great Garden)
বিজুলির সাধ
আমি এক বাজপাখি,
এ-ই আমি করি একরার।
কবি নয়,
কখনোই নয় কিছু-আর।
বলতেকি, ঘৃণা করি আর-সবকিছু।
বাজের ওড়ার পথে পাক খাওয়া-ছাড়া আমি কিছু বুঝি না তো।
কী ঘটনা ঘটে এই বাজের ওড়ায়?
সদা-অভিন্ন, শাশ্বত।
অধীর দোহদে এক বিজুলি আকাশ ফ্যালে চিরে
গোপন পিরিতি-ভরে, যেন জন্মাবে এক নয়া পৃথিবীরে।
(The Lightning’s Yearning)
(সৌজন্যেঃ আর্টসবিডিনিউজ২৪)