গানের ভেতর দিয়ে বাঙালির সৃজনশীলতা বিকাশে যে পাঁচজন গীতিকবি বিশেষ অবদান রেখেছেন তাঁদের সৃষ্ট গান নিয়েই আমার লেখা। বাংলা গানের এই পঞ্চকের জন্ম উনবিংশ শতকে আর লালন ও বিকাশ বিংশ শতাব্দীতে। বাংলা গানের এই মহান পঞ্চকের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (যিনি ডি. এল. রায় নামে সুপরিচিত), রজনীকান্ত সেন (যিনি কান্ত কবি নামে খ্যাত), অতুলপ্রসাদ সেন এবং কাজী নজরুল ইসলাম। পাঁচজনের তিনজন জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গে, তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং কাজী নজরুল ইসলাম। বাকি দু’জন রজনীকান্ত সেন ও অতুলপ্রসাদ সেনের জন্ম পূর্ববঙ্গে, বর্তমান বাংলাদেশে।
অজস্র গান রচনা ও সুরারোপের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা গানের ভান্ডারকে করে গেছেন সমৃদ্ধ। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বাংলা গান তাঁদেরই অবাদন। বৈচিত্রময় তাঁদের রচনা আর মাধূর্যমন্ডিত সুরে সমৃদ্ধ তাঁদের গান। বাংলাদেশের ঐতিহ্য তাদের গানে রূপায়িত হয়েছে স্ব-মহিমায়। বিষয়বস্তুর বৈচিত্রে সে সকল গান হয়ে আছে অতুলনীয়। রচনা ও সুরের আঙ্গিক, গায়কী, রূপের প্রকাশ তাঁদের গানগুলোকে মহিমান্বিত করে তুলেছেন। তাঁরা গান লিখেছেন, সুর করেছেন এবং গান গেয়েছেন স্বকন্ঠে। অনেক গুণে তাঁরা ছিলেন গুণান্বিত। একই সময়ে একই সঙ্গে সকল প্রতিভার অধিকারী হয়ে তাঁদের আবির্ভাব সঙ্গীত জগতে এক বিরল ঘটনা। তাঁদের সঙ্গীত জীবনের কথা পৃথক পৃথক ভাবে আলোচনা করলেই এই সত্য স্পষ্ট হবে। প্রথমেই রবীন্দ্রনাথ...।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:
কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কারক। মূলত কবি হিসেবেই তাঁর প্রতিভা বিশ্বময় স্বীকৃত। ১৯১৩ সালে তাঁকে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। এশিয়ার বিদগ্ধ ও বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই রুরষ্কার জয়ের গৌরব অর্জন করেন। যুগে যুগে পৃথিবীতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে রুপান্তর ঘটেছে, রবীন্দ্রনাথ সবকিছুকেই আত্মস্থ করেছেন গভীর অনুশীলন, ক্রমাগত নিরীক্ষা এবং বিশ্বপরিক্রমার মধ্যে দিয়ে। তাই তাঁর সাহিত্য জীবনের নানা পর্যায়ে বিষয় ও আঙ্গিকের নিরন্তর পালাবদল লক্ষণীয়। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ভ্রমনকাহিনী, চিঠিপত্র এবং দেশে বিদেশে প্রদত্ত বক্তৃতামালা। রবীন্দ্রনাথ কেবল তাঁর কালের কবি নন, তিনি কালজয়ী। বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর আর্বিভাব ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে, ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুর পরিবারে। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং মা সারদা দেবী। এই পরিবারের পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গ থেকে ব্যবসায়ের সূত্রে কলকাতায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। উনিশ শতকের বাঙালির নবজাগরণ এবং ধর্ম ও সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য।
রবীন্দ্রসঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল জীবনের এক বিশেষ কীর্তি। কবে তিনি প্রথম গান রচনা করেন, তা নিয়ে মতভেদ আছে। কারও মতে ১২ বছর বয়সে আবার আরও মতে ১৮৭৫ সালে ১৪ বছর বয়সে তাঁর প্রথম গান লেখার সূচনা। এ সময়ে তিনি অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সরোজিনী নাটকের জন্য ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুন দ্বিগুন’ গানটি রচনা করেন। জীবনের শেষ জন্মদিনের জন্য তিনি রচনা করেন ‘হে নূতন, দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’ গানটি। এটি রচিত হয়েছিল ২৩ শে বৈশাখ ১৩৪৮ (৭ মে ১৯৪১), অর্থাৎ ৬৮ বছর যাবৎ রবীন্দ্রনাথ গান রচনা করেছেন। তাঁর গানের সংখ্যা ২২৩২ এবং সেগুলি অখন্ড ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালে বিষ্ণুপুর ঘরানার একাধিক ওস্তাদ ঠাকুর বাড়িতে শিক্ষাগুরু হিসেবে এসেছিলেন। তিনি গান শিখেছেন শ্রীকন্ঠ সিংহ, অক্ষয় চৌধুরী আর বিহারীলাল চক্রবর্তীর নিকট। তবে সঙ্গীতের আসরে রবীন্দ্রনাথের গানের শিক্ষাগুরু বিষ্ণু চক্রবর্তী। এছাড়াও রাধিকা গোস্বামীর কাছে সরাসনি না হলেও শ্রোতা হিসেবে অনেক গান শিখেছেন। তাঁদের মধ্যে বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তী এবং রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী রবীন্দ্রনাথের মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতে ধ্র“পদের প্রবল প্রভাব রয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ এই চার তুকের বহুল ব্যবহার এসেছে ধ্র“পদের অনুসরণে। রবীন্দ্রনাথ একই গানে বিভিন্ন রাগরাগিণী ব্যবহার করে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে’ গানটিতে তিনি ললিত, বিভাস, যোগিয়া এবং আশাবরী রাগের আভাস রয়েছে। লোকসুরের গানেরও রাগের মিশ্রন ঘটিয়ে রবীন্দ্রনাথ চমৎকার শিল্প সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। সুরের দিক থেকে আর একটি অঙ্গ রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছে, সেটি হলো ‘টপ্পা’। বাঙালির ভাবাবেগ প্রকাশে টপ্পার ব্যবহার সার্থক হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের স্বকীয় টপ্পার গায়নে সহযোগ দেখা যায়না। রবীন্দ্র-টপ্পাতে লোকসুরের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতে রাগ-রাগিণীভিত্তিক ধ্র“পদ, খেয়াল, ঠুমরি, তেলেনা ও টপ্পা ছাড়া অন্য যে সঙ্গীতের প্রভাব স্মরণীয় তা হচ্ছে বাংলার লোকসঙ্গীত। বাউল, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, সারি, এমনকি কথকতা থেকেও রবীন্দ্রনাথ সুর আর ভঙ্গি গ্রহণ করে তাঁর গানে দেশীয় সৌন্দর্য ও মাধুর্য সঞ্চার করেছেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বেশকিছু বাউল সুরের স্বদেশি গান রচনা করেন। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতটি সে সময়েই রচিত। এই গানটি কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউল গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটির সুরে রচিত। বাউল সুরাশ্রিত আরও কয়েকটি বিখ্যাত গান হলো: ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘আমি ভয় করবো না’ ইত্যাদি। সঙ্গীত প্রসঙ্গে সুরের পরেই আসে ছন্দ ও তালের কথা। চৌতাল, আড়া চৌতাল, ধামার, আড়াঠেকা, সুরফাঁক্তা, যৎ, ঝাঁপতাল, ত্রিতাল, একতাল, তেওড়া ইত্যাদি তালে রবীন্দ্রনাথ গুরুগম্ভীর সঙ্গীত রচনা করেছেন। দাদরা, কাহারবা, আড়খেমটা তালেও অনেক গান রচিত হয়েছে। এছাড়াও ষষ্ঠী, ঝম্পক, রূপক্রা, নবতাল, একাদশী এবং নবপঞ্চতাল নামে নতুন ছয়টি তাল রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। একই গানে একাধিক তালবিন্যাসগুনেও রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষভাবে সমৃদ্ধ।
সঙ্গীতে সাধারণত সুর ও তালের প্রাধান্য থাকে বেশী, রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো কাব্যগীতি বা বাণীপ্রধান গানে বাণীর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীর বৈচিত্র বাঙালি জীবনের বিচিত্র ভাবগতিকে ধরে রেখেছে। তাঁর গানের প্রধান এবং শেষতম সংকলন গীতবিতানে গানের নানা পর্ব-বিভাগ রয়েছে। তাঁর ভক্তিমূলক গানগুলিকে ‘পূজা’ শিরোনামে এবং ঋতুসঙ্গীতগুলিকে ‘প্রকৃতি’ শিরোনামে বিন্যাস্ত হয়েছে। এরপরে আসে প্রেম ও প্রেমবৈচিত্রের গান, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ও অন্যান্য গান’। বিষয়গুলিকে পূজা-প্রেম-প্রকৃতি-স্বদেশ-আনুষ্ঠানিক-বিচিত্র ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের আনুষ্ঠানিক গানের বিষয়বৈচিত্র বিস্ময়কর। বিবাহ, জন্ম-মৃত্যু, গৃহপ্রবেশ, বৃক্ষরোপন, হলকর্ষণ, নলকূপ স্থাপন, রাখিবন্ধন, সমাবর্তন, অনুষ্ঠান উদ্বোধন, ফসল-কাটা এমনকি মেয়েদের যুযুৎসু শিক্ষা (সঙ্কোচন বিহ্বলতা) উপলক্ষেও তিনি গান লিখেছেন। ফলে, বাঙালির সুখে-শোকে-কর্মে রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে উঠেছে অপরিহার্য।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত রচনার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কালবিভাগ করা যায়। এই কালবিভাগে কয়েকটি স্তর পরিদৃষ্ট হয়। এই স্তর বিভাগে দেখা যায় তাঁর রচনার মধ্যে বিশেষ বিশেষ যুগে নিয়ম ও শৃঙ্খলাবোধ যেন স্বনিয়মে কার্যকরী হয়েছে। প্রথমযুগে লোকসঙ্গীত ও রাগসঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। এই যুগে ধর্মীয় গানে কাব্য সচেতনতা পরিষ্ফুটন হয়েছে। গানে এসেছে বিশ্বজীবন ও প্রকৃতি, সুরে এসেছে লোক প্রচলিত গানের ঢং। তাঁর গানে কাব্য ও সুরের তাৎপর্যমূলক মিলন হয়েছে। দ্বিতীয় স্তরে বাংলার নানা প্রচলিত সঙ্গীত তাঁর গানে নতুন ভাবধারার প্রবর্তন করেছে, তাঁর সঙ্গে সৃষ্টিমূলক রচনার ব্যক্তিগত ঢংয়ের প্রকাশ ঘটেছে। তৃতীয় পর্যায়ে কবিমানস এবং সঙ্গীতে মনের মিলন ঘটেছে। এসময়ে রচিত গানে কাব্যিক ভাবধারার অন্তর্মূখী প্রকাশ, কথা ও সুরের সহজ গাঁথুনি একটা নতুন পরিমন্ডল সৃষ্টি করেছে। এথেকে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, রবীন্দ্রনাথের গান রচনার বৈশিষ্ট্য কাল অনুসারে স্বাভাবিত ভাবেই বিবর্তিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের উক্তির মধ্যেই সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধির পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘সঙ্গীত একটি প্রাণধর্মী জিনিস এবয় প্রাণের বিকাশ তাঁর মধ্যে আছে।’
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৮৬৩:
আধুনিক কালে শীলিত বাংলাগানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৮৬৩ সালে বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়। কার্তিকেয়চন্দ্র গায়ক ও গীত রচয়িতারূপে যশস্বী ছিলেন। পুরুষাণুক্রমে এঁরা নদীয়ার রাজকার্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উনিশ শতকে বাংলায় রাগ সঙ্গীত চর্চা প্রস্তুতকরণের ব্যাপারে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তাঁর জৈষ্টপূত্র হরলাল রায় সু-গায়ক ছিলেন, কনিষ্ঠ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। শীর্ষস্থানীয় বাঙালী সঙ্গীততত্ত্ববিদ ও সঙ্গীতালোচক, গীতরচয়িতা ও গায়ক দিলীপকুমার রায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পূত্র। এই সঙ্গীত পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কার্তিকেয়চন্দ্র রায়। সুলেখক হিসেবেও তিনি খ্যাত ছিলেন।
পারিবারিক পরিবেশই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সঙ্গীত ও সাহিত্য প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। পিতার অধীনেই তাঁর সঙ্গীত সাধনার সূত্রপাত। ছাত্র হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলাল অত্যান্ত মেধাবী ছিলেন। ১৮৭৮ সালে তিনি কৃষ্ণনগর স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্টিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, এরপর কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে এফ.এ., হুগলী কলেজ থেকে বি.এ. এবং ১৮৮৪ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে এম.এ. পাশ করেন। তাঁরপর কৃষিবিদ্যায় শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে তিনি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড যান। সেখানে থাকাকালে দ্বিজেন্দ্রলাল ইংরেজিতে কবিতা রচনা ছাড়াও পাশ্চাত্য সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেন। প্রথম দিকে পাশ্চাত্য সঙ্গীত দ্বিজেন্দ্রলালের ভাল লাগতো না, কিন্তু ক্রমে তিনি এঁর মর্মানুধাবনে সমর্থ হন ও অর্থ ব্যায় করে সঙ্গীত শিক্ষা নেন। পাশাপাশি অভিনয়কলা ও নাট্যকলা সম্পর্কেও তাঁর সম্যক অভিজ্ঞতা লাভ ঘটে। প্রায় তিন বছর বিলেতে থেকে তিনি দেশে ফিরে আসেন ও ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে কাজে যোগদান করেন। ১৮৮৭ সালে বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালা দেবীকে বিবাহ করেন। এই সময় তিনি বিখ্যাত গায়ক ও সঙ্গীতবিদ সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের সংস্পর্শে আসেন। সুরেন্দ্রনাথের প্রেরণাতেই টপখেয়াল ও টপ্পা অঙ্গে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে থাকেন, গান রচনাতেও উদ্যোগ নেন। পরবতীূকালে তিনি লেখক, গায়ক, ও সঙ্গীত রচয়িতারূপে বিপুল খ্যাতি লাভ করেন। ১৯০৩ সালে তাঁর পতœীবিয়োগ ঘটে। পতœীবিয়োগের পূর্ব পর্যন্ত দ্বিজেন্দ্রলালের সাহিত্য ও সঙ্গীত জীবনের অনন্দময় যুগ। কিন্তু পতœীবিয়োগর পর থেকেই রঙ্গ ও ব্যঙ্গের হাস্যচ্ছ্বল জগৎ থেকে তিনি নিজেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিতে থাকেন। তখন থেকে তার প্রধান সঙ্গীত বিষয় হয় বেদনা ও উদ্দীপনা। ১৯০৫ সালে প্রারম্ভিক বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন দ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ প্রমূখের মত তিনিও স্বাদেশিক সঙ্গীত রচনায় ব্রতী হন। দ্বিজেন্দ্রলালের দেশাত্মোবোধক সঙ্গীত ও ঐতিহাসিক নাটকের স্বাদেশিকতা সে সময় জনমনে প্রেরণার সঞ্চয় করে। তিনি রচনা করেন “ধনধান্য পূষ্পভরা”। সাহিত্য ও সঙ্গীতে স্বাদেশিকতা প্রচারের জন্য ইংরেজ সরকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে পরপর নানা স্থানে বদলি করে বিড়ম্বিত করতে থাকেন। ১৯১২ সালে তিনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন ও পরের বছর চাকরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯১৩ সালের ১মে শনিবার নিজের নাটক “সিংহল বিজয়” এর পান্ডুলিপী সংশোধন করছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, এ অবস্থাতেই তিনি হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়েন। আর জ্ঞান ফেরেনি। দেশের মহিমময় রূপগৌরব, প্রকৃতিক সৌন্দর্য, প্রাচীন জ্ঞানগৌরব, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, ভাষা ও সাহিত্য, প্রাচীন ইতিহাসের শৌর্যগরিমা ও বীরবৃন্দের আত্মোৎসর্গ সমস্তই কবির দেশভক্তিমূলক গানের প্রেরণায় উপজীব্য হয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলালের বাকি সব গান যদি লুপ্ত হয় তবু এই গানগুলি জাতি যতদিন জীবিত থাকবে ততদিন তাঁর জীবনে শক্তি সঞ্চার করবে।
১৮৮২ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রথম সঙ্গীত সঙ্কলন গ্রন্থ আর্যগাথা প্রথমভাগ প্রকাশিত হয়।দ্বিজেন্দ্রবিদ রবীন্দ্রনাথ রায় দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গীতকর্মকে চারস্তরে ভাগ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ রায় ‘আর্যগাথা’ প্রথম ভাগের গানসমূহকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন: ১. প্রকৃতি বিষয়ক; ২. ঈশ্বর বিষয়ক; ৩. বেদনানুভূতি মূলক; ৪. দেশাত্মোবোধক। গ্রন্থে অন্তর্গত গানসমূহ তিনি বারো থেকে সতেরো বছর বয়সের মধ্যে রচনা করেন। ১৮৮৩ সালে গীত সঙ্কলন আর্যগাথা’র দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। পরিণত মানসিকতা নিয়ে লেখা গানগুলো এই ভাগে স্থান পায়। আর্যগাথা দ্বিতীয়ভাগ কাব্যের মূল উৎস নারী প্রেম। কবির স্বপ্নবিহ্বল মনের এমন সুরধর্মী ও আত্মতন্ময় প্রকাশ তাঁর পরবর্তী কাব্যগুলির মধ্যেও দূর্লভ। ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয় হ্যাস্যগীতি সঙ্কলন ‘হাসির গান’। এই গানের মধ্যে ধর্মধ্বজী ভন্ডদের তিনি ব্যঙ্গ করেছেন। সৌখিন ও বাকসর্বস্ব দেশসেবক, ধর্মধ্বজী ভন্ড, ফাঁকিবাজ, ধাপ্পাবাজ, উৎকট ভাবপ্রবন, প্রাচীনপন্থি ও নবীনপন্থি, নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই মুখোশ তিনি উন্মোচন করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল প্যারোডি রচনাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। গভীরভাবের অনেক গান ও কবিতা অবলম্বন করে তিনি প্যারোডি রচনা করেছেন। দেশাত্মোবোধক, প্রেম ও হাস্য এই তিনটি বিষয় হচ্ছে দ্বিজেন্দ্রলালের গানের প্রধান তিন বিষয়। নিসর্গ কখনও দেশাত্মোবোধ, কখনও প্রেমের সাথে মিশে যুক্ত হয়েছে তাঁর গানে। জীবনের শেষ পর্বে তিনি কতিপয় ভক্তিগীতিও রচনা করেন।
জন্মধন্যতাবোধ, দেশগৌরব, দেশের নিসর্গ শোভা, দেশের দূর্দশায় দুঃখবোধ, মাতৃভাষাপ্রীতি প্রভৃতি বিষয় তিনি তাঁর গানে রচনা করেছেন। সুর রচনার ব্যাপারে তিনি পৃথক রীতি অনুসরণ করেছেন। রাগ সঙ্গীত রীতির সঙ্গে পাশ্চাত্য সুর প্রয়োগরীতির মিশ্রন ঘটিয়ে সুরবাহিত উদ্দীপনার নতুন ব্যঞ্জনা করেছেন। বাংলা কাব্যগীতিতে রাগসুরের সঙ্গে বাউলাঙ্গ সুরের অসামান্য পথিকৃৎ ব্যবহার দেখা যায় “ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে” গানটিতে দ্বিজেন্দ্রলালের সুরের মধ্যে, তাঁর রচনা কৌশলের মধ্যে, প্রেরণা ও অভিব্যক্তির মধ্যে, সৃষ্টির বিচিত্র ভঙ্গির মধ্যে পাওয়া যায় এই সত্যের সন্ধানÑযা না থাকলে গান যুগোত্তীর্ণ হতো না; কালোত্তীর্ণ হতো না। দ্বিজেন্দ্রলালের প্রাণ মাতানো স্বদেশি গান বা দেশাত্মোবোধক গান যেমন, ধনধান্য পূষ্প ভারা; বঙ্গ আমার জননী আমার ভারত আমার; যে দিন সুনীল জলধি হইতে গান গুলো এক সময়ে দেশের আবাল বৃদ্ধ বনিতাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতো-আভিভূত করতো। আজকে হয়তো রাষ্ট্রীয় সাতন্ত্রবোধ নতুন করে জাগিয়ে তোলবার জন্য এই সমস্ত গান সেদিনকার মতো উদ্দীপনা আনবেনা, কিন্তু এই সমস্ত গানের ছত্রে ছত্রে এবং সুরের ব্যঞ্জনার মধ্যে যে দৃঢ়তা, যে আত্মপ্রতিষ্ঠা, যে পৌরষ্য এবং প্রেম, স্বার্থক রচনা কৌশল প্রকাশ করেছেন তা সর্বযুগের সর্বকালের জন্য।
রজনীকান্ত সেন:
বাংলা কাব্য সঙ্গীতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন কান্তকবি নামে খ্যাত রজনীকান্ত সেন। সুমধূর ভক্তিসঙ্গীত ও উদ্দীপনাপূর্ণ স্বদেশি সঙ্গীত রচনার জন্য তিনি খ্যাতি লাভ করেছেন। তবে ভক্তি সঙ্গীত রচয়িতা রূপেই তিনি বাংলা গানের ইতিহাসে অধিকতর স্থায়ী আসনটি অধিকার করে করেন। বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামে ১৮৬৫ সালে রজনীকান্ত জন্মগ্রহণ করেন। পিতা গুরুপ্রসাদ সেন, মাতা মনোমোহিনী দেবী। রাজশাহী থেকে ১৮৮২ সালে রজনীকান্ত প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন; সেখান থেকে এফ.এ. পাশ করে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য কলকাতায় যান; সেখান থেকে বি.এ. ও বি.এল. পাশ করে তিনি রাজশাহীতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সেখানে আইন ব্যবসা শুরু করেন। সঙ্গীতে কোন প্রথাবদ্ধ শিক্ষা ছিলনা রজনীকান্তের। বাল্যবন্ধু সুগায়ক তারকেশ্বর চক্রবর্তীর সাহচর্যে তিনি যা একটু সঙ্গীত অভ্যাস করেছিলেন। রাজশাহীতে কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর থেকেই তিনি সঙ্গীতকার ও গায়করূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৮৯৪ বা ১৮৯৫ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কোন এক কাজে রাজশাহীতে গেলে তাঁর হাস্যগীতি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন এবং রজনীকান্ত নিজেও হাস্যগীতি রচনায় মনোনিবেশ করেন। এর পরেই আসে রজনীকান্তের জীবনে স্বদেশি সঙ্গীতের যুগ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা বাংলায় দেশাত্মোবোধক সঙ্গীত রচনায় যে প্লাবন বয়ে যায় রজনীকান্ত তাতে অংশগ্রহণ করেন এবং স্বদেশি চেতনার নানা দিক অবলম্বনে গান রচনা করেন। কবির জীবনে এর পরেই বিষাদের কালো ছায়া নেমে আসে। পূত্র ও কন্যা বিয়োগের যন্ত্রণা সহ্য করে উঠতে না উঠতেই তিনি মূত্রকৃচ্ছতা ও পরে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হন। তবে সঙ্গীতে বিরাম ঘটেনি তখনও। কন্ঠস্বর রুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত তিনি গানও গেয়ে চলেছেন। এই সময় রজকান্ত অনেক ভক্তিগীতি রচনা করেন।
রজনীকান্ত সেন রচিত গ্রন্থ সংখ্যা আটটি। তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তিনটি ও মৃত্যুর পরে পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলো হচ্ছে “বাণী” (কাব্যগ্রন্থ)১৯০২, “কল্যাণী” (কাব্যগ্রন্থ)১৯০৫, “অমৃত” (নীতিকবিতা)১৯১০, “আনন্দময়ী” (আগমনী ও বিজয়াসঙ্গীত)১৯১০, “বিশ্রাম” (কাব্যগ্রন্থ)১৯১০, “অভয়া” (কাব্যগ্রন্থ)১৯১০, “সদ্ভাবকুসুম” (নীতিকবিতা)১৯১৩ ও “শেষদান” (কাব্যগ্রন্থ)১৯২৭। তাঁর রচিত গান সমূহ বাণী, কল্যাণী, আনন্দময়ী, অভয়া, শেষদান প্রতৃতি কাব্যে অন্তর্ভূক্ত হয়। সংখ্যায় রজনীকান্তের গান ৩০০ এর মত। রজনীকান্ত সেনের সঙ্গীত রচনাকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ হয়ে থাকে। স্বদেশি গান, হাসির হান ও ভক্তিগীতি। প্রেমের গানও রচনা করেছিলেন কিছু তবে সেসব অপেক্ষা ভক্তিগীতি ও স্বদেশি গানই কলোত্তীর্ণ মর্যাদা অর্জনে সমর্থ হয়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রজনীকান্তের সঙ্গীত রচনার স্বদেশি পর্যায় গঠিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, কালীপ্রসন্ন বাক্যবিশারদ, মুকুন্দ দাস প্রমুখের মতো এই আন্দোলন রজনীকান্ত সেনকেও গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। সেই আন্দোলন কেন্দ্রিক স্বদেশি চেতনার নানাদিক অবলম্বনে তিনি গান রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে দেশীয় পন্য গ্রহণের সংকল্পকে উদ্বোধিত করে তিনি যে গানগুলো রচনা করেন তাঁর মধ্যে “মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই, দিন দুখিনী মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই” গানটি বিপুল খ্যাতি লাভ করে এবং এই গানই তাঁকে দেশ বিখ্যাত করে তোলে। এই গান রচনার সঙ্গে সঙ্গেই রজনীকান্ত বাংলার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেলেন। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির আহ্বান জানিয়ে রজনীকান্ত রচনা করেছিলেন মিলন গান “আয় ছুঁটে আয় হিন্দু মুসলমান” গান। মিলন গান স্বদেশি সঙ্গীতের একটি ধারা রূপে পরিগণিত হয়েছে। রজনীকান্তের “ফুলার কল্লে হুকুম জারি” ও “আমরা নেহাৎ গরীব, আমরা নেহাৎ ছোট” গান দুইটি ইংরেজ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছিল। ভারত কাব্য নিকুঞ্জে, জাগো মঙ্গলময়ী মা, সেথা আমি কি গাহিব গান, জয় জয় জন্মভূমি জননী প্রভৃতি গানেও গভীর দেশবোধ প্রকাশিত হয়েছে। হাস্যগীত রচনা রজনীকান্তের সঙ্গীত কর্মের একটি বিশিষ্ট দিক। তাঁর এই শ্রেণীর রচনার উপর দ্বিজেন্দ্রলালের প্রভাব গভীর। রজনীকান্তের হাসির গানে ব্যঙ্গর কঠিন কষাঘাতের চেয়ে রঙ্গের আনন্দময় কৌতুক বিচ্চুরণ অনেক বেশী। বাংলা কাব্য সঙ্গীতের ধারায় ভক্তিগীতি রচয়িতা রূপেই রজনীকান্তের মূখ্য প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। ঈশ্বরের পদপ্রান্তে আত্মসমর্পনের এমন বিনম্র মধুর গান বাংলায় খুব কমই রচিত হয়েছে। অমৃততৃষ্ণার এমন ব্যকুলতা, পরম সান্ত্বনা, পরম নির্ভরের এমন গীতরূপ বাংলাভাষায় সামান্যই রচিত হয়েছে। দুঃখ যত বেশি পেয়েছেন, যন্ত্রণা যত গভীর হয়েছে, ঐশী করুণাকে তিনি ততই নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরেছেন। কোন অভিমান নেই, কোন ক্ষোভ নেই, জীবনে দুঃসহ বিপর্যয়কেও তিনি ঈশ্বরের দয়ারূপে গণ্য করেছেন এবং সেই বোধকেই রূপায়িত করেছেন এক একটি গানে। ভক্তির অকৃত্রিমতাই হল তাঁর ভক্তিমূলক গানগুলির মূল সম্পদ। তাঁর “বাণী” ও “কল্যাণী” মূখ্যত ভক্তি সঙ্গীতেরই সঙ্কলন। কেন বঞ্চিত হব চরণে কিংবা তুমি অরূপ স্বরূপ সগুন নির্গুণ প্রভৃতি গানে তাঁর ভগবৎ বিশ্বাস সুপরিস্ফুট ও সুপ্রোথিত। তাঁর ভক্তিভাবাত্মক গানের বহু দৃষ্টান্তের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে “তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে’, ‘আমি তোমারে চাহিনি জীবনে’, ‘পাতকী বলিয়ে কীগো পায়ে ঠেলা ভাল হয়’ ইত্যাদি। ধর্মে উদার হিন্দু ছিলেন রজনীকান্ত। ব্রাক্ষ সমাজের প্রতিও তাঁর আকর্ষণ ছিল। পাবনার হরিপুরের জমিদার আশুতোষ চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে রজনীকান্তের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। রাগসুর অবলম্বনেই প্রধানত রজনীকান্ত সুর রচনা করেছেন, কিন্তু রাগরূপের প্রকাশ কলাকে তিনি কখনই প্রাধান্য দেননি। বানীবাহিত ভাবপ্রকাশই হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর সুর রচনার প্রধান লক্ষ্য। রজনীকান্তের সহজ সরল নম্রমধুর ব্যক্তিত্ব তাঁর সুর রচনায় সার্থকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এমন সৌকর্যময় ভাবে ব্যপারটি ঘটেছে যে, সকল সুরের ভেতর থেকে রজনীকান্তের সুরটিকে পৃথক করে চেনা যায়। রাগসুরে রচিত কান্তগীতির মধ্যে রয়েছে, বাগেশ্রী রাগে ‘অনন্ত দিগন্তব্যাপী অনন্ত মহীমা তব’, ভৈরবী রাগে ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে’, কেদারা রাগে ‘ জাগাও পথিকে ও সে ঘুমে অচেতন প্রভৃতি। বাউল সুরে তিনি রচনা করেন, ‘নদী বয়ে যায়’, ‘প্রেমে জল হয়ে যাও গলে’ ইত্যাদি। এছাড়াও মালকোশ, পরজ, বেহাগ, বারোঁয়া, গৌরি, বসন্তবাহার, সুরটমল্লার, মিশ্র খাম্বাজ, মিশ্রপূরবী, নটনারায়ন ও কাফিসিন্ধু ইত্যাদি রাগের উপর অসংখ্য গান রচনা করেন। রজনীকান্তের গানে পাশ্চাত্য প্রভাব খুবই কম, প্রচলিত প্রায় সবধরণের তালই রজনীকান্ত ব্যবহার করেছেন। একতাল, ত্রিতাল, তেওরা, কাওয়ালী, গড়খেমটা, ঝাঁপতাল, আড়খেমটা, যৎ, কাহারবা, মদ্যমান, দাদড়া প্রভৃতি তালের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় কান্তগীতিতে।
অতুলপ্রসাদ সেন:
অতুল প্রসাদ সেনের জন্ম ১৮৭১ সালে ঢাকা জেলায়। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ফরিদপুরের দক্ষিণ বিক্রমপুরের মগর গ্রামে। সঙ্গীত জীবনের শুরু মামাবাড়ীতে। মাতামহ কালী নারায়ন ভক্তি সঙ্গীতের চর্চা করতেন। অতুল প্রসাদের মধ্যে মাতামহের ভক্তিসঙ্গীত রচনার ক্ষমতার সঞ্চারিত হয়েছিল। ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পাশের পর কিছুদিন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যায়ন করেন। তাঁরপর বিলেত থেকে ব্যারিস্টারী পাশ করে তিনি কলকাতা ও রংপুরে আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং পরে লক্ষেèৗতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বাংলাভাষীদের নিকট অতুলপ্রসাদ প্রধানত একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকার হিসেবেই পরিচিত। অতুলপ্রসাদ কর্মজীবনের অবসর মুহূর্তগুলো সঙ্গীত সৃষ্টির কাজে অতিবাহিত করতেন। তিনি ছিলেন প্রধানত গীতিকার ও সুরকার। তিনি প্রেম, প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়ে গান রচনা করেন। ব্যক্তি জীবনের বেদনা সকল ধরণের গানেই কম-বেশী প্রভাব ফেলেছে। এজন্য তাঁর অধিকাংশ গানই হয়ে উঠেছে করুণরস প্রধান। সমকালিন গীতিকারদের তুলনায় অতুলপ্রসাদের সঙ্গীতসংখ্যা সীমিত হলেও তাঁর অনেক গানে সাঙ্গীতিক মৌলিকত্ব পরিলক্ষিত হয়; আর সে কারণেই তিনি বাংলা সঙ্গীত জগতে এক সতন্ত্র আসন লাভ করেন। তাঁর গানগুলি অতুলপ্রসাদের গান নামে প্রতিষ্ঠা পায়। ভালো সঙ্গীতের আসর পেলে তিনি আদালত ও মক্কেলের কথা ভুলে যেতেন। অতুলপ্রসাদ অধিকাংশ গানই লক্ষেèৗতেই রচনা করেন। তাঁর গানের সংখ্যা মাত্র ২০৬ এবং সেসবের মধ্যে মাত্র ৫০-৬০টি গান গীত হয়েছে।
অতুলপ্রসাদের মামাতো বোন সাহানা দেবীর সম্পাদনায় ৭১টি গান স্বরলিপিসহ কাকলি (১৯১৩) নামে দুইখন্ডে প্রকাশিত হয়। তাঁর অপর গানগুলিও “গীতিপুঞ্জ এবং কয়েকটি গান” নামে দুটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। ১৯২২-২৩ সালের দিকে কলকাতা থেকে প্রথম অতুলপ্রসাদের গানের রেকর্ড বের হয় সাহানা দেবী ও হরেন চট্টোপাধ্যায়ের কন্ঠে। বাংলা সঙ্গীতে অতুলপ্রসাদই সর্বপ্রথম ঠমরির চাল সংযোজন করেন। তিনি তাঁর প্রায় সব গানে ঠুমরির লালিত্য ও কমনীয়তা ব্যবহার করে গানের মাধুর্য বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুরকার হিসেবে তিনি ঠুমরির ঢং আয়ত্ব করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে বাংলা গানে ঠুমরির প্রচলন করা কষ্টসাধ্য ছিল না। অতুলপ্রসাদ রাগপ্রধান ঢঙে বাংলা গানে যে সুর সংযোজন করেন, তা পরবর্তীকালে একটি শক্তিশালী ধারা হিসেবে বিকশিত হয়। কাজী নজরুল ইসলামের গান এবং রাগপ্রধান অঙ্গের অন্যান্য আধুনিক গান এভাবে একটি সতন্ত্র ধারা হিসেবে গড়ে ওঠে।
অতুলপসাদের অপর কৃতিত্ব ধ্র“পদ ও কীর্তনের সুরসমন্বয়ে সঙ্গীত রচনা, যেমন ‘জানি জানি হে রঙ্গ রাণী (তিলক প্রমোদ)। তাঁর গানে খাম্বাজরাগের বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও নটমল্লার, নায়কী কানাড়া, কাফি, পিলু প্রভৃতি রাগের মিশ্রণেও তিনি গান রচনা করেছেন। অতুলপ্রসাদের কীর্তন, বাউল এবং রবীন্দ্র আঙ্গিকে রচিত স্বদেশী গানগুলি বাংলা সঙ্গীতের জগতে মর্যাদাপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, যেমন: ‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর’, উঠ গো ভারত লক্ষ্মী’ ইত্যাদি। তার গানের মোহনীয় গুণ শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছিল। গানের ভূবনে অতুলপ্রসাদের রচনা সার্থকতা অর্জনের কারণ হলো: (১) গানের প্রথম কলি বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করে, (২) গানের বাণী রচনায় মুন্সিয়ানা, (৩) সুর সৃষ্টির মৌলিক রীতি, গানের সুরে কীর্তন ও বাউল সুর প্রয়োগ, চমকপদ সুর সংগ্রহ ও প্রয়োগ, সুরের প্রচলিত ঢং গজল, দাদরা, লোকসঙ্গীত ইত্যাদি অবলম্বন করে সুর রচনা এবং (৪) করুণ রসের অভিব্যক্তি প্রকাশ। অতুলপ্রসাদ কতগুলো বাঁধাধরা প্রচলিত রাগের উপর ভিত্তি করে সুর রচনা করেছেন। ভৈরবী, খাম্বাজ, পিলু, বেহাগ, কাফি রাগের সুরে গান সৃষ্টি করে গানে মাধূর্য এনেছেন। তিনি ভাষা রচনায় অত্যান্ত দক্ষ ছিলেন। ভাষা রচনায় তিনি অত্যান্ত স্নিগ্ধ কোমল শব্দ চয়ন করেছেন এবং কথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সুর সৃষ্টি করেছেন। তাছাড়া, তিনি সমসাময়িক বাংলা গানের সঙ্গে সমতা রেখে তাঁর রচিত গানে বিশিষ্ট কাব্যিক রূপ দিয়েছেন। এসকল গুণের জন্যই তাঁর গান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ॥
কাজী নজরুল ইসলাম:
১৮৯৯ সালের ২৪শে মে, বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জৈষ্ঠ মঙ্গলবার বর্ধমার জেলার চুরুলিয়া গ্রামে নজরুলের জন্ম। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমেদ এবং পিতামহ কাজী আমানুল্লা, মাতা জাহেদা খাতুন এবং মাতামহ তোফায়েল আলী। তাঁর পিতামহ এবং পিতা ফকির আহমেদ হাজী পাহলোয়ানের মাজার এবং মসজিদের খাদেম ছিলেন। শিক্ষা জীবন শুরু মাদ্রাসায়। ৯ বৎসরে পিতৃ বিয়োগ। প্রচন্ড দারিদ্রতার কষাঘাতে মাত্র দশ বছর বয়সেই মাদ্রাসার শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ। যাপনকৃত জীবন অত্যান্ত দুঃখের ছিল বলে অনেকেই তাঁকে ‘দুখুমিয়া’ বলে ডাকতেন। পিতৃব্য বজলে করিমের সহচর্যে বাল্যকালেই নজরুল ফারসী চর্চা শুরু করেন। বয়স যখন মাত্র বারো-তেরো তিনি তখন গ্রামের লেটোর দলে ভিড়েছেন, গান লিখেছেন এবং গেয়েছেন। বলতে গেলে ভবিষ্যতের গ্রামোফোনী রাজত্বের সেটা হচ্ছে ভিত্তি স্থাপন। তাঁরপর শিয়ারশোল রাজ এবং বর্ধমানের মাথরুণ হাইস্কুল, সেখান থেকে সেই কোথায় ময়মনসিংহের দড়িরামপুর গ্রামে ছিটকে পড়া, রুটির দোকান, টেবিলের গায়ে তাল বাজানো, দিঘীর পারে-নদীর ধারে শুয়ে নিজের বুকে তাল পিটিয়ে গান গাওয়া, মদনের দোকান পেড়িয়ে রেল লাইনের ধারে শতরঞ্জি বিছিয়ে বাসুদেবদের সাথে গানের মহড়াÑএসবই হচ্ছে কিশোর জীবনের বছর গুলোর কথা। উদ্গত যৌবনে ১৯১৭ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালী পল্টনে যোগ দিয়ে প্রথমে লাহোর, সেখান থেকে নৌরেশা এবং পরে করাচী সেনানিবাসে চলে যান। ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত করাচী অবস্থান কবির কেবল মাত্র সাহিত্য জীবনের ভিত্তি রচনার জন্যই নয়, তাঁর সঙ্গীত জীবনের ভিত্তি রচনায়ও উল্লেখযোগ্য। ‘বিদ্রোহী’ এবং ‘কবি’ নজরুলের আড়ালে নজরুলের অন্যান্য পরিচয় ঢাকা পড়ে গেছে। তিনি বেশবিছু ছোটগল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, নাটক রচনা করেছেন, প্রবন্ধর সংখ্যাও কম নয়। তাঁর জীবনের একটি মূল্যবান সময় কেটেছে সাংবাদিকতায়। পত্রিকার সম্পাদনাও করেছে করেছেন কয়েকটি। অনুবাদের ক্ষেত্রেও তাঁর দক্ষতা স্মরণীয়। সুতরাং নজরুল কেবল বিদ্রোহী এবং কবি ননÑতিনি একাধারে গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, সম্পাদক এবং অনুবাদক। কিন্তু এ ছাড়াও তাঁর একটি বড় পরিচয় তিনি বাংলা সঙ্গীত জগতের একজন মহান পূর্ণসঙ্গীত ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে গীতিকার, গীতিনাট্য রচয়িতা, গায়ক, সুরকার, সুরস্রষ্টা, সঙ্গীত শিক্ষক, সঙ্গীত প্রশিক্ষক। নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবনের (১৯২০-১৯৪২ বাইশ বছর) অর্ধেকের বেশী সময় কেটেছে সঙ্গীত জগতে। নজরুল গীতি: করাচী এসেই একজন পারসী সাহিত্যে সুপন্ডিতের সান্নিধ্যে তিনি পারসী সাহিত্য ও গজলের সাথে পরিচিত হন। সঙ্গীত জীবনের এ অধ্যায় বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরকালে গজলের পারসীয়ানাকে বাংলা সঙ্গীত ঐতিহ্যের সাথে মিশ্রিত করে তিনি বাংলা গজলের যে নতুনধারা নির্মাণ করেছিলেন তাঁর পটভূমি রচিত হয় পল্টন আমলে। আর দ্বিতীয় দিকটি হলো কবির গণচেতনা। বাংলায় মার্চসঙ্গীত বা কুচকাওয়াজের গানের প্রবর্তক হলেন নজরুল। সৈনিক জীবনের শিক্ষা যে তাঁকে এ ধরণের গান লিখতে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করেছে তা বলাই বাহুল্য। তাঁর ‘চল চল চল উর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল’, ‘টলমল টলমল পদভরে বীরদল চলে সমরে’, ‘জাগো আনশন বন্দী উঠরে যত’, ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা’, ‘চলরে চপল তরুণদল বাঁধন হারা’ ইত্যাদি গান মার্চ সঙ্গীতাশ্রয়ী ।
পিতা রবীন্দ্রনাথ
(বাঁ দিক থেকে - কন্যা মীরা দেবী,
ছেলে রথীন্দ্রনাথ, কবি নিজে, পুত্রবধু প্রতিমা দেবী
এবং কন্যা মাধুরীলতা )
বিশ্বজোড়া যার খ্যাতি, ভুবন জুড়ে যার সুনামের ধজ্বা সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নয়, পিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে অনুসন্ধান করব, তারই নিজের ভাষায়, অনুভুতিতে, যা বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেয়েছে। এখানে তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবী ও জামাতা নগেন্দ্রনাথের কিছু পত্রের উল্লেখ করব যার প্রতিটি ছত্রে আমরা পিতা রবীন্দ্রনাথকেই খুঁজে পাব।
৬ জুন, ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবীর বিয়ে হয় বরিশালের ব্রাম্মসমাজের নিষ্ঠাবান ভক্ত বামনচন্দ্রগঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র নগেন্দ্রনাথের সঙ্গে। উচ্চাভিলাষী নগেন্দ্রনাথের বিলাত যাবার একান্ত বাসনা, কিন্তু পারিবারিক অবস্থা সে ইচ্ছে পূ্রনের অনুকুল ছিলনা।বিলাত যাবার ব্যয় বহনে ইচ্ছুক এমন কন্যা দায়গ্রস্থ পিতাকে দায়মুক্ত করতেও তিনি রাজি। শ্বশুরের খরচে বিলাতগমনেচ্ছু পাত্র রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন না। বিয়ের নামে এই বিনিময় প্রথা তাঁর অপছন্দ ছিল। কিন্তু প্রিয়দর্শন, তেজস্বীযুবক নগেন্দ্রনাথ কে দেখে মত বদল করেন। নগেন্দ্রনাথ কে আমেরিকা পাঠাবার কথা দিয়ে কন্যাদান করলেন। কবির ইচ্ছে অনুযায়ী নতুন জামাই নগেন্দ্রনাথ বিয়ের তিন সপ্তাহ পর ২৮ জুন, ১৯০৭ সালে আমেরিকা যাত্রা করেন। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃষি বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি উর্জন করে ১৯১০ সালে দেশে ফিরে আসেন।
কবির স্বপ্ন ছিল, পুত্র জামাতা মিলে তাঁর জমিদারি পরিচালনা, পত্রিকা সম্পাদনা, ব্যাঙ্ক ও ব্যবসার তদারকি, তদুপরি শান্তিনিকেতনে তাঁর সাধনাকে সিদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে কিন্তু নগেন্দ্রনাথ কে নিয়ে কবির সকল আশা ভরসা অচিরেই বিলীন হয়ে গেল। শ্বশুর নির্ধারিত সকল কাজ-কর্ম থেকে নগেন্দ্রনাথ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। তিনি অন্যত্র চাকরী প্রয়াসী হলেন। নগেন্দ্রনাথ কে ভারমুক্ত করতে কবি তার পৈ্তৃক দেনা শোধ করলেন, তাঁর ভাইদের পড়াশুনার ভার গ্রহন করলেন, এ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ কন্যা-জামাতার ভরন পোষনের জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করলেন। নগেন্দ্রনাথের কোন নির্দিষ্ট কাজকর্ম নেই, আয় নেই, কোন বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকার মানসিকতা, সব বিষয়ে গা ছাড়া ভাব, অথচ বে-হিসেবী জীবনযাত্রা ইত্যাদি নিয়ে কবির সঙ্গে মতান্তর থেকে মনান্তর শুরু হল এবং তার অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া ঘটল মীরা দেবীর উপর। যে সরল ও সুরুচিপূর্ণ পরিমন্ডলে কবি-কন্যা লালিত পালিত হয়েছিলেন, জামাইয়ের পারিবারিক পরিবেশে মনে হয় তার কিছুটা ঘাটতি ছিল। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে ছিল যে ১৯১৮ সাল নাগাদ কবি-কন্যা ও জামাতার মধ্যে এক দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে গেল। বিলম্বে হলেও নগেন্দ্রনাথের একটা জীবিকার ব্যবস্থা হল, কিন্তু এদিকে কন্যা-জামাতার জীবন বীনার ছেঁড়া তারে জ়োড়া লাগার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। কন্যার প্রতি মমত্ববোধ, আর জামাইয়ের প্রতি কর্তব্যবোধে কবির দিক থেকে কোনো ঘাটতি না থাকলেও উভয়ের মানসিকতায় যে যোজন পরিমান ফারাক সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতিবিধান কবির সাধ্যাতীত। ফলে মীরা দেবী স্বামীর ঘর করতে কলকাতা যেতেই অনিচ্ছুক ছিলেন। নগেন্দ্রনাথের ইচ্ছে, কবি তাঁকে জোর করে স্বামীর কাছে পাঠান। সেখানেই কবির আপত্তি। তিনি লিখেছেন, “মীরার সঙ্গে তোমার লেশমাত্র বিচ্ছেদ হয়, এ আমার কিছুতেই ইচ্ছাসম্মত নয়। এর দায়িত্বও আমার পক্ষে কঠিন। তবু আমাকে পরম দুঃখে এটা স্বীকার করতে হচ্ছে। এবার মাদ্রাজে যখন দেখলুম মীরা তোমাকে ভয় করে, তোমার হাত থেকে প্রকাশ্য অপমানের সংকচে একান্ত সংকুচিত হয়, তখন স্পষ্ট দেখতে পেলুম তোমাদের দুজনের প্রকৃতির মুল সুরে মিল নেই। ( চিঠি, ৮ ভাদ্র, ১৩২৬ ) সুতরাং মীরা দেবী পুত্র-কন্যা নিয়ে রয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনে, কখনো বা পিতার সাথে জ়োড়াসাঁকোয়, আর নগেন্দ্রনাথ কলকাতায়। নগেন্দ্রনাথ বার বার চেষ্টা করেছেন স্ত্রী কে নিজের কাছে আনতে, কিন্তু মীরা দেবী রাজি হন নি। কারন কবিই তাঁর জামাইয়ের স্বভাব-চরিত্র বিশ্লেষন করে বলেছেন, “ তোমার অধৈয অসহিষ্ণুতা, তোমার আত্মসম্বরনে অসাধ্যতা, তোমার দুর্দান্ত ক্রোধ, এবং আঘাত করিবার হিংস্র ইচ্ছা, সাংসারিক দিক থেকে আমাকে অনেক সময়ে কঠীণ পীড়াদিয়েছে। (চিঠি,১১ অগ্রহায়ন,১৩২৬ )। এমন পরিবেশে কন্যা স্বামী গৃহে যেতে না চাইলে কবি তাকে জোর করে পাঠাবেন না। অন্য একটি চিঠিতেও কবি লিখেছেন, “ মীরা যে প্রশান্ত গাম্ভির্যের সঙ্গে নিঃশব্দে আপন দুঃখবহন করে, তাতে ওর মুখের দিকে তাকালে আমার চোখে জল আসে। ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে কোনও জীবনযাত্রা বহন করতে যদি প্রস্তত হতে হয়, তবে সে চিন্তা আমারজন্য দুর্বিষহ। এখন সে শুধু আমার কন্যা নয়, সে যে আমার আশ্রয়ে আছে, আমি যদি তাকে বলি তার এখানে থাকাহবেনা, তাহলে তাকে চলে যেতেই হবে----জানি, সে কখনো আভাসেও অসম্মতি জানাবেনা। কিন্তু কোনমতেই আমারদ্বারা এমন নির্মম কাজ হবেনা। মীরা যখনি ইচ্ছে করবে, যখনি সে আমাকে বলবে আমি যাব, তখনি আমি তাকে যেতেবলব”।(চিঠি, ২০ ফাল্গুন,১৩২৬) ব্যথাহত রবীন্দ্রনাথ এক পত্রে নগেন্দ্রনাথ কে লিখেছেন, “তোমাদের দুইজনেরই ভাগ্য তোমাদের নিজেদের হাতে। আমি জোর করে তার গতি পরিবর্তন করতে পারিনে, এ সকল দুর্ঘটনার মুল অন্তরের মধ্যে। তোমাদের পরস্পরের মধ্যে যে বিচ্ছেদ ঘটেছে সে তো বাইরের জিনিস নয়। বাইরে থেকে জোর করে, শাসন করে, ভয় দেখিয়ে জোড়া দেবার যে চেষ্টা সে আমার দ্বারা কিছুতেই হতে পারেনা। কারন, তার মতো নীচতা ও নিষ্ঠূরতা আর কিছুই নেই। তুমি এ সম্মন্ধে আদালতে নালিশ করতে চাও, মীরা যদি সেই আঘাতও সহ্য করতে সম্মত থাকে, তাহলে আমি কি করতে পারি? তুমি এ সম্মন্ধে তাকেই বরঞ্চ ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখো। যদি ভয় পেয়ে সে হার মানে তাহলে তাই হোক। চিঠি, ২৫মাঘ,১৩২৬) । মীরা দেবী স্বামীর ঘরে না থেকে বাবার কাছে থাকলে লোকনিন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করে নগেন্দ্রনাথ কবি কে লিখলে তিনি জবাবে লিখেছেন, “মীরা যদি তোমার কাছ থেকে দূরে থাকলে তোমার সম্মন্ধে লোকনিন্দার আশঙ্কা আছে বলে তুমি কল্পনা করছ। মীরা নিজের সম্মন্ধে লোকনিন্দা কে গ্রাহ্য করেনা তোমাকে লিখেছে শুনে খুশী হলুম। জীবনে সব মানুষের ভাগ্যে সুখ থাকেনা--- তা নাই বা থাকল----কিন্তু স্বাধীনতা যদি না থাকে তবে তার চেয়ে দুর্গতি কিছু হতে পারেনা। মীরা এখানে আপন মনে একটি কোনে থাকে—বেশী কিছুই চায়না,-- একটু খানি শান্তি এখানে পায়, আর জানে আমি ওকে কত স্নেহ করি। লোকনিন্দার ভয়ে মীরার এই অধিকার টুকুকে নষ্ট হতে দেখলে আমার আর দুঃখের অন্ত থাকবেনা।(চিঠি,মাঘ-ফাল্গুন,১৩২৯)। বিদেশ থেকে কবি মীরা দেবী কে লিখেছিলেন, “তোর দুঃখ আমার হৃদয় ভরে আছে, আমি একদিন ও ভুলতে পারিনে। এ দুঃখ দূর করি এমন শক্তি আমার নেই,--- তোদের নিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে সুখী হব ঈশ্বর আমাকে সে অবকাশ দেবেন না......... সুখের আশা রাখিসনে মীরু, দুঃখ কে ভয় করিসনে---তুই যে কোনো শাসনের ভয়ে, পীড়নের দায়ে নিজের সত্ত্যকে বিকোতে চাসনে এতে আমি সুখী। (চিঠি,১৯২১)। কিছুদিন পর নগেন্দ্রনাথ কে এক চিঠিতে লিখলেন, “ এই দুঃখ রয়ে গেল যে, তোমাদের দুজনের কাউকেই আমি সুখী করতে পারিনি,-- তার শাস্তি নিয়ত অন্তরের মধ্যে ভোগ করছি, অতএব আমাকে ক্ষমা কোর।(চিঠি,২১ আশ্বিন১৩২৯)। তার কয়েক মাস পর আর একটি চিঠিতে, “তোমাকে শান্তি ও শান্তনা দেবার কোন ক্ষমতা আমার হাতে যদি থাকত তাহলে আমি চেষ্টার ত্রুটি করতুম না। (৬ফাল্গুন,১৩২৯)
আর গভীর দুঃখ ও মর্মবেদনায় কবি পুত্র রথিন্দ্রনাথ কে এক চিঠিতে লিখেছেন, ”মীরা যখন নাবার ঘরে ঢুকেছিলো তখন একটা গোখরো সাপ ফস করে ফনা ধরে উঠেছিল, আজ আমার মনে হয় সে সাপ যদি তখনি তাকে কাটত, তাহলে ও পরিত্রান পেত।“ বিশাল বিচিত্রমুখী রবীন্দ্রসাহিত্যের কোন চ্চরিত্রের মুখে এমন নিষ্ঠূর নিষ্করুন সংলাপক্তি শোনা যায়নি। কি গভীর মনস্তাপে রবীন্দ্রনাথের মতো স্নেহশীল পিতা ও সংবেদনশীল কবির কলমে এমন নির্মম, নির্দয় উক্তিবেরোতে পারে তা অনুভব করা যায়, বোঝান যায় না।
[সুত্রঃ রবিন্দ্রনাথ, নগেন্দ্রনাথ, ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়দীনেশ্চন্দ্র সিংহ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবী। লেখাটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]
গ্রীসের কবি কস্টিস পাপাকংগোস
বহু বছর আগে রবীন্দ্র সরকার অনুদিত “কস্টিস পাপাকংগোস-এর কবিতা” শিরোনামের বইটি হাতে পেয়ে এক নিশ্বাসে গ্রীসের কবি পাপাকংগোসের কয়েকটি কবিতা পড়ে নিলাম। ভিন্নরূপের কবিতাগুলো পড়ে বেশ ভালো লাগলো। ১৯৩৬ সালে গ্রীসের এক বিপ্লবী পরিবারে জন্মেছিলেন এ কবি আর তাই তাঁর কবিতায় বিপ্লবের ছবি ফুটে উঠেছিল বেশী। কবির শৈশব কেটেছিল গ্রীসের এক পাহাড়ী এলাকায় তাই বিপ্লবের পাশাপাশি পাহাড়ী এলাকার নৈসর্গিক রূপ তাঁর কবি সত্তাকে পূর্ণতা দিয়েছিল। লড়াই ও আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে যে ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর পরিবারে পরবর্তীকালে তা কবিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল সংগ্রামে অংশ নিতে ।
ত্রিশের দশকের পর সমসাময়িক কবিদের মধ্যে কস্টিস পাপাকংগোস ছিলেন স্বকীয় বৈশিষ্টে উজ্জ্বল একজন কবি। গ্রীক লোকগীতির ঐতিহ্যকে ধারণ করে তিনি তাঁর কবিতায় শ্লেষ ও বিদ্রুপের ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিলেন।
ধর্মচ্যূত হয়েছে বলে রুটিওয়ালা গেল তার উপর চটে অধার্মিক বলে তাকে পুরে দিল আর-সব দৈত্যদের সাথে নরকে। সে মানুষ খায় বলে নয় না-সেঁকেই খায় বলে।
কস্টিস পাপাকংগোসের জীবন ছিল নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। ফ্যাসিস্ট বিরোধী সংগ্রামের সময় তাঁর ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে তৎকালিন শাসকদের আইনি খড়গ ঝুলেছিল বলে আত্মগোপন করে এবং বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়িয়েছেন এ কবি। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ক্রুশবিদ্ধ নয়” প্রকাশিত হয় তাঁর কুড়ি বছর বয়সে। তারপর তাঁর বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ ও রাজনৈতিক লেখা প্রকাশিত হয়। এসব লেখার মাঝে কিংবদন্তীস্বরূপ লেখা গেরিলা যোদ্ধা ”ক্যাপ্টেন আরিস” -এর জীবনীগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
সংঘাতসংকুল জীবনে কবি কস্টিস পাপাকংগোস কাব্যের মুল বিষয় ছিল ‘প্রতিবাদ’ একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে । আজ বহুবছর পরেও তাঁর কবিতাগুলো বর্তমান যুগের সর্বত্র অনিয়ম ও বিশৃংখলার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ হিসাবে একই আবেদন নিয়ে জ্বাজল্যমান রয়েছে।
কবি ও প্রেম
আলাউদ্দিন আল আজাদ
কবিদের দৃষ্টিতে প্রেম প্রসঙ্গে এবারে কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ-এর চিন্তাভাবনা উদ্ধৃত করা হলো -
এ এমন একটি শব্দ প্রেম অভিধানে যার অর্থ আছে কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগে সে অর্থ কি সত্যিই অর্থময় , অথবা নিরর্থক ? প্রেম সকল রকম অর্থ ছাড়িয়ে যায়, সেখানেই তার অর্থময়তা। সেখানেই তার অনন্ত গণিত, তার গ্রহনযোগ্যতা। অপার মহিমা।
আকর্ষণ প্রেমের সাথে গোড়া থেকে গভীরভাবে জড়িত। আকর্ষণ পরস্পর। কিন্তু আকর্ষন প্রথমত কিংবা সম্পূর্ণভাবেই এক তরফাও হতে পারে। জীবন ধারণে অবাধ বিচরণের কারণে আকর্ষণটা প্রধানত পুরুষের দিক থেকেই উদগত হতে দেখা যায়, আর সে আকর্ষন কোন রমণীর প্রতি। যৌবনকালটা এর উপযুক্ত সময়। সে আকর্ষণে নারী বিশেষত প্রাচ্য দেশসমুহে ধর্মীয় ও সামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে, আস্তে আস্তে সাড়া দিতে পারেন। কিংবা একেবারে প্রত্যাখান করাও সম্ভব। নারীর দিক থেকে সে আকর্ষণ-চেতনা সংশ্লিষ্ট পুরুষকে না দেখেও কেবল তার যশগৌরব কিংবা গুণাবলীর কথা শুনেও জাগ্রত হতে পারে। যেমন নিম্ন পদে শ্রীরাধার অনুভূতিটা সেই রকমঃ সখি কেবা শুনাইল শ্যাম নাম, কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মোর প্রাণ।
এখানে উল্লেখযোগ্য, নারী-পুরুষের প্রেমকেই বলা যায় প্রকৃতির সদিচ্ছাসঞ্জাত ও স্বাভাবিক। মানব ইতিহাসে সমকামী আকর্ষণের পরিচয় আছে, প্রাচীন গ্রীসের প্রখ্যাত কবি সাফোর কবিতাবলী কিংবা ইংলিশ রেনেসাঁর কবিও বিশ্ব নন্দিত নাট্যকার শেক্সপীয়রের সনেটগুচ্ছ, তার দুটো প্রধান দৃষ্টান্ত। কিন্তু আমার মনে হয়, সমকামী প্রেম প্রেম নয়। প্রেমের বিকৃতি। সমকামী সংবেদনশীলতায় শ্রেষ্ঠ সাহিত্য শিল্পকলা সৃষ্টি হলে তার কারণ সম্পর্কের প্রকৃতি নয় বরাং কবি প্রতিভা যে সর্বদাই বিষয়বস্তুকে ছাড়িয়ে পরিণত শিল্পেকর্মের অনন্যতায় নিজেকে নিঃশেষ করে’ তাই। সেখানে সমপাত্র কিংবা সমপাত্রী উপলক্ষ্যমাত্র।
আরেকটি কথা - প্রেম একনিষ্ট যেমন হয় তেমনি হতে পারে বহুচারী। একনিষ্ঠ প্রেমকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে প্রেমের গভীর দর্শন। যেখানে শুরু বিকাশ ও সমাপ্ত, সেখানে একটি বিশেষ গৌরব আছ বৈকি। কিন্তু বহুচারিতা সর্বদাই লাম্পট্য তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। এটা পর পর ঘটতে পারে, একটার শেষে আরেকটার শুরু। সবচেয়ে মজা, একসঙ্গে বহুপ্রেমও অসম্ভব নয়। সেখানে বৈচিত্রের প্রাধান্য। এর মূলগত কারণ সম্ভবত প্রাকৃতিক বিধানের মতই প্রেম রূপান্তরশীল। সে জন্য প্রেম আসে, প্রেম চলে যায়। একজনের জীবনে আবার তা আসতেও পারে নাও আসতে পারে। প্রেমিক-প্রেমিকা স্বভাবতঃ সত্যবাদী কিন্তু প্রেমের স্বার্থে নিদারুণ মিথ্যেবাদীও হতে পারেন। মধ্য যুগের কবি চন্ডিদাস একটি পদ রচনা করেছিলেন, রজকিনী প্রেম নিকষিথ হেম, কামগন্ধ নাহি তায়। আবার পাশ্চাত্যে প্লেটনিক প্রেম বলেও একটি কথা প্রচলিত আছে। আসলে প্রেম কামজ কিন্তু প্রেম প্রেমই। সে কাম মিলনে চরিতার্থ হতে পারে আবার নাও হতে পারে। কাম যখন চরিতার্থ হয়ে যায় তখন প্রেমে ভাঁটা পড়াটাও স্বাভাবিক। তবে সবক্ষেত্রেই এমন ঘটবে তাও নয়। সৎ প্রেমের সাদৃশ্য , আবার সব প্রেমই অনন্য।
একজন শ্রেষ্ঠ কবি বা শিল্পীর পক্ষে বহুবল্লভ হওয়া অত্যাবশ্যক, কারণ তার অন্বিষ্ট সম্পূর্ণতা। বিচ্ছিন্নতাও প্রয়োজন, কেননা দূর থেকে না দেখলে সৃষ্টি হবে না। যে কবি প্রেমে পড়েননি তার পক্ষে প্রেমের কবিতা লেখা অসম্ভব। প্রেমের কবিতা প্রেমের প্রকৃত স্মৃতির পুষ্পস্তবক।
(চলবে)
কবিতায় বিপ্লব
কাজী নজরুল ইসলাম
'কবিতা’ শব্দটির সাথে যখনই আমদের দেখা হয় তখন কেমন যেন এক রোমান্টিক আবেশে মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। যে কথা সহজে বলা যায় সে কথা যদি ছন্দবদ্ধ বাক্য বিন্যাসে আরো অলংকার সহযোগে বলা যায় তখন তা আরো হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠে, আর এ জন্য কবিতার প্রতি এতো ভালোবাসা আমাদের । কবিতা হয়ে উঠে আমাদের হৃদয়ের অব্যক্ত অনুভব প্রকাশের মাধ্যম। শব্দের অবয়বে কবিতা হয়ে উঠে এক একটি হৃদযের কাব্য। তবে কবিাতার এই একপেশে অবস্থান থেকে কবিতার জগত আরো প্রসারিত হয়ে কবিতা যে বিপ্লবের হতিয়ার হতে পারে, কবিতা যে শৃংখলমুক্তিতে অগ্রণী ভুমিকা রাখতে পারে তা লক্ষ্য করা যায় অনেক কবির কবিতায়। রোমান্টিকতার বলয় থেকে কবিতাকে মুক্তি দিয়েছেন অনেক কবিগণ যাদের সেই কালজয়ী কবিতাগুলো যুগে যুগে আমাদের প্রেরণা জাগায় মাথা উঁচু করে সামনে এগিয়ে চলার; অব্যবস্থা অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর। এমনই কিছু কবিতার সাথে পরিচয় করিয় দেয়ার জন্য এ আয়োজন আমার।
শুরুতেই যে কবির নাম মনে আসে, যিনি তাঁর একটি কবিতার শিরোনাম নিজের নামের সাথে যুক্ত করেছেন তিনি আর কেউ নন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ‘বিদ্রোহী’ শিরোনামে কবিতা লিখে নিজেই ভুষিত হয়েছেন বিদ্রোহী কবি হিসাবে। ’বিদ্রোহী’ কবিতা ছাড়াও তাঁর অসংখ্য কবিতা ও গান রয়েছে যে গুলো কবিতার প্রচলিত ভাবধারা থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের নিয়ে গেছে অন্য একটি জগতে যেখানে জীবন মানে বেঁচে থাকার জন্য অহর্নিশ যুদ্ধ, আর কবিতা হচ্ছে সে যুদ্ধের মুল মন্ত্র। বিদ্রোহী কবিতার প্রতিটি পঙক্তি প্রতিটি মানুষের মনে বিশাল আলোড়ন জাগায়, সবকিছু ভেঙ্গে আবার নতুন করে সৃষ্টির প্রয়াস জাগায় মনে যখন এ কবিতা পড়ি আমরা -
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নিয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্ণি, কালানল, আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল! আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ, আমি ত্রাস সন্চারি ভুবনে সহসা সন্চারি’ ভূমিকম্প।
জীবনের প্রতিটিক্ষেত্রে নানা অনিয়ম অনাচারের মাঝেও আমরা অবচেতন মন নিযে বাস করি। আমাদের চেতনায় আঘাত হেনে আমাদেরকে জাগিয়ে তুলতে অসামান্য অনেক কবিতা লিখেছেন কবি নজরুল । ’সর্বহারা’ কবিতার মাধ্যমে তেমনি আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছেন তিনি -
ব্যথার সাতার-পানি-ঘেরা চোরাবালির চর, ওরে পাগল! কে বেঁধেছিস সেই চরে তোর ঘর? শূন্যে তড়িৎ দেয় ইশারা, হাট তুলে দে সর্বহারা, মেঘ-জননীর অশ্র”ধারা ঝ’রছে মাথার’ পর, দাঁড়িয়ে দূরে ডাকছে মাটি দুলিয়ে তর”-কর।।
'আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’, ’কারার ঐ লৌহ কপাট’, ’ধুমকেতু’, ’কান্ডারী হুশিয়ার’ -এ রকম অনেক অনেক কবিতা রয়েছে যা আমাদের চেতনায় আঘাত হেনে আমাদের জানিয়ে দিয়ে যায় চোখ বুঝে অন্যায় সহ্য করে বেঁচে থাকার নাম জীবন নয়। জীবন মানেই সংগ্রাম, জীবন মানেই অধিকার আদায়ের লড়াই। আর কবি নজরুল ছিলেন কবিতার মাধ্যমে অধিকার আদায়ের অগ্রগণ্য কবি। 'ধুমকেতু’ কবিতা লিখে কবি তদানিন্তন ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে জেল খেটেছিলেন । ঐ কবিতার প্রতিটি পঙক্তি এক একটি অগ্নি স্ফুলিঙের মতো মানবসত্ত্বাকে স্পর্শ করে -
ঐ ঈশ্বর-শির উল্লঙ্ঘিতে আমি আগুনের সিড়ি, আমি বসিব বলিয়া পেতেছি ভবানী ব্রহ্মার বুকে পিঁড়ি! ........... আজ রক্ত মাতাল উল্লাসে মাতি রে-- মম পুচ্ছে ঠিকরে দশগুণ ভাতি, রক্ত-রুদ্র উল্লাসে মাতি রে! ভগবান্ ? সে ত হাতের শিকার!— মুখে ফেনা উঠে মরে!
আর এভাবেই নজরুলের কবিতার এক একটি শব্দ যেন এক একটি শাণিত অস্ত্র হয়ে শৃংখলিত মানুষের মুক্তির পথে আলোকবর্তিকার মত কাজ করেছে।
(চলবে)
কবিগুরু এবং কাজী নজরুলঃ স্নেহ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক
এই আগস্ট মাস হচ্ছে বাংলা সাহিত্যে দুই দিকপাল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুদিবস । যথাযোগ্য মর্যাদায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭১তম এবং কাজী নজরুল ইসলামে ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। মহান এ দুই কবির বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি নজরুলকে নিয়ে আমরা কত’না বিতর্কের সৃষ্টি করি। দু’জনেক নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করি এবং তা করতে গিয়ে নানান অপ্রাসঙ্গিক কথা বিল কিন্তু তাঁদের দু’জনের মাঝে ছিল শ্রদ্ধা ও ভালেবাসার এক বিরল সম্পর্ক । কবি নজরুর এবং কবিগুরুর চিন্তা ও চেতনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী । দু’জন ছিলেন আপন ভুবনে উজ্জ্বল নক্ষত্র আর বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের ভুবনে দু’জনের অবদান অনস্বীকার্য। কবিগুরু এবং কাজী নজরুলের পারস্পরিক সম্পর্কের মধুরতম দিকটা লক্ষ্য করা যায় তাঁদের একে অপরের কিছু রচনা পরস্পরের জন্য উৎসর্গ করার মাধ্যমে। নজরুলের “তীর্থ পথিক” কবিতা থেকে অংশ বিশেষ।যা রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন নজরুল।
“তুমি স্রষ্টার শ্রেষ্ট সৃষ্টি বিশ্বের বিস্ময়,- তব গুণ-গানে ভাষা-সুর যেন সব হয়ে যায় লয়। তুমি স্মরিয়াছ ভক্তের তব, এই গৌরবখানি রাখিব কোথায় ভেবে নাহি পাই, আনন্দে মূক বাণী। কাব্যলোকের বাণী-বিতানের আমি কেহ নহি আর, বিদায়ের পথে তুমি দিলে তবু কেন এ আশিস-হার? প্রার্থনা মোর, যদি আরবার জন্মি এ ধরণীতে- আসি যেন গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে!!”
১৯২২ সালের ১১ আগষ্ট কলকাতা থেকে নজরুলের পরিচালনায় প্রকাশিত হয় অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধুমকেতু’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধুমকেতর আর্শীবাণীতে লিখেন:
“কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু , আয় চলে আয়, রে ধুমকেত আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন! অলক্ষণের তিলক রেখা রাতের ভালে হোক না লেখা, জাগিয়ে দেরে চমক মেরে’ আছে য়ারা অর্ধ চেতন!
২৪ শে শ্রাবণ ১৩২৯ শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”
কবিগুরুর এ রচনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে তিনি নজরুলের প্রতিভা এবং সৃষ্টিকে কতটুকু মূল্যায়ন করতেন।
১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ধুমকেত’ প্রএিকায় ১২শ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নজরুলের প্রতীকধর্মী রাজনৈতিক কবিতা - ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। এই কবিতার জন্য বাজেয়াপ্ত হয় ‘ধুমকেত’র সেই সংখ্যা এবং কোলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে নজরুলের বিরূদ্ধে মামলা দায়ের এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারাধীন বন্দি হিসাবে নজরুল ছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে, বিচার শেষে ১৭ জানুয়ারি নজরুলকে স্হানান্তর করা হয় আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে।পরাধীন জাতির সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণের চিএ তুলে ধরে বন্দী নজরুল সমগ্র দেশবাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। ১৯২৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য নজরুলকে উৎসর্গ করে দেশবাসীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’ উৎসর্গের পর, নজরুল আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বসে রচনা করেন -’আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ অর্থাৎ ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতা।
নজরুল তার ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে উৎসর্গ করেন। নজরুলের অগ্নি-বীণা, দোলন-চাঁপা, ছায়ানট, সর্বহারা, ফণি-মনসা, সিন্ধু-হিন্দোল, চিত্তনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের বাছাই করা কবিতা নিয়ে ১৯২৮ সালে ‘সঞ্চিতা’ প্রকাশ হয়। নজরুল ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ পএে লিখেছেন:
“বিশ্বকবি সম্রাট শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রী শ্রী চরণারবিন্দেষু”
১৯২৩ সালে ১৪ এপ্রিল নজরুলকে হুগলী জেলে স্হানান্তর করা হয়। হুগলী জেলের সুপার মি. আর্সটান রাজবন্দীদের সাথে অত্যন্ত দূর্ব্যবহার ও অত্যাচার করতেন, রাজবন্দীদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল জেলে ৪০ দিন অনশন করেছিলেন।
১৯২৩ সালের ১৭ মে শরৎচন্দ্র বাজে-শিবপুর হাবড়া থেকে লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে লিখেছেন: “হুগলী জেলে আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম উপুষ করিয়া মরমর হইয়াছে।বেলা ১টার গাড়ীতে যাইতেছি, দেখি যদি দেখা করিতে দেয় ও দিলে আমার আনুরোধে যদি সে আবার খাইতে রাজি হয়। না হইলে তার কোন আশা দেখি না।একজন সত্যিকার কবি। রবী বাবু ছাড়া আর বোধ হয় এমন কেহ আর এত বড় কবি নাই”। কিন্ত শরৎচন্দ্র দেখা করেত পারেন নি। জেলের ভিতরে অনশনরত নজরুলের উপর অত্যাচার বেড়ে যায়। ডান্ডাবেড়ী, হ্যান্ডকাপ, সেল কয়েদ, ফোর্সড ফিডিং-এর চেষ্টা চলে, ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়েন নজরুল। মুমূর্ষ কবিকে বাঁচানোর জন্য শিলিং-এ চিঠি লেখা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, তিনি যেন নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করতে অনুরোধ জানিয়ে পএ লিখেন। রবীন্দ্রনাথ পএের উত্তরে বিদ্রোহী-বিপ্লবী সৈনিক নজরুলের দৃঢ়তাকে সমর্থন জানিয়ে লিখেন: “আদর্শবাদীকে আদর্শ ত্যাগ করতে বলা তাকে হত্যা করারই সামিল।অনশনে যদি কাজীর মূত্যুঘটে তা হলেও তার অন্তরে সত্য আদর্শ চিরদিন মহিমাময় হয়ে থাকবে।”
শেষ পর্যন্ত, স্নেহভাজন নজরুলের অনশনে বিচলিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে টেলিগ্রাম করেন: “Give up hunger strike, our literature claims you”.অত্যন্ত বিস্ময়ের বিষয়, জেল কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথের টেলিগ্রাম নজরুলকে না দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে লিখে পাঠালেন- “Addressee not found.” রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম ফেরত পেয়েই বুঝলেন এটি সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত ও হীনম্মন্যতা।অনশনের চল্লিশ দিনে বিরজাসুন্দরী দেবীর হাতের লেবুর রস পান করে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নজরুল কয়েকটি কবিতা লিখেছেন। এসব কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যায়।নজরুলের ‘অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলী’ ও ‘কৈশোর রবি’ কবিতা দুটি রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লেখা।
‘কিশোর রবি’ রবীন্দ্র প্রশস্তিমূলক কবিতা - হে চির-কিশোর রবীন্দ্র, কোন রসলোক হতে আনন্দ-বেণু হাতে হাতে লয়ে এলে খেলিতে ধুলির পথে? কোন সে রাখাল রাজার লক্ষ ধেনু তুমি চুরি করে বিলাইয়া দিলে রস-তৃষা তুরা পৃথিবীর ঘরে ঘরে । কত যে কথায় কাহিনীতে গানে সুরে কবিতায় তব সে আনন্দ-গোলেকের ধেণু রূপ নিল অভিনব। ভুলাইলে জরা, ভুলালে মৃত্যু, অসুন্দরের ভয় শিখাইলে পরম সুন্দর চির-কিশোর সে প্রেমময়। নিত্য কিশোর আত্মার তুমি অন্ধ তুমি বিবর হতে হে অভয়-দাতা টানিয়া আনিলে দিব্য আলোর পথে। (নতুন চাঁদ, কিশোর রবি)
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও জীবন নজরুল উপলদ্ধি করেছেন প্রসারতায়।তাইতো রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি নিয়ে তিনি লিখলেন, ‘রবির জন্মতিথি’-
নিরক্ষর ও নিস্তেজ বাংলায় অক্ষর-জ্ঞান যদি সকলেই পায়, অ-ক্ষর অ-ব্যয় রবি সেই দিন সহস্র করে বাজাবেন তাঁর বীণ। সেদিন নিত্য রবির পুণ্য তিথি হইবে।মানুষ দিকে তাঁকে প্রেম-প্রীতি। (শেষ সওগাত, রবির জন্মতিথি)
রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক সৌহার্দ্যের; রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে যে কি স্নেহ করতেন তার একটি উদাহরণ রবীন্দ্রনাথের “গোরা” উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবিতে নজরুলকে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে মনোনীত করেন নরেশচন্দ্র মিএ।তখন সুরকার হিসাবে নজরুলের জনপ্রিয়তা সবার উপরে। চলচ্চিএটি যখন মুক্তি পেতে যাচ্ছে, তখন বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড থেকে আপত্তি ওঠে যে বোর্ডের অনুমতি না নিয়ে ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত (৭টি রবীন্দ্রসঙ্গীত) ব্যবহার করা হয়েছে এবং সুরও যথাযথ নয়; অতএব ছবিটি মুক্তি পেতে পারে না।প্রযোজকের মাথায় হাত।নজরুল কালক্ষেপন না করে ফিল্মের পিন্ট ও প্রজেক্টার নিয়ে ট্যাক্সি করে শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে চলে গেলেন। সবশুনে রবীন্দ্রনাথ বললেন ‘কি কান্ড বলতো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান, আর ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরে? তোমার চেয়েও আমার গান কী তারা বেশি বুঝবে? আমার গানের মর্যাদা কী ওরা বেশী দিতে পারবে’? একথা বলে আগের থেকে লিখে রাখা অনুমতিপএ নিয়ে তাতে সই ও তারিখ দিয়ে দিলেন। নজরুল রবীন্দ্র-স্নেহ থেকে কোনদিন বঞ্চিত হননি।এটি তার একটি বড় প্রমাণ।
বস্তুত, শনিবারের চিঠি’র সজনীকান্ত দাশ এবং মোহিতলাল মজুমদারের ঈর্ষান্বিত প্রয়াসে আধুনিক সাহিত্য নিয়ে বির্তক আর বঙ্গসাহিত্যে খুনের মামলা নিয়ে ভূল বুঝাবুঝি ছাড়া ১৯২০ থেকে ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পূর্ব কাল পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক ছিল স্নেহ ও শ্রদ্ধার।
১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট বাংলা ১৩৪৮ সালের ২২শে শ্রাবণ বেলা বারোটা এগারো মিনিটে রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ ঘটলো।কবিগুরুর আত্মা মর্ত থেকে উর্ধ্বে উঠে গেল-দেশ শূন্য, কাল শূন্য-মহাশূন্য পরে।বৈশাখের শঙ্খ স্তব্ধ হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের মূত্যু সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল লেখনী হাতে তুলে নিলেন।রচনা করেন শোক কবিতা ‘রবি হারা’-
দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্ত পথের কোলে শ্রাবণ মেঘ ছুটে’ এল দলে দলে উদাস গগন-তলে। বিশ্বের রবি ভারতের কবি, শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি। তুমি চলে যাবে বলে।… বিদায়ের বেলা চুম্বন লয়ে যায় তব শ্রীচরণে, যে লোকেই থাক হতভাগ্য এ জাতিরে রাখিও মনে। (রবি হারা, সওগাত, ভাদ্র ১৩৪৮)
কলকাতা বেতার কেন্দ্রে এই কবিতাটি নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন।রবীন্দ্র-প্রয়াণ নজরুলের মানসিক অবস্থা এ কবিতার মাধ্যমে বুঝা যায়।রবীন্দ্রনাথের মূত্যুর পর নজরুল ‘সালাম অস্ত-রবি’ নামে আরও একটি কবিতা লিখেছিলেন। এই কবিতাটি ও কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। শত রূপে রঙে লীলা-নিকেতন আল্লার দুনিয়াকে রাঙায় যে জন, আল্লার কৃপা সদা তাঁরে ঘিরে থাকে। তুমি যেন সেই খোদার রহম এসেছিলে রূপ ধরে, আশেরি ছায়া দেখাইয়াছিলে রূপের আর্শি ভরে। কালাম ঝরেছে তোমার কলমে, সালাম লইয়া যাও উর্ধ্বে থাকি’ এ পাষাণ জাতিরে রসে গলাইয়া দাও! (সালাম অস্ত-রবি, মাসিক মোহাম্মদী, ভাদ্র ১৩৪৮)
রবীন্দ্রনাথের মূত্যুতে শোকাহত দেশবাসীর উদ্দেশ্যে নজরুল গানও রচনা করেছিলেন:
ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে, জাগায়ো না জাগায়ো না সারাজীবন যে আলো দিল ডেকে তাঁর ঘুম ভাঙায়ো না যে সহস্র করে রূপ রস দিয়া জননীর কো্লে পড়িল ঢলিয়া তাহারে শান্তি-চন্দন দাও,ক্রন্দনে রাঙায়ো না।। যে তেজ শৌর্য্য-শক্তি দিলেন আপনারে করি ক্ষয়, তাই হাত পেতে নাও। বিদেহ রবি ও ইন্দ্র মোদের নিত্য দেবেন জয়। কবিরে ঘুমাতে দাও। অন্তরে হের হারানো রবির জ্যোতি সেইখানে তাঁরে নিত্য কর প্রণতি। আর কেঁদে তাঁরে কাঁদায়ো না।
গানটি অত্যন্ত বেদনাময় আবহের। নজরুল এই গানটি সুনীল ঘোষ, ইলা ঘোষ প্রমুখ শিল্পীকে দিযে রেকর্ড করেছিলেন। গানটি কলকাতা বেতারেও প্রচারিত হয়েছিল।
বাঙালীর হৃদয়ে এ দু’কবির স্থান চির অম্লান। দু’জনের সৃষ্টিতেই বাঙালী স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা ও গানের ভুবনে।
এ আগস্ট মাসে এ দু মহান কবির মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁদের আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।