"ছাড়পত্র” কবিতার সাথে পরিচয়ের মাধ্যমে কবি সুকান্তের সাথে আমার পরিচয়ের সুত্রপাত। তারপর একে একে তাঁর সকল রচনার সাথে পরিচয়। প্রচলিত ধারা থেকে একটু ভিন্ন পথে প্রবাহিত ছিল তাঁর চিন্তা ও চেতনার প্রকাশ। ক্ষণজন্মা এ কবি তাঁর খুব স্বল্প পরিসরের জীবনে অনেক অনেক অসামান্য কবিতার জন্ম দিয়েছিলেন - যে চিরন্তন কবিতাগুলো কালান্তরে মানুষকে প্রেরণা যোগাবে স্বীয় অধিকার প্রতিষ্টার লক্ষ্যে।
সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি। পিতা-নিবারন ভট্টাচার্য, মা-সুনীতি দেবী। ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট মাতামহের ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটের বাড়ীতে তার জন্ম।। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার(বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে)। ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। সেই বছর আকাল নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন।
সুকান্তের সাহিত্য-সাধনার মূল ক্ষেত্র ছিল কবিতা। সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা ও বিক্ষোভ তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু। তাঁর রচনাকর্মে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাণীসহ শোষণহীন এক নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছে। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বৈপ্লবিক ভাবধারাটি যাঁদের সৃষ্টিশীল রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, সুকান্ত তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবিতার ছন্দ, ভাষা, রচনাশৈলী এত স্বচ্ছন্দ, বলিষ্ঠ ও নিখুঁত যে, তাঁর বয়সের বিবেচনায় এরূপ রচনা বিস্ময়কর ও অসাধারণ বলে মনে হয়।
কবি সুকান্তের প্রতি দু’ই বাংলার মানুষ এখনো অনেক উদাসীন। এ কবি এখনো অবহেলিত । তারপরেও থেমে থাকছেনা তাঁকে নিয়ে প্রচার ও গবেষণা। বাংলাদেশে ফরিদপুরের কোঠালিপাড়ায় সুকান্তের পৈতৃক বাড়ি অধিগ্রহন করে ৬৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হয়েছে। ভারতে সুকান্তের নিজ হাতে গড়া 'কিশোর বাহিনী' এখনো কাজ করে যাচ্ছে ছোটদের নিয়ে। বাংলাদেশে আছে 'সুকান্ত সংসদ'। এছাড়াও আছে সুকান্তকে নিয়ে দুই দেশেই নানা সংগঠন, বেশকিছু মানুষ। তারাই যা ভরসা। কিন্তু ভারতে এখনো অধিগ্রহন করা হয়নি সুকান্তের 'জন্মভিটে' বা নিজ হাতে গড়া বন্ধ হয়ে থাকা 'গ্রন্থাগার' বা সেই বিখ্যাত বাড়ি, যেখানে তিনি জন্ম দিয়েছেন অনেক কবিতার, সেই বেলেঘাটার '৩৪ হরমোহন ঘোষ লেন এর বাড়ি'টি। সুকান্তচর্চা আরো ব্যাপক আকারে হোক এ প্রত্যাশা আমরা সুকান্ত অনুরাগীদের।
পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৪৭ সালের ১৩ মে কোলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলীঃ ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন।