সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৭ সালে অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম গ্রহন করেন। মাত্র ৪ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৫৪ সালে। বর্তমানে তিনি আনন্দবাজার গ্রুপের সাথে জড়িত রয়েছেন। প্রায় ২০০ বইয়ের লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্যে বিভিন্ন শাখায় দক্ষতার পরিচয় দিলেও কবিতাকে তিনি তাঁর প্রথম ভালোবাসা বলে উল্লেখ করেছেন। ১৯৫৩ সালে তিনি কৃত্তিবাস নামক একটি কবিতার ম্যাগাজিন সম্পাদনা শুরু করেন । যে ম্যাগাজিন নুতন প্রজন্মের কবিদের কবিতার একটি বিশাল প্লাটফর্ম হিসাবে বিবেচিত । তাঁর রচিত চরিত্র ‘নিখিলেশ’ এবং ‘নীরা’ সিরিজের কবিতা বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
তাঁর কবিতায় এবং গদ্যে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় । তাঁর রচিত ’অরণ্যে দিনরাত্রি’ এবং ’প্রতিদ্বন্ধী’ উপন্যাস অবলম্বনে বিশ্ব বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাছাড়া ’অর্জুন’ এবং ’একা এবং কয়েকজন’ উপন্যাসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৫ সালে তাঁর রচিত উপন্যাস ’সেই সময়’ ভারতীয় সাহিত্য একাডেমী পুরষ্কার লাভ করে। তাছাড়া তিনি ভ্রমণ কাহিনী, শিশুতোষ সাহিত্য ও প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি ’নীল লোহিত’, ‘নীল উপাধ্যায়’ এবং ‘সনাতন পাঠক’ ছদ্মনাম ব্যবহার করেন তাঁর বিভিন্ন রচনায়। বর্তমানে তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সাহিত্য অকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর আকাদেমির সভাপতি।
চে গুয়েভারার প্রতি
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয় আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা আত্মায় অভিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়- বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে নেমে গেছে শুকনো রক্তের রেখা চোখ দুটি চেয়ে আছে সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে চুটে আসে অন্য গোলার্ধে চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।
শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত- আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায় লুকিয়ে থেকে সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে ছুটে যাওয়ার আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার- কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!
এতকাল আমি এক, আমি অপমান সয়ে মুখ নিচু করেছি কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি আমি ট্রেনের জানলার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়, ফাঁকা মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায় আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে বৃক্ষের কাছে, হঠাৎ-ওঠা ঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো আমি আমার ফিরে আসবো আমার হাতিয়অরহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল, মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো! চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়- আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!