সামনে আসছে পবিত্র ঈদুল-ফিতর। আনন্দময় এ দিনে সবার প্রতি রইল ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা । ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজ থেকে অনেক উৎসবের অবতারণা হলেও যে কোন উৎসব ধর্ম নিরপেক্ষ আর তাই যে কোন উৎসবে সামিল হয়ে আত্মীয়তার বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করার সুযোগ থাকে আনন্দ বিতরণে মাধ্যমে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জীবন ঈদের আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠুক এ কামনা করছি ।
১৫ই আগস্ট ভারতের মহান স্বাধীনতা দিবস । আসলে প্রকৃত অর্থে ঐ দিন স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল আমাদের সবার জন্য (ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মানুষের) কারণ তৎকালিন বৃটিশ সরকারের অপশাসন থেকে অখন্ড ভারতের মানুষ মুক্তি লাভ করেছিলেন। যাহোক, বিষয়টি ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক তাই এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়াচ্ছি না । ১৫ই আগস্ট হোক আর ১৬ ই ডিসেম্বর হোক এ তারিখ গুলো ইতিহাসের পাতা দখল করে আছে স্বর্ণালী অক্ষরে কিন্তু প্রকৃতঅর্থে আমরা কি স্বাধীন হতে পেরেছি ? অনেকের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক হবে। কারন যে উদ্দেশ্য নিয়ে একটি দেশ স্বাধীন হয় স্বাধীনতা উত্তর সে দেশে যদি সে উদ্দেশ্যের প্রতিফলন না ঘটে তাহরে পুরো ব্যাপারটাই একটি প্রহসন মনে হয়। যতদিন মানুষের মৌলিক অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত না হবে ততদিন ঐ তারিখগুলো শুধু ঝাকঝমকভাবে পালনের জন্য কিছু তারিখ হিসাবে থাকবে আর বাকী সময়গুলোতে আমাদের জীবন থাকবে আড়ম্বরহীন, বিষাদ-গ্লানিতে ভরা। আর তাই স্বাধীনতা প্রসঙ্গে এক অব্যক্ত অন্তর্দ্বন্ধ নিয়ে চলতে থাকবে আমাদের অন্তহীন পথচলা এবং কবি সাহিত্যিকের কলম চলতে থাকবে অব্যাহত যতদিন আমাদের প্রকৃত মুক্তি না আসবে, স্বাধিকার প্রতিষ্টিত না হবে। ভারতের মহান স্বাধীনতার এ দিবসে আমি প্রার্থনা করি সবার জীবন মঙ্গলময় হোক, সবার জীবনে শান্তি ও মুক্তি আসুক, পুষ্প পল্লভে সুশোভিত হোক প্রতিটি মানুষের জীবন। ২৯শে আগস্ট কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এ কবির অবদান সম্পর্কে আজ আর নতুন করে কিছু বলার নেই। নিজে একটি ধারার সৃষ্টি করেছিলেন বাংলা সাহিত্যে তাঁর বিদ্রোহের কবিতা দিয়ে । মহান এ কবির আত্মার চির শান্তি কামনা করছি । সাতকাহন যথারীতি প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের সক্রিয় সহযোগিতায় এবং এ সাফল্যের সমস্ত কৃতিত্ব আপনাদের যাঁরা নিয়মিত কবিতা দিয়ে সাতকাহনকে অলংকৃত করছেন। তবুও সাতকাহনে নতুন আরো কোন বিভাগ সংযোজন বা বিয়োজন করার প্রয়োজন আছে কি’না এ বিষয়ে আপনাদের মূল্যবান মতামতের অপেক্ষায় রইলাম। সবার জন্য রইল অসীম শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে আমার মেইলে এটাচ করা কয়েকজন কবি বন্ধুর কবিতা আমি ডাউনলোড করতে পারিনি বলে এ সংখ্যায় ছাপতে পারিনি। আমি সকল বন্ধুদের বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি - যাঁরা সাতকাহনে কবিতা দিতে চান তাঁরা অবশ্যই ইউনিকোড ফন্টে টাইপ করে সরাসরি মেইলে পেস্ট করে দেবেন অথবা আমাদের ওয়েবসাইটের ডান পার্শ্বে উপরে একটি “স্বাগতম” লেখা ইমেজে লিংক দেয়া আছে ওখানে ক্লিক করলে একটি ম্যাসেজ বক্স আসবে ওখানেও পেস্ট করে পাঠাতে পারেন। সফ্টওয়ার ছাড়া বাংলা টাইপ করতে বা এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন ..... “সফ্টওয়ার ছাড়াই বাংলা টাইপ” |
সাতকাহনের কবিগণ
|
“বহুজন মুক্তি চেয়েছে অক্ষরের কাছে”.............. রাজশেখর রায়চৌধুরী
কোন প্রশিক্ষণ গ্রহন করে কবি হওযা যায় না বলে একজন কবি সব সময় একজন রাজার চেয়েও অনেক অনেক বড় এবং মহান কারণ রাজা যান রাজা আসেন বংশানুক্রমিক নিয়মে, একজন মেধাহীন লোকও রাজা হতে পারেন যদি তাঁর জন্ম রাজবংশে হয় কিন্তু মেধা ও প্রতিভাহীন লোক কবি হতে পারেন না বলে একজন কবি সব সময় সাধারণের উর্দ্ধে । সহজকে ব্যাপকরূপে দেখার অমিত ক্ষমতা নিয়ে জন্মান একজন কবি - প্রকৃতি এবং প্রকৃতির সামান্য বিষয়কে অসামান্য করে তোলার অপরিসীম দক্ষতা একজন কবির মাঝে থাকে বলে কবি সব সময়ই অসাধারণ। মনের ভাবকে শব্দের ইটপাথরে কাব্যের মুর্তি হিসাবে গড়া সহজ কাজ নয় যা একজন কবি অবলীলায় করে যান তাই মুর্তির শৈল্পিক উৎকর্ষতা না দেখে আমি দেখি শিল্পীর মননশীলতা। তাই সাজানো ভাবের মুর্তি কতটুকু সুন্দর বা মান সম্পন্ন হলো সে প্রশ্নে না গিয়ে আমি দেখি কবির ভাবের মুর্তিটিকে। প্রসঙ্গটা এ জন্য উত্থাপন করলাম কারণ সাতকাহন এখনো শৈশব কাল অতিক্রম করতে পারেনি। আর এ শিশু সাতকাহন যাঁদের সহযোগিয়তা নিয়ে পথ চলছে তাঁদের অনেকের কবিতার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেতে পারে কিন্তু তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই, আর তাই তাঁদের সম্পর্কে কবিবন্ধু রাজশেখর রায়চৌধুরী -র মূল্যবান অনুপ্রেরণামুলক একটি লেখা আমি না ছেপে পারলাম না। কবি কস্টিস পাপাকংগোসের একটি কবিতার শেষ লাইন - “ কিন্ত বাছা, কবিতা লেখা মানেই কবিতা নয়” আমাকে অনেক প্রশ্নের সামনে দাড় করিয়ে দেয় কিন্তু তারপরেও সমালোচকের দৃষ্টি দিয়ে আমি কবিতার মুর্তিকে দেখতে পারিনা বলে কবিতা লেখাকে কবিতা হিসাবে’ই ধরে নেই। সাতকাহনের ৩য় সংখ্যার কবিগণের কবিতা নিয়ে আমার কবিবন্ধুর মন্তব্য নব্য কবিগণকে আরো লিখতে অনুপ্রেরণা যোগাবে বলে আমি মনে করি এবং এজন্য কবিবন্ধুর লেখাটি হুবহু প্রকাশ করলাম ।
.................... রিয়া দাশগুপ্তা
বহুজন মুক্তি চেয়েছে অক্ষরের কাছে
“শক্তি চট্টোপাধ্যায় একদা 'দেশ' পত্রিকার পাতায় এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছিলেন "এত কবি কেন ?" তো তাঁর এহেন আক্ষেপে বঙ্গ কবিকুলে ঢি - ঢি পড়ে গিয়েছিল । এ যেন কাকের মাংস কাকেরই ভক্ষণ ! রেগে আগুন তেলে বেগুন এমত কবিরা এর পরও লক্ষ লক্ষ বাংলা কবিতা রচনা করেছেন । পকেটের পয়সা খরচ করে বই ছেপে পরস্পরকে বিতরণ করেছেন । গোপনে অন্যের লেখাকে ঈর্ষা করেছেন আর নিজেই নিজের লেখা শ্রেষ্ঠত্বে যারপরনাই পুলকিত হয়েছেন । যদিও এরা সকলেই জীবনানন্দ কথিত 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি' - জাতীয় মন্তব্যকে বেদবাক্য বলেই মানেন । তবু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বাংলা কবিতা আজও বহুপ্রসবিনী । প্রযুক্তি মুখরিত, পণ্য শাসিত অতি-আধুনিক সময়ে আজও বাঙালি কবিদের কলম অপ্রতিরোধ্য । স্বভাবতই এর একটা সদর্থক দিক রয়েছে । রচনার তাগিদে প্রত্যেক কবির জীবনের পক্ষে অবস্থান । শ্রীমতি রিয়া দাশ গুপ্তা সম্পাদিত সাতকাহনের সাম্প্রতিক সংখ্যার ৩৯ টি কবিতা পাঠ করে অনন্ত এমনটাই প্রাথমিকভাবে আমার মনে হল ।
প্রেম - প্রীতি, নারীবাদ, আধুনিকতা-উত্তর আধুনিকতা, হৈমন্তী শুক্লা, বাংলা গান, অস্থিরতা, গহীন মন, আত্মরতি থেকে শুরু করে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে শোকগাথা রচনা করেছেন দুই বাংলার বেশ কয়েকজন কবি । বাংলা কবিতার বিবর্তনের প্রেক্ষিত কিংবা প্রকরণের ধারাবাহিকতা মাথায় রেখে, চুলচেরা বিশ্লেষণে না গিয়ে কেবল নিখাদ আবেগ ও অভীপ্সার সরল পাঠস্পর্শে জেনে নিতে পারি কয়েকজন বাঙালি কবির আন্তরিক উচ্চারণমালা । যা একইসঙ্গে বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক ধরনেরও খোঁজ দিতে পারে ।
স্বরাজ দত্ত স্পষ্টভাষায় জানিয়েছেন "এবার লিখতে হলে / শুধু নিজের জন্যই লিখব ।" তিনি ‘ সভ্যতার জুতো ’ খুলে খালি পায়ে নামতে চেয়েছেন বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে । তাঁর কল্পনার আকাশ-বাতাস-নদী "ঘাম-রক্ত-লড়াই আর প্রেমে মাখামাখি ।" আবহমান বাংলা কবিতার মানচিত্রে তিনি ' সাবজেক্টের ইতিহাস ' খোদাই করতে চেয়েছেন । নীল আলোয় যুবক যুবতীদের অগ্নিস্নানের অনুভূতিমালা খুঁজে দেখেন জল পরী । এম মোসাইন খানের 'প্রতিবাদী কোষ' তাঁকে প্ররোচিত করেছে কবিতা রচনায় । বর্তমানে মুল্যবোধহীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজে তাঁর আর্তি ও আশা একইসঙ্গে প্রতিধ্বনিত ।
সম্পর্কের গভীরে প্রবেশ করার আহ্বান জানিয়ে কবি সাজ্জাদ ফরাজী সমস্ত জটিলতার অবসান কামনা করেছেন "ছোট্ট নীরবতার কুড়ে ঘর গড়তে গিয়ে / হাজারটি অবিশ্বাসের পেরেক ঠুকে / বসে আছে।" কিন্তু হৃদয়ের গহনে প্রবেশ করলে খোঁজ মিলবে পরম বৈভবের । এই দমবন্ধ, চাপা, গুমোট সম্পর্কের আক্ষেপও অনেক । সংশয়, আশঙ্কা সমস্ত স্বাভাবিকতার উৎসমুখ প্রতিহত করে । আবীর ইসলামের ছন্দোময় আক্ষেপ - "হয় না বলা বলতে গেলে / সুপ্ত মনের কথন / দেখলে তাকে যাই যে হয়ে / বোবা মমির মতোন ।"
বিপরীতে সহজতায় গা ভাসিয়েছেন কবি দূর্গা রায় । শালুক -মহুল -নীল পিয়াসার চেনা রোমান্টিকতার ঘরে ফেরার বাসনা তাঁর । প্রকৃতির কাছে ফিরে 'প্রকৃতি কবিতা'র পাঠ নেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন তপন বসু । ড. এস. এম. পারভেজ মোহিত স্মৃতিটুকু বুকে রেখে বিগত দিনযাপনের স্বপ্নে ডুবে যেতে চান । বহু বহুকাল পরে এই বাংলা কবিতায় 'রাতি' শব্দের ব্যবহার পাওয়া গেল ।
জি. এইচ. আশিক 'সন্ন্যাসী' কবিতায় নিজেকে উজাড় করে লিখেছেন । আস্তিকতার বিপরীতে তাঁর অবস্থান ক্রমশ অস্থির । দুটি দেয়াল চেপে ধরবে তোমায় / তুমি দুটি হাত উরধে তুলে চিৎকার করবে / খাঁচা তবু ভাংবে না / খসে পরবে দেয়ালের পুরানো আস্তরণ । সৃষ্টিকর্তাকে হত্যা করে নিজেকে জাগিয়ে তোলার একান্ত বাসনা তাঁর । একইসঙ্গে শৈলেন্দ্র প্রাসাদ চৌধুরী মানিকও মনে করেন, " আজ কবি শিঙ্খলে আবদ্ধ ।" তিনি এও মনে করেন, পৃথিবীর অগণিত ' খোকারা ' কবিকে মুক্ত করবেই ।
বরং অপেক্ষকৃত শান্তিরসের কবিতা রচনায় প্রয়াসী বাপ্পা শৌভিক, ওয়াহিদ জালাল, রেজা রহমান, আরশদ উল্লাহ, তামজিদ আহমেদ প্রমুখ । কেউ 'নিরালা কুঞ্জ ছায়া'য় নিজের ঠিকানা খুঁজেছেন, কেউ ' বেদনার প্রিয় আলিঙ্গন 'কে সঙ্গী করে একাকী, বিহ্বল । কেউ বা অসম্ভব তীব্র সংরাগে লেখেন, "ফুল তো সবাই যাচে / তোমার মতোন ফুলের পাগল আর কে আছে ।" বনলতা সেনের আদলে জিনাত জাহানকে আবিষ্কার করেছেন কবি আরশাদ উল্লাহ । দু-দন্ডের শান্তি পেতে জীবনানন্দের বনলতা সেনের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন কবি গৌতম সেন । আবার দূর থেকে প্রেমকে আস্বাদন করতে ভালোবসেন কবি এস. আর. খান । রাতের অন্ধকারে ঠায় ভালভাসা অনুভব করে ক্রমশ ভাঙতে থাকেন মাহবুবা কামাল বিনু । ভালবাসার নারীর প্রতি তাঁর অভিযোগ, "মারাত্মক আদি অন্ধকার জ্বলিয়ে রেখেছিস শুধু ।" প্রিয়তমা নারীকে ভুলতে না পেরে গুমরে মরেণ সুব্রত ভদ্র অপু ।
এইসব প্রেমপ্রীতির ধারাভাষ্যকার কবিদের প্রতি কিছুটা বিরক্ত কবি অনুপম দাশশর্মা । কবিতার গুরুঠাকুরদের তিনি শব্দখরচে ' মিতব্যয়ী ' হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন । তবে অনুপমকে থোড়াই কেয়ার করে চৈতালি গোস্বামী অসম্ভব রোমান্টিক এক প্রেমের কবিতা রচনা করেছেন । পংক্তির ফাঁকে ফাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রয়োগ তাঁর নিরীক্ষাপ্রবণ মনকেও হাজির করায় । জীবন মৃত্যুর আলিঙ্গনে বাঁচতে চেয়ে লিখেছেন অভিজিৎ রায়, শামীম পারভেজ । স্থবির নেতাজীকে সাক্ষী রেখে মধ্যরাতে প্রেমিকাকে বার্তা পাঠান কবি অরিন্দম চন্দ্র । অফুরন্ত যাত্রাপথে অলীক নৌকার মতো ঘাট থেকে ঘাটে ভেসে বেড়ান বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় ।
এমন প্রীতিমুখর উচ্চারণের মাঝে মৌ দাশগুপ্তা পাঠকে 'রাধিকার গল্প' শোনান। "কৃষ্ণের বাঁশী শুনে রাধিকার বায়না / জ্বলছে আগুন শরীর জুড়ে, ঢের হয়েছে আর না।" অন্যদিকে অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় সোজাসাপটা লেখেন - " দুরারোগ্য কাম-রোগ বিলি কাটছে মজ্জায় মজ্জায় / এই মুহূর্তে একটা নরম ডাঁশা পেয়ারা পেলেই / নিজেকে সঁপে দেবো নির্লজ্জ গোপন দেরাজে।“ ‘ঠিক এই মুহূ্র্তে ‘ শীষর্ক কবিতায় অবশ্য ভিন্ন মত ব্যক্ত । জগৎ ও জীবনের মেলবন্ধনে প্রতিটি ক্ষণে জীবনের যে উৎসার প্রবহমান, তার প্রতি অনুরক্ত কবি কিছুটা তিযর্কভাবেই কাছের মেয়েটিকে বিদ্ধ করেন, - " আফসোস, তুমি এগুলোর কিছুই জানলে না / ঠিক এই মুহূ্র্তে / সেই তুমি, “তুমিই” থেকে গেলে……….
পুরুষের এই একতরফা অভিযোগ -অনুযোগ নারীকে চিরকালই ভারাক্রান্ত করেছে নারী তার স্বতন্ত্র মত্তা তথা আত্মপরিচয় অন্বেষণ করেছে । লাবনী বন্দোপাধ্যায় সেই নারীদের একজন হয়েই লিখেছেন, " ভ্যাটিকান সিটি থেকে মণিকর্ণিকার ঘাট / সেখানে একদিন জন্ম নেবে নারীবাদ ।" কিন্তু সে তো সম্পূর্ণতা নয়, সমগ্রতা নয় ! হৈমন্তী শুক্লার সংগীতে বিবশ হয়ে কবি অমিত রায় তথাকথিত যৌনতাকে অতিক্রম করে পূরবী - বিভাসের সমগ্রতায় লীন হতে চেয়েছেন ।
সমগ্রতায় মানুষ বারেবারে পৌঁছাতে চেয়েছে অথচ মৃত্যু এসে আচম্বিতে থাবা বাড়ায় । জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান । তাঁর গুনমুগ্ধ বাবুল ডি' নকরেক লেখেন, " মাথা উচু করে ঘাস কাটার চেয়ে, মাথা নীচু করে / আমরা ভিক্ষে চাইব মানুষের জন্য, একটা হাসপাতালের জন্য / জীবনের শেষ স্বপ্ন তোমার !”
কিন্তু স্বপ্নের কি কোনো শেষ আছে ? এই যান্ত্রিক জীবনে, নাগরিক ব্যস্ততার মাঝেও বহুজন মুক্তি চেয়েছে অক্ষরের কাছে, সাদা পাতার সঙ্গে যুযুধান মৈত্রীতে । এই বিশ্বাস, এই ঋদ্ধিতে একাগ্র বেশ কিছু কবি মানুষের ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আমি সাতকাহনের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ । ভাবনায় সিদ্ধিলাভ হোক মানুষের। ঐ মহামানবের ।”
.............. রাজশেখর রায়চৌধুরী
.................... রিয়া দাশগুপ্তা
বহুজন মুক্তি চেয়েছে অক্ষরের কাছে
“শক্তি চট্টোপাধ্যায় একদা 'দেশ' পত্রিকার পাতায় এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছিলেন "এত কবি কেন ?" তো তাঁর এহেন আক্ষেপে বঙ্গ কবিকুলে ঢি - ঢি পড়ে গিয়েছিল । এ যেন কাকের মাংস কাকেরই ভক্ষণ ! রেগে আগুন তেলে বেগুন এমত কবিরা এর পরও লক্ষ লক্ষ বাংলা কবিতা রচনা করেছেন । পকেটের পয়সা খরচ করে বই ছেপে পরস্পরকে বিতরণ করেছেন । গোপনে অন্যের লেখাকে ঈর্ষা করেছেন আর নিজেই নিজের লেখা শ্রেষ্ঠত্বে যারপরনাই পুলকিত হয়েছেন । যদিও এরা সকলেই জীবনানন্দ কথিত 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি' - জাতীয় মন্তব্যকে বেদবাক্য বলেই মানেন । তবু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বাংলা কবিতা আজও বহুপ্রসবিনী । প্রযুক্তি মুখরিত, পণ্য শাসিত অতি-আধুনিক সময়ে আজও বাঙালি কবিদের কলম অপ্রতিরোধ্য । স্বভাবতই এর একটা সদর্থক দিক রয়েছে । রচনার তাগিদে প্রত্যেক কবির জীবনের পক্ষে অবস্থান । শ্রীমতি রিয়া দাশ গুপ্তা সম্পাদিত সাতকাহনের সাম্প্রতিক সংখ্যার ৩৯ টি কবিতা পাঠ করে অনন্ত এমনটাই প্রাথমিকভাবে আমার মনে হল ।
প্রেম - প্রীতি, নারীবাদ, আধুনিকতা-উত্তর আধুনিকতা, হৈমন্তী শুক্লা, বাংলা গান, অস্থিরতা, গহীন মন, আত্মরতি থেকে শুরু করে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে শোকগাথা রচনা করেছেন দুই বাংলার বেশ কয়েকজন কবি । বাংলা কবিতার বিবর্তনের প্রেক্ষিত কিংবা প্রকরণের ধারাবাহিকতা মাথায় রেখে, চুলচেরা বিশ্লেষণে না গিয়ে কেবল নিখাদ আবেগ ও অভীপ্সার সরল পাঠস্পর্শে জেনে নিতে পারি কয়েকজন বাঙালি কবির আন্তরিক উচ্চারণমালা । যা একইসঙ্গে বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক ধরনেরও খোঁজ দিতে পারে ।
স্বরাজ দত্ত স্পষ্টভাষায় জানিয়েছেন "এবার লিখতে হলে / শুধু নিজের জন্যই লিখব ।" তিনি ‘ সভ্যতার জুতো ’ খুলে খালি পায়ে নামতে চেয়েছেন বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে । তাঁর কল্পনার আকাশ-বাতাস-নদী "ঘাম-রক্ত-লড়াই আর প্রেমে মাখামাখি ।" আবহমান বাংলা কবিতার মানচিত্রে তিনি ' সাবজেক্টের ইতিহাস ' খোদাই করতে চেয়েছেন । নীল আলোয় যুবক যুবতীদের অগ্নিস্নানের অনুভূতিমালা খুঁজে দেখেন জল পরী । এম মোসাইন খানের 'প্রতিবাদী কোষ' তাঁকে প্ররোচিত করেছে কবিতা রচনায় । বর্তমানে মুল্যবোধহীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজে তাঁর আর্তি ও আশা একইসঙ্গে প্রতিধ্বনিত ।
সম্পর্কের গভীরে প্রবেশ করার আহ্বান জানিয়ে কবি সাজ্জাদ ফরাজী সমস্ত জটিলতার অবসান কামনা করেছেন "ছোট্ট নীরবতার কুড়ে ঘর গড়তে গিয়ে / হাজারটি অবিশ্বাসের পেরেক ঠুকে / বসে আছে।" কিন্তু হৃদয়ের গহনে প্রবেশ করলে খোঁজ মিলবে পরম বৈভবের । এই দমবন্ধ, চাপা, গুমোট সম্পর্কের আক্ষেপও অনেক । সংশয়, আশঙ্কা সমস্ত স্বাভাবিকতার উৎসমুখ প্রতিহত করে । আবীর ইসলামের ছন্দোময় আক্ষেপ - "হয় না বলা বলতে গেলে / সুপ্ত মনের কথন / দেখলে তাকে যাই যে হয়ে / বোবা মমির মতোন ।"
বিপরীতে সহজতায় গা ভাসিয়েছেন কবি দূর্গা রায় । শালুক -মহুল -নীল পিয়াসার চেনা রোমান্টিকতার ঘরে ফেরার বাসনা তাঁর । প্রকৃতির কাছে ফিরে 'প্রকৃতি কবিতা'র পাঠ নেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন তপন বসু । ড. এস. এম. পারভেজ মোহিত স্মৃতিটুকু বুকে রেখে বিগত দিনযাপনের স্বপ্নে ডুবে যেতে চান । বহু বহুকাল পরে এই বাংলা কবিতায় 'রাতি' শব্দের ব্যবহার পাওয়া গেল ।
জি. এইচ. আশিক 'সন্ন্যাসী' কবিতায় নিজেকে উজাড় করে লিখেছেন । আস্তিকতার বিপরীতে তাঁর অবস্থান ক্রমশ অস্থির । দুটি দেয়াল চেপে ধরবে তোমায় / তুমি দুটি হাত উরধে তুলে চিৎকার করবে / খাঁচা তবু ভাংবে না / খসে পরবে দেয়ালের পুরানো আস্তরণ । সৃষ্টিকর্তাকে হত্যা করে নিজেকে জাগিয়ে তোলার একান্ত বাসনা তাঁর । একইসঙ্গে শৈলেন্দ্র প্রাসাদ চৌধুরী মানিকও মনে করেন, " আজ কবি শিঙ্খলে আবদ্ধ ।" তিনি এও মনে করেন, পৃথিবীর অগণিত ' খোকারা ' কবিকে মুক্ত করবেই ।
বরং অপেক্ষকৃত শান্তিরসের কবিতা রচনায় প্রয়াসী বাপ্পা শৌভিক, ওয়াহিদ জালাল, রেজা রহমান, আরশদ উল্লাহ, তামজিদ আহমেদ প্রমুখ । কেউ 'নিরালা কুঞ্জ ছায়া'য় নিজের ঠিকানা খুঁজেছেন, কেউ ' বেদনার প্রিয় আলিঙ্গন 'কে সঙ্গী করে একাকী, বিহ্বল । কেউ বা অসম্ভব তীব্র সংরাগে লেখেন, "ফুল তো সবাই যাচে / তোমার মতোন ফুলের পাগল আর কে আছে ।" বনলতা সেনের আদলে জিনাত জাহানকে আবিষ্কার করেছেন কবি আরশাদ উল্লাহ । দু-দন্ডের শান্তি পেতে জীবনানন্দের বনলতা সেনের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন কবি গৌতম সেন । আবার দূর থেকে প্রেমকে আস্বাদন করতে ভালোবসেন কবি এস. আর. খান । রাতের অন্ধকারে ঠায় ভালভাসা অনুভব করে ক্রমশ ভাঙতে থাকেন মাহবুবা কামাল বিনু । ভালবাসার নারীর প্রতি তাঁর অভিযোগ, "মারাত্মক আদি অন্ধকার জ্বলিয়ে রেখেছিস শুধু ।" প্রিয়তমা নারীকে ভুলতে না পেরে গুমরে মরেণ সুব্রত ভদ্র অপু ।
এইসব প্রেমপ্রীতির ধারাভাষ্যকার কবিদের প্রতি কিছুটা বিরক্ত কবি অনুপম দাশশর্মা । কবিতার গুরুঠাকুরদের তিনি শব্দখরচে ' মিতব্যয়ী ' হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন । তবে অনুপমকে থোড়াই কেয়ার করে চৈতালি গোস্বামী অসম্ভব রোমান্টিক এক প্রেমের কবিতা রচনা করেছেন । পংক্তির ফাঁকে ফাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রয়োগ তাঁর নিরীক্ষাপ্রবণ মনকেও হাজির করায় । জীবন মৃত্যুর আলিঙ্গনে বাঁচতে চেয়ে লিখেছেন অভিজিৎ রায়, শামীম পারভেজ । স্থবির নেতাজীকে সাক্ষী রেখে মধ্যরাতে প্রেমিকাকে বার্তা পাঠান কবি অরিন্দম চন্দ্র । অফুরন্ত যাত্রাপথে অলীক নৌকার মতো ঘাট থেকে ঘাটে ভেসে বেড়ান বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় ।
এমন প্রীতিমুখর উচ্চারণের মাঝে মৌ দাশগুপ্তা পাঠকে 'রাধিকার গল্প' শোনান। "কৃষ্ণের বাঁশী শুনে রাধিকার বায়না / জ্বলছে আগুন শরীর জুড়ে, ঢের হয়েছে আর না।" অন্যদিকে অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় সোজাসাপটা লেখেন - " দুরারোগ্য কাম-রোগ বিলি কাটছে মজ্জায় মজ্জায় / এই মুহূর্তে একটা নরম ডাঁশা পেয়ারা পেলেই / নিজেকে সঁপে দেবো নির্লজ্জ গোপন দেরাজে।“ ‘ঠিক এই মুহূ্র্তে ‘ শীষর্ক কবিতায় অবশ্য ভিন্ন মত ব্যক্ত । জগৎ ও জীবনের মেলবন্ধনে প্রতিটি ক্ষণে জীবনের যে উৎসার প্রবহমান, তার প্রতি অনুরক্ত কবি কিছুটা তিযর্কভাবেই কাছের মেয়েটিকে বিদ্ধ করেন, - " আফসোস, তুমি এগুলোর কিছুই জানলে না / ঠিক এই মুহূ্র্তে / সেই তুমি, “তুমিই” থেকে গেলে……….
পুরুষের এই একতরফা অভিযোগ -অনুযোগ নারীকে চিরকালই ভারাক্রান্ত করেছে নারী তার স্বতন্ত্র মত্তা তথা আত্মপরিচয় অন্বেষণ করেছে । লাবনী বন্দোপাধ্যায় সেই নারীদের একজন হয়েই লিখেছেন, " ভ্যাটিকান সিটি থেকে মণিকর্ণিকার ঘাট / সেখানে একদিন জন্ম নেবে নারীবাদ ।" কিন্তু সে তো সম্পূর্ণতা নয়, সমগ্রতা নয় ! হৈমন্তী শুক্লার সংগীতে বিবশ হয়ে কবি অমিত রায় তথাকথিত যৌনতাকে অতিক্রম করে পূরবী - বিভাসের সমগ্রতায় লীন হতে চেয়েছেন ।
সমগ্রতায় মানুষ বারেবারে পৌঁছাতে চেয়েছে অথচ মৃত্যু এসে আচম্বিতে থাবা বাড়ায় । জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান । তাঁর গুনমুগ্ধ বাবুল ডি' নকরেক লেখেন, " মাথা উচু করে ঘাস কাটার চেয়ে, মাথা নীচু করে / আমরা ভিক্ষে চাইব মানুষের জন্য, একটা হাসপাতালের জন্য / জীবনের শেষ স্বপ্ন তোমার !”
কিন্তু স্বপ্নের কি কোনো শেষ আছে ? এই যান্ত্রিক জীবনে, নাগরিক ব্যস্ততার মাঝেও বহুজন মুক্তি চেয়েছে অক্ষরের কাছে, সাদা পাতার সঙ্গে যুযুধান মৈত্রীতে । এই বিশ্বাস, এই ঋদ্ধিতে একাগ্র বেশ কিছু কবি মানুষের ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আমি সাতকাহনের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ । ভাবনায় সিদ্ধিলাভ হোক মানুষের। ঐ মহামানবের ।”
.............. রাজশেখর রায়চৌধুরী