দৃশ্যটা ছিল এরকম .........
বিধ্বংসী বোমা, বুলেট আর আগুনের নির্লজ্জ আদরে
যায়গাটা ধ্বংসস্তূপ
তখনো আকাশপানে ছুটে চলা ধোঁয়ার কুণ্ডলী
মেঘ-ঘন চারপাশ
বাতাসে বারুদ-গন্ধে মিশে আছে
মানুষের মেদ-মাংস-অস্থি পোড়া ঘ্রাণ
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শবদেহ
খণ্ড-বিখণ্ড শরীরের অংশ অবশেষ ।
ক্যামেরা সেখানে থেমে থাকে কিছুক্ষণ
শুষে নেয় যতটুকু বেচা যায় বাজারে ও হাটে ।
যুদ্ধও বিকোয় আজ,
মানুষের অপমৃত্যু দৃশ্যবন্দী হয়ে
দাম দেয় ভালো !!
এরপর সরে যেতে-যেতে
হঠাৎ থমকে থামে ক্যামেরার চোখ
ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হয় বিক্ষত নারীর এক উলঙ্গ শরীর
মৃত নারী...... চিরসুপ্ত মানবীর দেহ
রক্তভেজা নগ্নতায় পৈশাচিক উল্লাসের শব ।
'ক্লোজ-আপ...... ক্লোজ-আপ......'
কে যেন চিৎকার করে বলে -
আরও স্পষ্ট, আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে রমণীর মুখ
অদূরে দুধের শিশু, ধ্বংসস্তূপ, হাহাকার,
আর নয় কিছু ।
ক্যামেরা ক্লোজ-আপ হোলে বোঝা যায়
রক্তে ভাসা মুখে শিশুটির ডান চোখ উৎপাটিত
বাঁ-পা'টা যায়নি পুরোটা
তবুও রয়েছে বেঁচে !
চিৎকারে-চিৎকারে নিজের অক্ষম উপস্থিতি
ঘোষণায় ক্লান্তিহীন,
তখনও চোখের জল কিছু বাকি রয়ে গেছে !
অকস্মাৎ মনুর সন্তানদের স্তব্ধ করে দিয়ে
শিশুটি এগোতে থাকে অদম্য ইচ্ছায়
শুয়ে থাকা রমণীর দিকে ।
অক্ষম শরীর বোঝা,
তাই ঘষে-ঘষে টেনে নিয়ে যায়
নারীটির নগ্ন বুকে মুখ রাখে
দুরন্ত আক্রোশে
দুধ নয়, রক্ত চুষে খায় !
যুদ্ধর ঔরসে দ্বিজ, দানবের দান -
কাট......কাট......কাট......
এতক্ষণে লজ্জা পায় মনুর সন্তান ।
মহামান্য ভদ্রজনমণ্ডলী,
আমি সেই শিশু ।
বিকলাঙ্গ শরীরের বোঝা বই আমি
দুঃখ-কষ্ট, ভালবাসা, ভালোলাগা,
ইচ্ছে-অনিচ্ছের বোঝা বয়ে যাই ।
পুষ্পল বসন্ত এসে আমাকেও রজঃস্বলা করে যায়
পরুষ পুরুষ স্পর্শ আকাঙ্ক্ষায়
বিনিদ্র রাত্রির শেষে আলো নয়
নিকষ তামস এক বয়ে যাই আমি ।
কখনো বা স্বপ্ন ভীড় করে আমারও দুচোখে -
সখিপরিবৃতা হয়ে পরীদের রাণী এসে হাত ধরে
নিয়ে যায় নন্দন কাননে ।
সেখানে অসীম শান্তি -
যুদ্ধ নেই, হাহাকার নেই,
নেই দুধের শিশুর মা-হারা যন্ত্রণা
নেই বিকলাঙ্গ জীবনের দুর্বিষহ ব্যথা ।
আমি তাদের সাথে হাসি, খেলি, গল্প করি,
বেশ কাটে খানিকটা সময় ।
তারপর যখন তারা পৃথিবীর কথা জানতে চায়
তখন কাঁদি আমি -
তারা জানতে চায় - 'যুদ্ধ কি ?'
আমি বলি - 'মানুষের পৈশাচিক উল্লাস'
তারা জিজ্ঞেস করে - 'যুদ্ধ কেমন ?'
আমি বলি - 'রাহু যেমন চাঁদ কে গ্রাস করে,
যুদ্ধ তেমনই সভ্যতাকে গিলে খায় !'
তারা বুঝতে চেষ্টা করে, বলে - 'তাতে কি হয় ?'
আমি বলি - 'মানুষ মরে, সবুজ ধ্বংস হয়,
আমার মত হাজার-হাজার অনাথ আর বিকলাঙ্গ জন্মায় ।'
ভয়ে রাণীর মুখ তখন ফ্যাকাসে,
নিষ্পাপ দুটি চোখ আমার দিকে তুলে ধোরে
অকৃপণ সারল্য মাখা সহানুভূতিতে প্রশ্ন করে -
'কারা যুদ্ধ বাধায় ?'
আমি বলি - লোভ যাদের সর্বগ্রাসী,
অহং যাদের আকাশচুম্বী,
অত্যাচার যাদের নেশা,
ক্ষমতা-লিপ্সায় যারা অন্ধ,
যাদের অবয়ব মানুষের মত, কিন্তু
চিন্তাধারা পশুরও অধম, তারা ।'
ঘেন্নায় চোখ-মুখ কুঁচকে সে প্রশ্ন করে -
'আর মরে কারা ?'
আমি বলি - 'আমি আর আমরা,
যারা সাধারণ মানুষ ।'
তখন রাণী আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে
আদর করে, সান্ত্বনা দেয়,
আমরা একে অন্যের কাঁধে মুখ রেখে
অঝোর ধারায় কাঁদি কিছুক্ষণ ।
ভদ্রজন, ভাল করে একবার দেখুন আমায়,
আমি শুধু আমি নই,
যুদ্ধবাজ প্রজন্মের একজন
আপনাদেরই সন্তান-সন্ততি
আপনাদের বিকলাঙ্গ ভবিষ্যৎ ।
গোটা পৃথিবীটা বিকলাঙ্গ হোয়ে যাবার আগে
আসুন আমরা একসাথে বলি -
'যুদ্ধ কখনও আনতে পারেনা মীমাংসা
যুদ্ধ চাইনা, যুদ্ধবাজরা নিপাত যাও,
বহু প্রাণ গেছে অকালে এবং অকারণে
দোহাই যুদ্ধ, এবার একটু শান্তি দাও ।'